বঙ্গ নিউজ ডটকম ঃদর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে ব্যক্তিগত মোক্ষ কথাটা যত বড়, প্রাচীন গ্রিক দর্শনে তা নয়। আবার প্রাচীন গ্রিক দর্শনে রাষ্ট্র যত বড় স্থান দখল করেছে, ভারতীয় দর্শনে তা করেনি। ভারতীয় দর্শনে মোক্ষ বলতে বুঝিয়েছে, চিত্তবৃত্তিগুলো (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) নিয়ন্ত্রণ করে সুখী হওয়ার অথবা দুঃখকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে। অন্য দিকে, প্রাচীন গ্রিক দর্শনে আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করে মানুষকে সুখী করার কথা ভাবা হয়েছে। ভারতীয় দর্শনে যা করা হয়নি। ইসলামে চেষ্টা হয়েছে আদর্শ রাষ্ট্র গড়ার। এ দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয়, ইসলামের মর্ম মানে হলো, মর্তে আদর্শ রাষ্ট্র স্থাপন করে মানুষের নিরাপত্তা বিধান ও তাদের ঐহিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের সুযোগ করে দেয়া। ইসলামের নবী কেবল একজন ধর্ম প্রবর্তকই ছিলেন না, ছিলেন একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক, প্রশাসক এবং যোদ্ধা। তিনি নিজে কম করে ২৭টি যুদ্ধে পালন করেছিলেন প্রধান সেনাপতির ভূমিকা। ইসলামকে তাই বলা চলে না একটি অজাগতিক ধর্ম। আল কুরআনে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, যারা ইহজগতে ভালো কাজ করবে, তারা বেহেস্তে যাবেন (সূরা ২:১১২)। ভালো কাজ বলতে ইসলামে বুঝিয়েছে, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা, অনাথকে প্রতিপালন, নিজের সন্তানদের যথাযথভাবে প্রতিপালন, বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে দেখাশোনা, দুর্ভিক্ষপীড়িত ব্যক্তিদের আহার্য প্রদান, কৃতদাসকে মুক্তি দেয়া প্রভৃতি। একটি সুপ্রচলিত হাদিস হলো, অভুক্ত অবস্থায় নামাজ (সালাত) পড়া যাবে না। ইসলামে ক্ষুধার সমস্যাকে দেয়া হয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। বলা হয়েছে খালি পেটে ধর্ম সম্ভব নয়। বলা হয়েছে, বিরাট সমুদ্র পড়ে আছে, তাতে মাছ ধরে আহার্য সংগ্রহ করতে (সূরা ৫: ৯৯)। ইসলাম একটা বাস্তববাদী ইহজাগতিক ধর্ম। কিন্তু হিন্দুধর্ম তা নয়। হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে যোগসাধনার মাধ্যমে মোক্ষলাভ সম্ভব। যোগসাধনা বলতে বুঝিয়েছে, কামনা বাসনাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এটা করতে বলা হয়েছে দু’ভাবে : একভাবে হলো যোগব্যায়াম চর্চা, আরেকভাবে হলো বৈরাগ্যের সাধনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যোগব্যায়াম চর্চা করেন। আবার তিনি জীবনে করেছেন বৈরাগ্যের সাধনা। তিনি বিবাহ করেছেন, কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে যাপন করেননি স্বামী-স্ত্রীর জীবন। অনেকের মতে, নামাজ হলো এক ধরনের যোগব্যায়াম। এটা সত্য হতে পারে। কারণ নামাজের মাধ্যমে প্রতিদিন হতে পারে শরীর স্বাস্থ্যের পরিচর্যা। কিন্তু ইসলামে বৈরাগ্যের স্থান নেই। ইসলামের নবী পরিচালিত করেছেন একটি রাষ্ট্র। প্রতিদিন প্রশাসনিক কর্মে ব্যয় করেছেন যথেষ্ট সময়। তিনি ছিলেন গৃহী। ইসলামে বৈরাগ্যের স্থান না থাকলেও সুফিবাদ এতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। সুফিরা বলেছেন মোরাকাবা করতে। কিন্তু সুফিবাদকে ধরা উচিত নয় ইসলামের অংশ হিসেবে। কারণ, ইসলামে বলা হয়নি বিধাতার ধ্যানে তন্ময় হয়ে জীবনের কর্তব্যগুলোকে অস্বীকার করতে। ইসলাম একটি ব্যবহারিক ধর্মবিশ্বাস। সেভাবেই এর বিচার করা উচিত। কুরআনে কোথাও মোরাকাবা করার কোনো বিধান নেই। কুরআনে কোথাও বিস্তারিতভাবে বলা হয়নি নামাজ কিভাবে পড়তে হবে। কুরআনুল কারিমে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথাও বলা হয়নি। কুরআনুল কারিম পড়লে মনে হয়, দিনে তিনবার নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছে (সূরা ১১:১১৪)। তবে এখন সুন্নিরা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন কিন্তু শিয়ারা পড়েন তিনবার। বাংলাদেশে শিয়ারা কোনো সমস্যা নন। তবে ইরান আবার একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে। তাই শিয়াদের সম্পর্কে অবগত হওয়া হয়ে উঠেছে প্রয়োজনীয়। ইসলাম শব্দটির উদ্ভব হয়েছে অনেকের মতে হিব্র“ (এপ্র“) শব্দ ‘সালোম’ থেকে। সালোম শব্দের অর্থ শান্তি। ইসলাম চেয়েছে সুশাসনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। শান্তি বলতে বুঝিয়েছে এই জগতের শান্তিকে। ইসলামকে এ দিক থেকেও তাই ধরতে হয় একটি বাস্তবধর্মী ধর্ম হিসেবে। এসব কথা বলতে হচ্ছে, কারণ, বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে নানা প্রকার বিভ্রান্তি। সেটা খুবই অবাঞ্ছিত। কিছু দিন আগে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (আগাচৌ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আল্লাহ্ নামের উদ্ভব নিয়ে বেশ কিছু হইচই তুলেছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে হইচই করার কিছু নেই। আরবি সেমেটিক পরিবারভুক্ত ভাষা। সেমেটিক পরিবারভুক্ত ভাষায় ‘ইল’ বলতে বোঝায় দেবতা। মক্কার আরবিতে দেবতাকে বলা হতো ‘ইলাহ্’। মক্কার আরবরা অনেক দেবতায় বিশ্বাস করতেন। তারা মনে করতেন সবচেয়ে বড় দেবতা হলেন আল্লাহ্। আল্লাহ নামের উদ্ভব হয়েছে, আল+ইলাহা= আল্লাহ। কুরআনে আল্লাহ শব্দটা গ্রহণ করা হলেও, এর পৌত্তলিক অর্থ গ্রহণ করা হয়নি। কুরআন শরিফে সূরা নূর-এর ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ হলেন আলোর আলো। অর্থাৎ নিরাকার শক্তির উৎস হিসেবে। অনেক বৈজ্ঞানিক মনে করেন, তাপ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড শীতল হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। কেননা, শক্তির একটি অফুরন্ত উৎস আছে। এসব বৈজ্ঞানিকের শক্তির অফুরন্ত উৎস আর ইসলামের মহাজ্যোতির ধারণা সাংঘর্ষিক নয়। সম্ভবত আগাচৌ এ বিষয়ে অবগত নন। আগাচৌ ‘আল্লাহ হাফিজ’ এবং ‘খোদা হাফিজ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিছু দিন আগে আমরা খোদা হাফেজ বলতাম। এখন বলছি আল্লাহ হাফেজ। এ থেকে প্রমাণিত হয় না যে, বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে মৌলবাদী। আগাচৌয়ের জানা দরকার ‘খুদা’ শব্দটাও হলো আরবি ভাষার। তবে সেটা আমরা লাভ করেছিলাম ফারসি ভাষার মাধ্যমে। ফারসি ভাষার মাধ্যমে আমরা অনেক আরবি শব্দ লাভ করেছি। খুদা তার মধ্যে একটি। শব্দটি বিশেষভাবে প্রচলিত হয় মুঘল আমলে। প্রায় ৭০০ বছর ধরে আমাদের দেশের রাজকার্যের ভাষা ছিল ফারসি। আমাদের ধর্মের ভাষা ছিল এবং আছে আরবি। কিন্তু আমরা ধর্মচর্চা করেছি প্রধানত ফারসি ভাষারই সাহায্যে। নামাজ, বেহেস্ত, দোজখ, ফেরেশতা, পয়গম্বারÑ এসব শব্দ আরবি ভাষার নয়, ফারসি ভাষার। এখন আমরা আল্লাহ হাফেজ বলছি, কিন্তু ইরান আবার নিকট ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছে একটি শক্তিশালী দেশ। আমরা তাই আবার কেবল আল্লাহ হাফেজ না বলে, খোদা হাফেজও বলতে পারি। বিষয়টি কোনো ধর্মীয় ব্যাপার নয়; শিষ্টাচার মাত্র। বাংলাদেশও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চাচ্ছে। বাংলা ভাষাও শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে রাখতে পারে তার আপন অবদান। হয়তো দেখা যাবে আমরা আল্লাহ হাফেজ অথবা খোদা হাফেজ না বলে বাংলা ভাষাতে বলতে যাচ্ছি নিজেদের মতো করে কোনো কিছু। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, হিন্দুরা অনেক দেবতার মূর্তি গড়ে পূজা করেন। কিন্তু ভগবানের মূর্তি গড়ে পূজা করেন না। হতে পারে, এটা তাদের ওপর ইসলামের প্রভাবেই হতে পেরেছে। এই উপমহাদেশে ইসলামের প্রভাবে উদ্ভব হতে পেরেছে শিখ ধর্মের। নিরাকার এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী শিখদের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না ভারতের হিন্দুদের। শিখরা এখন দাবি করছে, শিখদের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র। নরেন্দ্র মোদি যোগব্যায়াম করে এটাকে কত দূর ঠেকাতে পারবেন সেটা একটা জল্পনারই বিষয়। আগাচৌ বলছেন, মুসলমানেরা হয়ে উঠছে মৌলবাদী। কিন্তু শিখরাও কি মৌলবাদী হয়ে উঠেছেন? আগাচৌ ইসলাম সম্পর্কে নানা ওলটপালট কথা বলে ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রশংসা কুড়ালেও কুড়াতে পারেন কিন্তু ভারত একের পর এক জড়িয়ে পড়বে নানা সমস্যায়। বিশেষ করে হিন্দুত্বের ওপর গুরুত্ব দিলে। মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় হয়ে উঠেছে খ্রিষ্টান। হিন্দুত্ব দিয়ে ভারতের অখণ্ডতাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। -
বাংলাদেশ সময়: ১৮:১৪:২৪ ৪৭০ বার পঠিত