বঙ্গনিউজ ডটকমঃ ভুল মানুষটিকে ভালোবেসেছিল ছেলেটি। বুঝতে পারে নি, তাদের ভালোবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে উভয় পরিবারের সামাজিক অবস্থান। স্বপ্নেও ভাবে নি, ভালোবাসার মানুষটি ঘোর বিপদে একা ফেলে চলে যাবে পরিবারের রক্তচক্ষুর ভয়ে। এমন মানসিক অবস্থায় মেয়েটির পরিবারের সদস্যদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার পারভেজ (২০) গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৭ নম্বর সার্জারি বিভাগে কারারক্ষীর প্রহরায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বিষয়টি গতকাল আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন নিহত পারভেজের বড় বোন শাহিনা আক্তার।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগারের ডেপুটি জেল সুপার মনির হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, গত ৩ আগস্ট থেকে পারভেজ নামের ঐ হাজতি আদালতের আদেশে কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। যার হাজতি নম্বর ১১৮৭২/১৫। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ৬ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সন্ধ্যা ৬টায় মারা যান তিনি। আজ সোমবার সকালে লাশ ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় পারভেজের মৃত্যু সংবাদ শুনে চমেক হাসপাতালের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পারভেজের বেডের আশেপাশের অনেক রোগীর আত্মীয়স্বজন জানে তার করুণ পরিণতির কথা। তার বোন শাহিনা আক্তার জানান,চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার গোডাউন এলাকার বজল আহমেদের ছেলে পারভেজ। ছেলেবেলায় পিতাকে হারায় সে। তাই প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার আগেই পড়ালেখার ইতি টেনে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। দুই বোন ও এক মাকে নিয়ে শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম। রাজমিস্ত্রির কাজ করে বড় বোনের বিয়ে দিয়েছে। ছোট বোন ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে টেনেটুনে সংসার চলছিল।
শাহিনা আক্তার জানান, ২০১৪ সালের শেষের দিকের কথা। রাঙ্গুনিয়ার পোমরা ইউনিয়নের শান্তিরহাট এলাকায় একটি পাকা ভবন নির্মাণের কাজে যায় পারভেজ। পাশের বাড়িতে থাকতো নাজমা আক্তার নামে এক মেয়ে। দীর্ঘ দিন সেখানে কাজ করার সুবাধে নাজমার সাথে প্রায়ই দেখা হতো। একদিন মেয়েটি-ই তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে। পারভেজ ফিরিয়ে দেয় সে প্রস্তাব। কিন্তু নাজমা নাছোড়বান্দা। হাত কেটে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে, মোবাইল ফোনের সেই হাতের কাটা ছবি তুলে পাঠায় পারভেজের কাছে। এরপর থেকে চলতে থাকে তাদের কথা-বার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ।
প্রেমের বয়স ৯ মাস পার হতে না হতেই একদিন ঠিকই তাদের মধ্যকার সম্পর্কের খবর জেনে যায় নাজমার পরিবার। নাজমাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে তার পরিবার। গত ২০ জুন পারভেজ-নাজমা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ঘর বাঁধার উদ্দেশ্যে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে চলে আসে তারা। সেখান থেকে কক্সবাজার জেলা সদরের কতুবদিয়া বাজারে পরিচিত এক ‘বড় ভাইয়ের’ বাসায় উঠে দু’জন। হুজুর ডেকে বিয়ে করে দু’জন।
এরই মধ্যে তারা জানতে পারে, নাজমার পরিবারের পক্ষ থেকে পারভেজের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়া থানায় একটি অপহরণ ও নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে। নাজমার মোবাইল ফোনে তার পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ করে ফিরে আসতে বলে। তারা জানায়, বিয়ে হয়ে গেছে যেহেতু,এখনতো মেনে না নিয়ে উপায় নেই। ছোটখাট একটা অনুষ্ঠান করে তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করার কথাও বলা হয়। ২৮ জুলাই নাজমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসে পারভেজ। নাজমাকে পাঠিয়ে দেয় রাঙ্গুনিয়া তাদের বাড়িতে। তবে পারভেজ মামলার ভয়ে শহরেই রয়ে যায়।
৩১ জুলাই শুক্রবার নাজমার বড় ভাই ফোন করে পারভেজকে। তার কথামতো রাউজান নোয়াপাড়ায় নাজমার ভাইয়ের ভাড়া বাসায় যায় পারভেজ। সেখানে নাজমার এক বড়বোনও আসে। তারা অভয় দেয়, বাড়িতে গিয়ে মুরুব্বীদের কাছে ক্ষমা চাইলেই সব মিটে যাবে। তাদের দু’জনের সাথে সিএনজি টেক্সি করে ১ আগস্ট শনিবার সন্ধ্যার দিকে রাঙ্গুনিয়ার শান্তিরহাট এলাকায় শ্বশুর বাড়ি যায় পারভেজ। রাতের খাবার খায় সকলের সাথে। খাওয়া শেষে নাজমার পিতা ডেকে পাঠান পারভেজকে। সেখানে নাজমার আপন ভাই, চাচাত ভাইসহ দশ বারো জন্য উপস্থিত ছিলেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই শুরু হয় নির্যাতন। এলোপাথারি কিল ঘুষি চলতে থাকে। সাথে শুরু হয় লাঠি, লোহার রড আর ওজন মাপার বাটখারা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করা। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারায় সে। জ্ঞান ফিরে এলে আবারো শুরু হয় নির্যাতন। এরপর স্থানীয় মেম্বার (ইউপি সদস্য) জসিমের সাহায্যে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। থানায় ওসি পারভেজকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে নাজমাকে ডেকে পাঠান। তার মুখোমুখি করে জানতে চান,পারভেজের সাথে তার কি সম্পর্ক? নাজমা জানায় কোন সম্পর্ক নেই! এরপর পুলিশ অপহরণ ও নারী নির্যাতন মামলার আসামি হিসেবে তাকে কোর্টে পাঠিয়ে দেয়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে কারা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে ৬ আগস্ট তাকে চমেক হাসপাতালের পঞ্চম তলায় ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।
গত শনিবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাতকড়া পরিহিত পারভেজকে পাহারা দিচ্ছে তিন কারারক্ষী ও এক পুলিশ সদস্য। বারান্দায় অতিরিক্ত বেডে শুয়ে থাকা পারভেজের সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। পায়ুপথ দিয়ে অনবরত কালো রক্ত বের হচ্ছে। পারভেজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সার্জারি ওয়ার্ডে কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা. আখিরা আব্দুর রহিম বলেছিলেন, ‘কাগজপত্র দেখে মনে হচ্ছে তার আউট সাইড ফিজিক্যাল ইনজুরি হয়েছে। এখন পায়ুপথ দিয়ে ও মুখ দিয়ে যে মরা রক্ত বের হওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটি হয়তো শরীরের ভেতরে কোনো আঘাতের কারণে হচ্ছে।। আজকে তাকে এক্সরে করানো হয়েছে। রিপোর্ট পেলে কি হয়েছে বলা যাবে।’ রিপোর্ট আসার আর প্রয়োজন রইলো না। তার আগেই না ফেরার দেশে চলে গেল পারভেজ।
পারভেজের নামে গত ১৭ জুলাই রাঙ্গুনিয়া থানায় অপহরণ ও নারী নির্যাতনের একটি মামলা দায়ের করেন নাজমার পিতা নুরুল ইসলাম। সেই মামলায় নাজমার পরিবারের হাতে নির্মম নির্যাতনের পর আশংকাজনক অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয় পারভেজকে। রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি হুমায়ূন কবির জানিয়েছিলেন, পারভেজের বিরুদ্ধে অপহরণ ও নারী নির্যাতন মামলা থাকায় তাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। গ্রেপ্তারের আগে সে গণপিটুনির শিকার হওয়ায় তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। এখন তার কী অবস্থা তা আমার জানা নেই।মামলার আসামি হলেও কেউ আইন হাতে তুলে নিয়ে এভাবে আশংকাজনক অবস্থায় কাউকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে সেখানে কি পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই? এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, বিয়ষটি যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে আমি খতিয়ে দেখছি। গতকাল পারভেজের মৃত্যুর পর রাঙ্গুনিয়া থানার ওসির কাছে ফোন করা হয়। তিনি বলেন, ছেলেটি মারা যাওয়ার ঘটনাটি আমি জানি না। যদি এরকম হয় তাহলে যারা তাকে আহত করেছে তাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০:৪৬:৩৩ ৩৭৯ বার পঠিত