বঙ্গনিউজ ডটকমঃমুসলমানেরা রমজানে শয়তান থেকে দূরে সরে থাকে, অথচ ইরানিরা রমজানুল মুবারকের শেষ ও বরকতময় দশকে বড় শয়তানের সাথে নতুন চুক্তি করেছে। অস্ট্রিয়ার শহর ভিয়েনায়, ১৪ জুলাই ইরান আমেরিকাসহ ছয় বিশ্বশক্তিকে আশ্বাস দিয়েছে যে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না এবং নিজেদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো জাতিসঙ্ঘের পরিদর্শনের জন্য খুলে দেবে। যার ফলে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির মধ্যে চুক্তি স্বারিত হওয়ার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বিজয়দৃপ্ত বক্তব্য গোটা বিশ্ব, এমনকি ইরানেও শোনা যায়। যার সমাপ্তি ঘটে এ বাক্যের মাধ্যমেÑ ঈশ্বর আমেরিকার ওপর অনুগ্রহ বর্ষণ করতে থাকুন। এ চুক্তিকে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই স্বাগত জানিয়েছে। ইরানিরা তো আনন্দে রাস্তায় বের হয়ে এসেছে। তারা ভুলে গেছে, ইরান বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি আমেরিকাকে ‘শয়তানে বুজুর্গ’ বা ‘বড় শয়তান’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ইরানিদের একটা জেনারেশন ‘মার্গ বার আমেরিকা’ (আমেরিকা ধ্বংস হোক, নিপাত যাক) স্লেøাগান দিতে দিতে কবরে চলে গেছে। এর পরের জেনারেশন ‘মার্গ বার আমেরিকা’ (আমেরিকা ধ্বংস হোক, নিপাত যাক) স্লেøাগান দিতে দিতে চুল সাদা করে ফেলেছে। আর তার পরের জেনারেশন আমেরিকাকে আলিঙ্গন করার জন্য অস্থির। তরুণ ইরানিরা এ চুক্তিকে নিজেদের জন্য রহমত মনে করছে। আর ইসরাইল এ চুক্তিটিকে নিজেদের জন্য বিপদ মনে করছে। ইসরাইলের কষ্ট পাওয়া দেখে এ কথা বুঝে আসে যে, উল্লিখিত চুক্তিতে শুধু আমেরিকা নয়, ইরানেরও জয় হয়েছে। ইরানসহ যেকোনো দেশের সঙ্কীর্ণতার কারণে স্থায়ী দাদাগিরিতে আটকে থাকা ইসরাইলের জন্য লাভজনক। জায়নবাদী লবি চেয়েছিল, ইরানিরা ‘মার্গ বার আমেরিকা’ (আমেরিকা ধ্বংস হোক, নিপাত যাক) স্লেøাগান দিয়ে যাক, যাতে ইরান ও আমেরিকার লড়াই থেকে ইসরাইল ফায়দা নিতে পারে। ইরান তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পারমাণবিক কর্মসূচি সীমাবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চুক্তি স্বারিত হয়েছে, কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন এক বড় চ্যালেঞ্জ। কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, এ চুক্তিটি বাঘের সম্মতিতে বাঘের দাঁত তুলে ফেলার মতো। যখন বাঘের দাঁত তুলে ফেলা হয়, তখন তার ওপর কুকুরও চড়াও হয়। এ দায়িত্ব বিশ্বশক্তির, তারা ইসরাইলকে ইরানের ওপর আক্রমণোদ্যত হওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখবে। কিন্তু ইতিহাসে নজর বুলালেই দেখা যায়, বিশ্বশক্তির প্রতিশ্র“তির ওপর ভরসা করা গজবের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
বেশি দূর যেতে হবে না। ১৯৭৬-এর মার্চে অস্ট্রিয়ার এ ভিয়েনা শহরেই ব্যাপক তর্কবিতর্কের পর ফ্রান্স ও পাকিস্তানের মধ্যে নিউকিয়ার রিপ্রসেসিং প্লান্ট-এর চুক্তি স্বারিত হয়েছিল এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এ চুক্তিকে অনুমোদন দিয়েছিল। কমিশনে উপস্থিত মার্কিন প্রতিনিধিও এ চুক্তির সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু কিছু দিন পর আমেরিকা এ চুক্তির বিরোধিতা শুরু করে দেয়। ১৯৭৬ সালের আগস্টে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বলেন, তিনি যেন পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে বিরত থাকেন। নতুবা তাকে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ বানানো হবে। ভুট্টো আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকারে অস্বীকৃতি জানান। তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার নাক গলানোর প্রমাণাদি একত্র করেন এবং ১৯৭৭ সালের জুনে লিবিয়ায় ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কনফারেন্সে বিলি করে দেন। যার পরে ওই কনফারেন্স পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত হস্তেেপর বিরুদ্ধে প্রস্তাব অনুমোদন করে। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার নীরব সমর্থনে জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টো সরকারের গদি উল্টিয়ে দেন। এরপর পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতিষ্ঠাতাকে পাকিস্তানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। ইরানের কাছে ভুট্টো নেই, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে রা করবেন। ভুট্টোর সফলতা হলো, তিনি পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য ইরান ও সৌদি আরবসহ সব মুসলিম দেশের সমর্থন অর্জন করেছিলেন। অথচ ইরানের নেতারা অনেক মুসলিম দেশকেই নিজেদের শত্র“ বানিয়ে রেখেছেন। ভুট্টোর মৃত্যুর পর ফ্রান্স পাকিস্তানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি রহিত করে দেয়। তবে এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না যে, জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো সত্ত্বেও পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে শক্তিশালী করেন, পেছনে ফিরে যাননি। ভুট্টো সাহেবের বাছাইকৃত ড. আব্দুল কাদের খানের মাধ্যমে পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। ড. আব্দুল কাদের খান ছাড়া অন্যান্য বিজ্ঞানীও পাকিস্তানকে একটি পারমাণবিক শক্তিতে পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে পারমাণবিক জ্বালানি তৈরির কৃতিত্ব ড. আব্দুল কাদেরকেই দেয়া হয়। এ কারণেই জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সময়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ড. আব্দুল কাদেরকেও দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ বানিয়ে দেয়। ইতিহাসে এ বদনাম শুধু পাকিস্তানিদের ভাগ্যেই রয়েছে যে, যে প্রধানমন্ত্রী পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করলেন, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, যে প্রধানমন্ত্রী পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন, তাকে দেশান্তরিত করা হয়েছিল, আর যে বিজ্ঞানী কাহুটা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে পারমাণবিক জ্বালানি ও মিসাইল তৈরি করলেন, তাকে চোর বানিয়ে টিভিতে উপস্থাপন করা হলো।
আল্লাহর লাঠির আওয়াজ নেই। পারভেজ মোশাররফ তার শাসনামলে ড. আব্দুল কাদের খানকে যে অবস্থার মুখোমুখি করেছিলেন, আজ মোশাররফও ওই অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, ড. আব্দুল কাদেরের সাথে দেখা-সাাতে কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, আর মোশাররফ যখন ইচ্ছা তার পছন্দের কোনো টিভি রিপোর্টারের হাতে নিজের পছন্দমতো প্রশ্ন ধরিয়ে দিয়ে নামসর্বস্ব সাাৎকার দিতে পারেন। আজ পর্যন্ত কোনো টিভি রিপোর্টার তাকে এটা জিজ্ঞাসা করেননি যে, আপনি ড. আব্দুল কাদেরের ওপর ইরান ও লিবিয়াকে পারমাণবিক সূত্র পাচারের অপবাদ দিয়েছিলেন; কিন্তু আপনি কার কাছে জিজ্ঞাসা করে পাকিস্তানের সেনা ক্যাম্প বিদেশী শক্তিকে দিয়েছিলেন? এখন তো কাশ্মিরি নেতা সাইয়েদ আলী গিলানিও স্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পারভেজ মুশাররফ তার শাসনামলে হুররিয়্যাত কনফারেন্সের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বলেছিলেন, আমরা যেন কাশ্মির সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে যাই। এ ধরনের দাবি কোনো রাজনীতিবিদের প থেকে বলা হলে, এখন পর্যন্ত মিডিয়ায় তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হতো। আর বক্তব্যটি যখন একজন স্বৈরাচার সেনা শাসকের প থেকে বলা হয়েছে, তখন বন্ধুভাবাপন্ন অভিজ্ঞ টিভি রিপোর্টার তার সামনে ভেজা বিড়াল হয়ে বসে পড়েন। তাকে এটা জিজ্ঞাসাও করেন না যে, আজকাল শহরে শহরে এম কিউ এম-এর নেতা আলতাফ হোসাইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এফআইআর বাতিলের আকাক্সা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আপনার ওপর যখন আইনিভাবে গাদ্দারির মামলা হলো, তখন ওই বিদ্রোহী আলতাফ হোসাইনের কাছে সাহায্য চাইলেন কেন? গাদ্দারির মামলায় আপনার পে লড়াইরত দু’জন গুরুত্বপূর্ণ উকিল ফুরুগ নাসীম ও মুহাম্মদ আলী সাইফ এমকিউএমের সিনেটর। আপনি তাদের সহায়তা ফেরতের ঘোষণা কেন করছেন না? মোট কথা, আলতাফ হোসাইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের যত বেশি মামলা তৈরি হবে, পাকিস্তানে বিতর্ক তত বেশি দীর্ঘ হবে। অলিগলিতে মানুষ জিজ্ঞাসা করবে, গাদ্দার ও শয়তান শুধু রাজনীতিবিদেরা কেন হয়? পাকিস্তানের সেনা ক্যাম্প বিদেশী শক্তিকে দেয়া আর বিদেশী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কোটি কোটি ডলার দিয়ে ভরে ফেলা কেমন ধরনের দেশপ্রেম?
মনে রাখবেন, শয়তান শুধু রাজনৈতিকই নয়, বরং অরাজনৈতিকও হয়। রাজনৈতিক শয়তানদের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত, তবে অরাজনৈতিক শয়তানদের কেন নয়? শয়তানদের সাথে চুক্তি ইরানে হোক কিংবা পাকিস্তানে হোক, মুসলমানদের সতর্ক থাকা উচিত। শয়তানের কাছ থেকে মঙ্গলের কোনো আশা না করাই ভালো। হয় সব শয়তানের সাথে সমঝোতা করা হোক, নয়তো সবার খোঁজখবর নেয়া হোক। তোমার শয়তান খারাপ, আর আমার শয়তান ভালোÑ এমন নীতি এখন পাকিস্তানে চলতে পারে না। বিচার যখন হবে, সবারই বিচার হবে। রাজনৈতিক শয়তানেরও, অরাজনৈতিক শয়তানেরও। যখন হবে না, তো কারোই হবে না। এক শয়তানের সাথে যুদ্ধ আর অপর শয়তানের সাথে চুক্তি মুসলমানদের উপকার নয়, বরং তি হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০:৪১:৫১ ৩২৬ বার পঠিত