বঙ্গনিউজ ডটকমঃ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট মামলাসহ মোট ৩৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আর এগুলোর বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বৈঠক ডেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের এসব মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে তৎপর হওয়ার তাগিদ দিয়েছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম. আসলাম আলম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাগুলোর অবস্থা খুব খারাপ এবং বিষয়টি আমাদের হাতে নয়।’
সচিব আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, মামলার সংখ্যা আরও বেশি হবে। ব্যাংকগুলোকে হালনাগাদ তথ্য দিতে বলা হয়েছে।’
এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে উচ্চ আদালতে ছয়টি বেঞ্চ থাকলেও এগুলোতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মামলাগুলোই প্রাধান্য পেয়ে থাকে বলে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরাও তা স্বীকার করেন।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত মামলা নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতে দুটি বেঞ্চের প্রয়োজন বোধ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরাসরি কোনো আবেদনের সুযোগ না থাকায় অর্থ মন্ত্রণালয় এ জন্য বারবারই আইন মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হচ্ছে।
সর্বশেষ তিন মাস আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে এ ব্যাপারে একটি চিঠি (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। কিন্তু এখনো এর কোনো ফলাফল দেখা যায়নি।
যোগাযোগ করা হলে আইনমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠন নিতান্তই আদালতের বিষয়।’
আইনমন্ত্রী হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভূমিকা বলতে আমি আগে একবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত মামলা নিস্পত্তির জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি বিচার বিভাগের নজরে এনেছিলাম, আবারও আনতে পারি।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের রিট মামলাগুলোর শুনানিতে ব্যাংকের দিক থেকে গাফিলতি রয়েছে। এসব মামলার শুনানিতে অনেক সময় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত থাকেন না। ফলে ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবীরা ঠিকমতো মামলা পরিচালনা করছেন কি না, তা-ও বোঝার উপায় থাকে না। ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ব্যাংকের একশ্রেণির প্যানেল আইনজীবীর যোগসাজশেরও অভিযোগ রয়েছে।
যেসব প্যানেল আইনজীবী ভালোভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারছেন না, তাঁদের পরিবর্তে নতুন আইনজীবী নিয়োগ দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব।
কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলা পরিচালনার জন্য ব্যাংকগুলো দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারে না। কারণ, এ বিষয়ে তাঁদের অত বাজেট নেই। আবার বাজেট বাড়ানো হবে কি না, সে বিষয়ে সরকারেরও কোনো নির্দেশনা নেই।
তবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ চাইলে বড় আইনজীবীদের নিয়োগ দিতে পারে। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেইস-টু-কেইস ভিত্তিতে বড় আইনজীবীদের নিয়োগ দিতে কোনো বাধা নেই, আমরা তা দিয়েও থাকি।’
সম্প্রতি সচিবালয়ে আসলাম আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৭টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলা-সংক্রান্ত কার্যক্রমের একটি চিত্র উপস্থাপন করা হয়। মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে অর্থঋণ ও দেওয়ানি আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে।
বৈঠকে জানানো হয়, ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার ২৫০টি রিট মামলা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি টাকা জড়িত কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার (সিআইবি) সম্পর্কিত রিট মামলায়। এ বিষয়ে থাকা ৯৫৭টি মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ২৮ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।
অর্থঋণ-সংক্রান্ত রিট মামলা রয়েছে ২ হাজার ২২৯টি। এই শ্রেণিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। এ দুই শ্রেণির বাইরে ‘অন্যান্য রিট মামলা’ নামে আরেকটি শ্রেণি করা হয়েছে। এই শ্রেণিতে মামলা রয়েছে ১ হাজার ৬৪টি এবং অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৩৫ হাজার মামলার মধ্যে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরেই হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৬টি মামলা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৩৭টি মামলা হয়েছে ২০১৩ সালে। অন্য বছরগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে ৫ হাজার ৬৮৫টি, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৫৮৫টি, ২০১২ সালে ৫ হাজার ৭১৫টি এবং ২০১৪ সালে ৬ হাজার ২৪৫টি মামলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলা সোনালী ব্যাংকের।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতে আলাদা বেঞ্চ গঠন জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, ব্যাংকের সাধারণ মামলা পরিচালনায় অত বড় আইনজীবীর দরকার পড়ে না। কারণ মামলাগুলো অত জটিল প্রকৃতির নয়। প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রমাণাদি থাকে বলে এগুলোতে ব্যাংকের হারারও কথা নয়।
তবে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে ভালো আইনজীবীর দরকার পড়ে বলে মত দেন ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, বড় আইনজীবীর চেয়েও দরকার ভালো আইনজীবী। যাঁরা বয়সে তরুণ, জিনিসগুলো বোঝেন, কিন্তু অতটা নামডাক নেই, তাঁদের দিয়েই ব্যাংকের মামলা পরিচালনা করা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৩০:৫৩ ৩১৩ বার পঠিত