বঙ্গনিউজ ডটকমঃরোমান হলিডে’র কাহিনি কল্পনাপ্রসূত হলেও বিশ্বের সর্বকালের সেরা অভিনেতাদের মধ্যে একজন গ্রেগরি পেকের জীবনে ঘটেছিল অনেকটা এমন ঘটনাই। ১৯৫২ সালে প্যারিসে ভেরোনি প্যাসানি নামে এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হয় গ্রেগরি পেকের। তখন তিনি নায়ক হিসেবে বেশ খ্যাতিমান। সাক্ষাৎকার দেওয়ার সূত্রে পরিচয়, সেই পরিচয় প্রণয়ে রূপ নেয়। ১৯৫৫ সালে বিয়ে করেন তারা। এবং গ্রেগরি পেক তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভেরোনিকের সঙ্গেই ছিলেন।
‘টু কিল এ মকিং বার্ড’, ‘স্পেল বাউন্ড’, ‘ডুয়েল ইন দ্য সান’, ‘মবি ডিক’, ‘দ্য গানস অফ নাভারন’, ‘দ্য ইয়ারলিং’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমায় তার অভিনয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের সম্পদ।
গ্রেগরি পেকের জন্ম ১৯১৬ সালের ৫ এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে। পুরো নাম এলড্রেড গ্রেগরি পেক। বাবা গ্রেগরি পার্ল পেক ছিলেন কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্ট। মায়ের নাম ছিল বার্নিস মেরি। রোমান ক্যাথলিক হলেও পরিবারে ধর্মীয় গোঁড়ামি তেমন ছিল না। পেকের বয়স যখন ছ’বছর তখন তার বাবা মায়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়। নানীর কাছে কাটে তার শৈশব। সেন্ট জনস মিলিটারি একাডেমি নামে একটি ক্যাথলিক মিলিটারি স্কুলে দশ বছর বয়সে ভর্তি হন তিনি। সে সময় নানীর মৃত্যু হলে বাবা তার দেখাশোনার ভার নেন। ১৪ বছর বয়সে পেক ভর্তি হন স্যান ডিয়েগো হাই স্কুলে। এখান থেকে পাস করার পর স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন লেখাপড়া করেন এবং পরে বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। এই সময়ই তার অভিনয়ের হাতেখড়ি। থিয়েটার কোর্স করেন তিনি সেসময়। এরপর একটি তেল কোম্পানিতে ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। বার্কলেতে পড়ার পাশাপাশি কাজ করতে হতো তাকে। টিউশন ফি এবং নিজের জীবনযাত্রার খরচ চালানোর জন্য বেশ পরিশ্রম করতেন। বার্কলের অভিনয় প্রশিক্ষকের নজরে পড়েন তিনি। তার মধ্যে প্রতিভার পরিচয় পেয়ে প্রশিক্ষক তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যদলে নেন। সে সময় তিনি পাঁচটি নাটকে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা পান এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন।
ইংরেজিতে স্নাতক হওয়ার পর তিনি পাড়ি জমান নিউ ইয়র্কে। কারণ মঞ্চনাটকের কেন্দ্রভূমি হল নিউইয়র্ক। সেখানে পেক অভিনয়ের তালিম নেন বিখ্যাত নাট্যশিক্ষক স্যানফোর্ড মেইসনারের কাছে।
সেদিনগুলোতে তরুণ পেককে অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয়েছে ভীষণ। কখনও কখনও তাকে খাবারের বিনিময়ে কাজ করতে হতো। কখনও মাথার উপর ছাদটুকুও থাকতো না। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে রাতে ঘুমিয়েছেন অনেক দিন। তবে কষ্টের পর সাফল্যের মুখ দেখতে খুব বেশি দেরি হয়নি। মঞ্চনাটকে তিনি সুযোগ পান। এবং তার অভিনয় প্রশংসিত হয়।
এদিকে ইউরোপে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজেছে। ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে বোমা ফেলে জাপান। আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে বিশ্বযুদ্ধে।
যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যেও পেক অভিনয়ে জনপ্রিয়তা পান বিশেষ করে যুদ্ধাহত সৈনিকদের মধ্যে। ব্রডওয়েতে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
গ্রেগরি পেকের প্রথম ছবি ‘ডেইজ অব গ্লোরি’ মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালে। প্রথম ছবিতেই নিজের জাত চিনিয়ে দেন এই অভিনেতা। পর পর মুক্তি পায় ‘দ্য কিজ অব দ্য কিংডম’(১৯৪৪), ‘দ্য ইয়ারলিং’(১৯৪৬), ‘জেনটেলম্যান’স এ্যাগ্রিমেন্ট’(১৯৪৭) এবং ‘টুয়েলভ’ও ক্লক হাই’(১৯৪৯)। চারটি ছবির জন্যই অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান তিনি।
পুলিৎজারজয়ী লেখক মারজোরি কিনান রলিংসের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘দ্য ইয়ারলিং’ ছবিতে কৃষক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পান পেক।
১৯৪৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আলফ্রেড হিচককের ‘স্পেলবাউন্ড’ ছবিতে একজন স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যক্তির চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন তিনি। পরবর্তিতে উত্তমকুমার যখন ‘হারানো সুর’ ছবিতে স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেন তখন ‘স্পেল বাউন্ড’-এ গ্রেগরি পেকের অভিনয়কে অনুসরণ করেন বলে স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন।
‘স্পেল বাউন্ড ছবিতে গ্রেগরি পেকের বিপরীতে ছিলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান, হলিউডের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী। এই ছবিতে অভিনয়ের সময় পরস্পরের প্রেমে পড়েছিলেন তারা। ১৯৮৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে পেক স্বীকার করেন যে সুন্দরী ও তরুণী ইনগ্রিড বার্গম্যানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। যদিও সে সময় পেক ছিলেন বিবাহিত। ১৯৪২ সালে ২৬ বছর বয়সে পেক বিয়ে করেন গ্রেটা কুকোনেনকে। সে বিয়ে অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। অসুখী দাম্পত্য শেষে ১৯৫৫ সালে তাদের ডিভোর্স হয়।
‘স্পেল বাউন্ড’ তাকে প্রভূত খ্যাতি এনে দেয়। ‘ডুয়েল ইন দ্য সান’(১৯৪৬) ছবিতে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন পেক। এই ছবিতে এজন আবেগপ্রবণ, নিষ্ঠুর কাউবয়ের চরিত্রে তার শক্তিশালী অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। পেক এবং জেনিফার জোনসের পর্দা রসায়নও ছিল অসাধারণ।
১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘রোমান হলিডে’ সর্বকালের অন্যতম সেরা রোমান্টিক ছবি। এ ছবিতে অভিনয় করে অড্রে হেপবার্ন অস্কার পেয়েছিলেন। এই ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে পেক এবং হেপবার্নের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যা সারা জীবন স্থায়ী হয়েছিল।
‘দ্য গানফাইটার’(১৯৫০), ‘দ্য বিগ কান্ট্রি’(১৯৫৮), ‘মবি ডিক’(১৯৫৬), ‘দ্য গানস অব নাভারন’(১৯৬১)সহ অনেকগুলো ছবিই তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ‘মবি ডিক’ এর প্রতিশোধপরায়ন নাবিক, ‘দ্য গানস অব নাভারনে’র লড়াকু সৈনিক, ‘গান ফাইটার’- এর ওয়েস্টার্ন কাউবয় সব চরিত্রেই তার পুরুষালী অবয়ব ও অসাধারণ অভিনয় তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়।
১৯৬২ সালে মুক্তি পায় ‘টু কিল এ মকিং বার্ড’। হারপার লির বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমাটি শুধু পেকের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ছবিই নয়, এটি হলিউডেরও অন্যতম সেরা নির্মাণ। ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের স্বরূপ তুলে ধরে এর কাহিনি। শ্বেতাঙ্গ মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত এক কৃষ্ণাঙ্গের পক্ষে নিবেদিত আইনজীবীর চরিত্রে অভিনয় করেন পেক। অ্যাটিকাস ফিঞ্চ জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ান ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। এই লড়াইতে ঝুঁকির মুখে পড়ে তার মাতৃহীন দুই শিশু সন্তানের নিরাপত্তা। অ্যাটিকাস ফিঞ্চের চরিত্রে পেক যে অসামান্য অভিনয় করেন তা আজও বিশ্বচলচ্চিত্রের সম্পদ। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার অস্কার জিতে নেন পেক। ২০০৩ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট আ্যাটিকাস ফিঞ্চ চরিত্রকে শত বছরের সেরা চলচ্চিত্র নায়ক বলে অভিহিত করে। অনেক পরে এক টিভি সাক্ষাৎকারে পেক বলেছিলেন ফিঞ্চ তার প্রিয় চরিত্র। কারণ এর মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব মানবতাবাদী দর্শন প্রতিফলিত হয়েছিল। এই চরিত্রের মধ্যে তিনি নিজের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।
পৌরুষদীপ্ত অবয়ব, গভীর কণ্ঠস্বর এবং শক্তিশালী অভিনয় তাকে হলিউডের সর্বকালের সেরা নায়কদের অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তার শারিরীক শক্তিও ছিল প্রচণ্ড। অ্যাকশন দৃশ্যে তিনি কোনো স্টান্ট ব্যবহার করতেন না। তার সহঅভিনেতা ও ঘনিষ্ট বন্ধু রবার্ট মিচাম এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন ‘কেপ অফ ফিয়ার’ ছবিতে অভিনয়ের সময় মারদাঙ্গা দৃশ্যে পেক ভুলবশত তাকে একবার আঘাত করেছিলেন, সেই আঘাতের ফলে তাকে অনেকদিন কাঁধের ব্যথায় ভুগতে হয়েছিল।
‘ডেভিড অ্যান্ড বাথসেবা’র মতো পৌরাণিক ছবিতে রাজা ডেভিড, ‘বয়েজ ফ্রম ব্রাজিলে’-এর পলাতক নাৎসি, ‘ওমেন’ ছবির বিভ্রান্ত রাষ্ট্রদূত, ‘সি উলভস’-এর দুধর্ষ নাবিক অথবা ‘দ্য মিলিয়ন পাউন্ড নোটের’ গরীব থেকে ধনী বনে যাওয়া ভদ্রলোক - সব ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি, পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। অভিনয়ের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে তিনি অ্যাকাডেমির ‘জিন হারশল্ট হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড’ পান।
১৯৬৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডেন জনসন তাকে ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ সম্মাননায় ভূষিত করেন।১৯৯৬ সালে তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ক্রিস্টাল গ্লোব পুরস্কার পান। টিভি সিরিজ ‘দ্য স্কারলেট অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক’ এ ভ্যাটিকানের এক ধর্মযাজকের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পান গোল্ডেন গ্লোব।.
ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী পেক অনেক মানবতাবাদী সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন। অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থক পেক রাজনীতিতে যোগ দেননি অনেক অনুরোধেও। তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের বিশেষ বন্ধু ছিলেন।
আইরিশ বংশোদ্ভুত পেক আয়ারল্যান্ডেও অনেক সমাজসেবামূলক কাজে অর্থ দান করেছেন।
২০০৩ সালের ১২ জুন ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪১:৩০ ৩৩৫ বার পঠিত