বঙ্গনিউজ ডটকমঃসবুজ পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ভেসে চলা কার্পাস তুলার মতো মেঘ, ঝরনার পানিতে এলিয়ে দেয়া নাগরিক জঞ্জালে কান্ত শরীর, বৃষ্টিস্নাত চা বাগানে গজিয়ে ওঠা নতুন কুঁড়ি মৌলভীবাজার তথা সিলেট ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে প্রকৃতির এমন মোহনীয় অপরূপ দৃশ্য।
বর্ষাকালে হাকালুকি হাওরের বিল ও নদীগুলো একীভূত হয়ে রূপ ধারণ করে সাগরের মতো এক বিশাল জলাশয়ের। এ সময় হাওরের বিলেরপাড় ও কান্দায় বিদ্যমান জলাভূমি, বন পানির নিচে ডুবে সৃষ্টি করে ডুবন্ত বন। বন ব্যবহৃত হয় মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে। বর্ষাকালে হাওরপাড়ে বসবাসরত মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম উন্মাদনা। যোগাযোগব্যবস্থা হয় সহজ। যোগাযোগের বাহন হিসেবে স্থান করে নেয় দেশীয় দাঁড়বাহী ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা। জেলেরা মেতে ওঠেন মাছ ধরার উৎসবে। বিভিন্ন প্রকার সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এই সময় অনুষ্ঠিত হয়। হাওরের জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডারও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
হাকালুকি সম্পর্কিত কিছু তথ্য : বর্ষা ও শীত উভয় ঋতুই সিলেটে ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী সময়। অন্যান্য দর্শনীয় জায়গাগুলোর সাথে প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারেন এশিয়া মহাদেশ তথা বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ হাকালুকি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্র্যের অপুর্ব লীলাভূমি হাওরটি বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে অপরূপ দৃশ্যের।
দেশের বৃহত্তম এই হাওর অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানিরও জলাভূমি। আগে পাথারিয়া ও মাধব পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় পরিবেষ্টিত হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলায় বিস্তৃত। ছোট বড় ২৪০টি বিল ও ১০টি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওর বর্ষাকালে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়। এই হাওরে বাংলাদেশের জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকের বেশি এবং সঙ্কটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পাওয়া যায়।
পাঁচটি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওরটি সিলেট ও সীমান্তবর্তী মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। হাওরের ৪০ শতাংশ অংশ বড়লেখা, ৩০ শতাংশ কুলাউড়া, ১৫ শতাংশ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ শতাংশ গোলাপগঞ্জ ও ৫ শতাংশ বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত। হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪০০ হেক্টর। ২৪০টি বিল নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওরের বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বর্ষাকালে এই হাওর ধারণ করে এক অনবদ্য রূপ।
শীতকালে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের পাড় সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। বিলের পানির মধ্যে ও চারধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উঁচুভূমি বিলের পানির প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্যের। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের জলরাশির মধ্যে সূর্যের প্রতিচ্ছবি বেশ মনোমুগ্ধকর। শীতকালে অতিথি পাখিরা সারি বেঁধে আসতে থাকে বিলগুলোতে। পরিযায়ী পাখির আগমনে হাওর যেন পরিণত হয় স্বর্গোদ্যানে। আর এ সময় অতিথি পাখিদের সাথে মিতালী গড়তে মানুষের কলকাকলিও বাড়ে হাওর পাড়ে। এই বর্ষা মওসুমেও দেখা যায় কিছু অতিথি পাখি। কিছু পাখি স্থায়ী আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় একটি বাড়িতে।
হাওরের স্বাদু ও মিঠাপানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরো নানা প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তির পথের মাছগুলো।
জীববৈচিত্র্য : হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া রয়েছে ১৪১ প্রজাতির অন্য বন্যপ্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ, তন্মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিভিন্নপর্যায়ে বিপন্নপ্রায়। এ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের কীটপতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ুদ্র অনুজীব। ইকো-ট্যুরিজমের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হাকালুকি হাওরসহ সাতটি প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা। উপরিউক্ত প্রাকৃতিক উপাদান ছাড়াও রয়েছে স্থানীয় পেশাজীবী মানুষের ইতিহাস, সামাজিক আচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ।
নামকরণ : হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত রয়েছে, অনেক বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘লুকি দেয়’ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকে। কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি। এও বলা হয়, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক নৃপতি ও তার রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। কালক্রমে তলিয়ে যাওয়া নি¤œভূমির নামকরণ হয় আকালুকি বা হাকালুকি। আরো শোনা যায়, এক সময় বড়লেখা উপজেলার পশ্চিমাংশে হেংকেল নামক একটি উপজাতি বাস করত। হেংকেলদের বসবাস এলাকার নাম ছিল হেংকেলুকি। পরে এই হেংকেলুকিই হাকালুকি নাম ধারণ করে। অন্য একটি জনশ্রুতি মতে, এক সময় হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি বসবাসরত কুকি ও নাগা উপজাতি তাদের ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করে ‘হাকালুকি’। হাকালুকি অর্থ লুকানো সম্পদ। সিলেটে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার স্থান মৌলভীবাজার। সেখান থেকে বাস কিংবা মাইক্রোবাসে কুলাউড়া গেলেই হাওরের অংশ শুরু হওয়ায় বিস্তৃত জলরাশির হাকালুকি হাওর দেখা যায়।
কিভাবে যাবেন : রাজধানী ঢাকার কমলাপুর ও ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন ৩টা ট্রেন ছাড়ে সিলেটের উদ্দেশে। সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা। ট্রেনে গেলে রাত ৯.৫০টার উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো। এ ছাড়া বাসেও যাওয়া যাবে। বাসে যেতে চাইলে অনেক বাস আছে। ভোর থেকে শুরু করে রাত ১টা পর্যন্ত এসব বাস পাবেন। বাসে যেতে সময় লাগবে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা। -
বাংলাদেশ সময়: ১:৫১:৪৮ ৫৭৩ বার পঠিত