বঙ্গনিউজ ডটকমঃ রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত দিয়ে এখন বানের পানির মতো আসছে মাদক। পদ্মা নদীতে পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সীমান্ত এলাকার মাফিয়া চক্র। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে গোদাগাড়ীতে অভিযান চালিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যর তিন কেজি ২’শ গ্রাম হেরোইনসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
স্থানীয়রা বলছেন, গোদাগাড়ী সীমান্ত দিয়ে হেরোইনের এমন বড় বড় চালান প্রতিদিনই আসছে। চরের সীমান্ত এলাকায় বিজিবি’র নাকের ডগায় কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে সেসব দেশে আসছে। এরপর সুযোগ বুঝে নৌকায় করে পদ্মা নদী পার করে এপারে আনা হচ্ছে মাদক। তারপর এপারের গ্রামগুলো থেকে সেসব ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সীমান্ত রক্ষীদের ‘ম্যানেজ’ করেই গোদাগাড়ী সীমান্ত দিয়ে হেরোইনের বড় বড় চালান আসছে। সীমান্ত এলাকায় বিজিবি মাদকের বিরুদ্ধে তৎপর থাকলে কোনোভাবেই সীমান্ত টপকে মাদকদ্রব্য এপারে আসতে পারবে না। এ অবস্থায় পদ্মা নদীতে নৌ-থানা স্থাপনের দাবি উঠেছে সব মহলেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার খরচাকা, নিমতলা, খারিজাগাতি, মোল্লাপাড়া, ফরাদপুর, প্রেমতলী, সেখেরপাড়া, বিদিরপুর মাদ্রাসা মোড়, চর আষাড়িয়াদহের ৫২৩, চর কানাপাড়া, আষাড়িয়াদহ ইউপি মোড়, সাহেবনগর, ডিএমসি চর, দিয়াড় মানিকচক দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল এবং কেজি কেজি হেরোইন আসছে। এছাড়া গোদাগাড়ীর পশ্চিম পাশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চর কোদালকাটি, বগচর, বোয়ালমারী, চর আলাতুলি, হাকিমপুর, নরেন্দ্রপুর ও ছয়রশিয়া এলাকা দিয়ে মাদক আসছে। হেরোইন আসছে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার লহালামারি বিল, নলডোহরী, রামনগর ও সাইদাপুর এলাকা দিয়েও। এসব এলাকায় ভারতের কাঁটাতারের বেড়া আছে। তারপরেও থেমে নেই চোরাচালান।
স্থানীয় প্রশাসন মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় গোদাগাড়ী উপজেলার মাদারপুর, মহিষালবাড়ি, সারাংপুর, আঁচুয়া, মাটিকাটা ভাটা, সিএন্ডবি, রেলবাজার ও রেলগেট বাইপাস এলাকা রীতিমতো হেরোইনের স্বর্গরাজ্য পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি এমন, যেন হেরোইনের খনি আছে এসব এলাকায়! অন্যদিকে ফেনসিডিলের রমরমা বাণিজ্য চলছে উপজেলার কালিদীঘি, কৃষ্ণবাঢি, বিদিরপুর, মাদ্রাসা মোড়, হরিশংকরপুর, সেখেরপাড়া, ফরাদপুর, চৌদুয়ার, নিমতলা ও খরচাকা এলাকায়। এখন প্রায় প্রতি রাতে এসব এলাকা থেকে ট্রাক ভর্তি হয়ে ফেনসিডিল পাচার হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলায় অন্তত পাঁচ শতাধিক বড় মাপের হেরোইন ব্যবসায়ী আছেন যাদের এক এক জন প্রতিমাসে ১০ থেকে ১৫ কেজি হেরোইনের হাতবদল করে থাকেন। এছাড়াও প্রায় হাজার খানেক ফেনসিডিল ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে ২০-২৫ হাজার বোতল ফেনসিডিল বেচাবিক্রি করে থাকেন। এ কারণে গোদাগাড়ী উপজেলা মাদক চোরাচালানের জন্য ইতিমধ্যেই দেশের অন্যতম প্রধান রুট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সম্প্রতি পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীরা পাল্লা দিয়ে ভারত থেকে হেরোইন-ফেনসিডিল আমদানী করছেন। কেজি কেজি হেরোইন বস্তায় ভরে এখন কাঁটাতারের ওপর দিয়েই চালিয়ে দেয় ভারতের হেরোইন কারিগরেরা। আর ফেনসিডিল পাচারের জন্য চালু হয়েছে আলাদা আরেকটি কৌশল। ফেনসিডিল পাচারের জন্য পাচারকারীরা কাঁটাতারের বেড়ার ওপার থেকে প্লাষ্টিকের পাইপ স্থাপন করে। ওই পাইপের ভেতর দিয়েই দেশে ঢুকে পড়ছে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল। তারপর নৌকায় করে পদ্মা পাড়ি দিয়ে সেসব মাদক চরাঞ্চল থেকে এপারে আনা হচ্ছে।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্ত এলাকার দালালদের সঙ্গে মাদক চোরাচালানের চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্তের দালালদের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর দালালেরা ভারতের মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে চাহিদার পরিমাণ জানিয়ে দেন। তারপর গভীর রাতে চোরাকারবারীরা চলে যান কাঁটাতারের বেড়ার কাছাকাছি। রহস্যজনকভাবে কোনো কোনো রাতে ওই সময় কাঁটাতারের লাইটগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। এপারে টহল দেখা যায়না বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদেরও।
এ ব্যাপারে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম আবু ফরহাদ বলেছেন, তিনি এই থানায় যোগদানের পর এখানকার মাদক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। মাঝে মধ্যেই হেরোইন-ফেনসিডিলের বড় বড় চালান আটক করছে পুলিশ। তবে যেসব সীমান্ত দিয়ে সেসব আসছে সেখানেই বিজিবি’র আরো বেশি জোরালো ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলেই মনে করেন তিনি।
রাজশাহী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘সীমান্ত ও নদী পার হয়ে যেসব মাদক গোদাগাড়ী প্রবেশ করছে, শহর থেকে গিয়ে আমাদের সেসব আটক করতে হচ্ছে। সীমান্ত এলাকাতেই আরো বেশি নজরদারি প্রয়োজন। যেন একটি চালানও আসতে না পারে।’
জানতে চাইলে ৩৭ বিজিবি’র গোদাগাড়ী কোম্পানী কমান্ডার নায়েক সুবেদার আশরাফুল ইসলাম দাবি করেন, সীমান্ত এলাকায় বিজিবি সব সময়ই তৎপর রয়েছে। তবে যারা মাদক ব্যবসা করেন তারা অত্যন্ত সতর্কভাবেই করেন। এ কারণে সব সময় তাদের আটক করা যায়না।
তবে সীমান্ত এলাকার লোকজন বলছেন, শুধু বিজিবি সোচ্চার হলেই সীমান্ত পেরিয়ে মাদকের একটি চালানও দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। অথচ তাদের নাকের ডগা ডিঙিয়ে মাদক এসে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে। তাই পদ্মা নদীতে নৌ-থানা স্থাপন এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
সচেতন মহল বলছেন, নদী এলাকায় মাদক বিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এলাকার সীমানা। তাই চোরাচালানে মাদক ব্যবসায়ীরা থানার সংযোগ এলাকা গুলোকেই বেশি প্রধান্য দেয়। এসব এলাকায় অভিযানে যেতে পুলিশ ও বিজিবি’র মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক থানার সঙ্গে আরেক থানা কিংবা এক ফাঁড়ির সঙ্গে আরেক ফাঁড়ির মাঝে-মধ্যেই রশি টানাটানি শুরু হয়। আবার অপরাধ প্রবণ গোটা উপজেলার অপরাধ নিয়ন্ত্রণেই হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। ফলে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশেরও যতটুকু ভূমিকা থাকা দরকার তা হয়না। মূলত এসব প্রেক্ষাপটে এই এলাকায় পদ্মা নদীতে নৌ-থানা স্থাপন জরুরী হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০:৩৭:৫৩ ৩৯৬ বার পঠিত