নিখোঁজ

Home Page » সাহিত্য » নিখোঁজ
শুক্রবার, ৩১ জুলাই ২০১৫



বঙ্গনিউজ ডটকমঃছবিজনের মাথাটা খারাপই হয়ে যাবে। আজ সকাল থেকে আদরীকে পাওয়া যাচ্ছে না। আদরী তার একমাত্র মেয়ে। মাটিতে উপুড় হয়ে বিলাপ করে ছবিজন। গতকাল মা-মেয়েতে তারা শুরী জসমতের বাড়িতে কাজ করেছে। বাড়ি ফিরেছিল সন্ধ্যার কিছু আগে। নলকূপে গোসল করে কলসি ভরে পানি এনেছিল আদরী। কিছুু দিন থেকে ছবিজনের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পয়লা শীতের হাওয়া লেগে বুকে সর্দি জমেছে। রাত হলে জ্বরে বিষে দেহ অচল হয়ে পড়ে। চোখে পানি ছিটিয়ে উনুনে ভাত চেপে দিয়েছিল সে। কাজ থেকে ফেরার পথে গোটা চারেক বেগুন দিয়েছিল নন্দিয়া সম্পর্কের এক লোক। সেই বেগুন সে আগুনের ভেতর খুসে দিয়েছিল। সেই ভাত আর নতুন বেগুনের ভর্তা খেয়ে খুব ঘুম এসেছিল তার চোখে। অন্য দিন তো চোখে ঘুমই আসে না তার। রাজ্যের সব কুচিন্তা এসে মাথায় জমা হয়। সকালে জেগে ছবিজন দেখে বিছানা খালি পড়ে আছে। ঘরদরজা কাইনচা খুলি কোথাও আদরীর দেহের গন্ধ নেই।
শেষ সম্বলটুকু খরচ করে আদরীকে বিয়ে দিয়েছিল সে। কপালের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! বিয়ে হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সাপের দংশনে আদরীর স্বামী মারা যায়। এখন আদরী তার বোঝা। যুবতী মেয়েকে খালি বাড়িতে রাখাও যায় না, সাথে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বেড়ানোও চলে না। ছবিজন সব বুঝতে পারে। মেয়ে তার কোমলমতি। বাঁধন ছিড়ে বারবার ছুটে যেতে চায়। 
আদুরীকে খুঁজতে কোথায় যাবে ছবিজন। এসব কথা কাউকে তো বলাও যায় না। ভরা গ্রামের ব্যাপার। হুট করে জানাজানি হলে বিপদ। আদরীর বাপ বেঁচে থাকলে এই নিদানে তাকে পড়তে হতো না। একখানে না একখানে মেয়ের একটা হিল্লা করত সে। 
স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ বছরের মাথায় নদীর ভাঙনে জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় ছবিজন। আগুনে পুড়ে গেলে সংসার নতুন করে গোছান যায়। কিন্তু নদীর সর্বগ্রাসী স্রোতে সব কিছু ধুয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না। 
ছবিজন ভেবে পায় না কার হাত ধরে বাড়ি ছাড়ল আদুরী। এতটা সাহস তার হলো কী করে। কিছু দিন থেকে ওর মধ্যে একটা ছটফট ভাব লক্ষ করেছে ছবিজন। বারবার সে নলকূপের পাড়ে যায় হাত-মুখ ধুতে। সেদিন নদীতে গোসল করতে যেয়ে এক পওর বেলা নষ্ট করে বেয়াড়া ভাব নিয়ে সে বাড়ি ফিরেছে। রাতে বারবার বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। কোনো কথা বললে মুখে মুখে জবাব দেয়। একটা কামচোর বাজে ছেলেকে ক’দিন থেকে বাড়ির আশপাশে ঘুরতে দেখেছে ছবিজন। একদিন আদুরীকে চোখ টিপে তার সাথে কথা বলতে দেখে মাথায় খুন চাপে ছবিজনের।
দেখলে ছেলেটাকে চিনবে ছবিজন। অসুরের চটার মতো মুখ। চামছিলা বাদিয়ারের মতো হাবভাব। গায়ে বলদের চামড়ার মতো খাটো নালটি ফতুয়া। জদ্দা খাওয়া কালাকষ্টা দাঁত। বাচ্চাচোরা বেজির মতো পিটির পিটির চউক। তাহলে কি ওই বেধর্মা বেহুদ্দার সাংনা হয়ে ঘর ছেড়েছে আদুরী। মাথার চুল ছিঁড়ে ছিল্লিয়া হয়ে অনুচ্চ শব্দে বিলাপ করে ছবিজন। ‘কোন আয়োটি ইপুজির পুত পত্তিদিন মোর কাইনচা শুঙবার আইসে। মোর স¹ের চাঁদ আদুরীর গুয়ের কী এতয় সোয়াদ! এই নিপুত্রীর কইলজাত যাঁয় হান দিচে, বশ্শীর কওয়াল দিয়া আল্লায় তারও চউক খুকরি বেইর কইরবে। গইটারু মুন্সীর ব্যাটা, তুই মোর এত সমান দুশ্পনি কল্লু। শিলের নোড়া দিয়া থ্যাত্লে মোক বুকশিলা নাগালু।’
গভীর রাতে আদুরীকে খুঁজতে বের হয় ছবিজন। চার দিকে খলবলে জোছনা। আকাশে দাঁড়িয়ে আছে গইটারু মুন্সীর ছেলের মতো চাঁদ। একবার তার মন বলে,‘যাক! কী হবে খুঁজে। যার কপাল নিয়ে সে গেছে। ছেঁড়া আঁচলে আর কত দিন বেয়াড়া বয়স বেঁধে রাখবে।’ 
এই ঘরছাড়া কপালপুড়িকে কোন দিকে খুঁজতে যাবে সে। বাড়ি থেকে বের হয়ে নদীর পাড় ধরে খাড়া দক্ষিণে হাঁটতে থাকে সে। তার বাড়ি এখন নদীর কাছাড়ে পড়েছে। সব কিছু তছনছ করে নদী এখন পশ্চিম দিকে সরে গেছে। দিনরাত কত মানুষ নদীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে যায়। কত ভাটির নৌকা আর গুনটানা উজানী নৌকা চলে। জোছনায় পথ চিনে একা একা অনেক দূর যায় ছবিজন। এ দিকে সে কত দিন আসেনি! নদী শুরুতে যেমন ভাঙন শুরু করেছিল শেষের দিকে তেমন একটা ভাঙেনি। শুধু তার জমিগুলোই নদীর পেটে চলে গেছে। কেচমত হাজীর খয়ার বন আর টনদ্দি ঘটকের বাঁশঝাড় ছেড়ে ভয়তড়াস ভুলে আরো দূরে যায় সে। এ দিকে মানুষ নতুন পলিতে মিষ্টি আলু আর বাঙ্গির আবাদ করেছে। খেত পাহারার ছোট ঘরগুলোতে কান পাতে ছবিজন। বিঘাকে বিঘা বাদামের আবাদ হয়েছে খৈমুদ্দি চৌকিদারের জোতে। কাউয়া হোসেনের ভইসবাতান পার হয়ে কাজিয়ার দোলার পাড়ে গইটারু মুন্সীর বাড়ি। মুন্সী বড় জামাতের ইমাম। তার বেটা নূর হোসেন না নূরজামাল। বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছবিজন। এই সব কথা কি পরখাকু হাড্ডিচোষা মুন্সীকে বলা যাবে? সমাজ জামাতে মিলাদ পড়ে বেড়ায়। তার ছেলে যে বেশরা বান্দোর, তা তো কেউ বিশ্বাস করবে না।
মুন্সীর বাড়ির পূর্ব দিকে তিন কিতা জমি পার হয়ে বাচ্চু মেম্বারের বাড়ি। জাগলি ফয়েজের ছাড়ানি বউয়ের আড়–য়া বেটা থোতলা বাচ্চু এখন পরিষদের মেম্বর। একটা দুস্থমাতার কার্ডের জন্য দুই দিন গিয়েছিল ছবিজন ওর কাছে। আয়-উন্নতির খবর নাই দুই বউয়ের নাটাই। ছবিজনকে সে বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে বলেছিল। জাগুল থাগুল বাড়ি। কার্ড দেয়ার নাম নেই, আড়ালে ডেকে নিয়ে অন্য কথা বলে।
এই বেশরম বাচ্চু মেম্বর গোপনে কোনো চক্রান্ত করল কি না কে জানে। যদি ওরা আদুরীকে কৌশলে বশ করে কোথাও আটক করে রাখে তাহলে কেমন করে খুঁজে বার করবে সে। এরাই তো সমাজের গণ্যমান্য লোক। কার কাছে নালিশ করবে ছবিজন এদের বিরুদ্ধে। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে বিচার চাওয়ার জায়গা তো তার নেই। এ দিকে নদী বিস্তর জমি পেট থেকে বের করে দিয়েছে। তা দেখে ছবিজন ব্যাকুল হয়। তার জমি নদী উগড়ে দেবে কি না নিয়তিই জানে। নদীর পাড়ে বসে চোখের জলে বুক ভাসায় সে। দখলবাজ মণ্ডলের মতো সব কিছু কব্জা করে নদী চলছে আপন গতিতে। চৈকালঘাটে খেউনিরা খোঁটায় নৌকা বেঁধে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। শুকনা মাটিতে বসে কাঁপতে লাগল ছবিজন। তার পা দুটো ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে গেছে। এক বিঘৎ পথ হাঁটার শক্তি তার নেই। বালুচরে এবং দূরের বাঁশঝাড়ে পাখিরা শেষ প্রহরের গা ঝাড়া দেয়। পুবের আকাশ ঝাঁকি দিলে ফর্সা আলো ছড়ায় মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূর্য। একসময় হালকা কুয়াশার জাল সরিয়ে বেহুলা সুন্দরীর টুকটুকে ঠোঁটের মতো রক্তিম সূর্যটা পুবের আকাশে জেগে ওঠে। নদীর পাড়ে বসে থেকে কী লাভ। একটা ন্যাকড়ার পোটলার মতো গড়াতে গড়াতে চোখের পানিতে পথের ধুলা সিক্ত করে ছবিজন ঘরে ফিরে আসে। মুখ ফুটে একটি কথাও সে কাউকে বলে না। তবুও রাতারাতি সবাই জেনে যায় আদুরীর নিখোঁজ সংবাদ। -

বাংলাদেশ সময়: ২০:৪৫:৩৯   ৩৯৪ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ