বঙ্গনিউজ ডটকমঃ রোববারের গণভোটে গ্রিসের জনগণ পরিষ্কার যে রায় দিয়েছেন তা হলো, দেউলিয়া হয়ে পড়ার অবস্থা থেকে গ্রিসকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ লাভ করতে হলে যেসব পূর্বশর্তের উল্লেখ দাতারা করেছে, গ্রিসের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে খেলাপি হওয়ার পথে আরও একধাপ দেশটি এখন এগিয়ে গেল। গ্রিস ইতিমধ্যে নির্ধারিত সময়সীমায় ঋণের দেড় শ কোটি ডলারের একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে এবং দেশটির ভান্ডারে অর্থের ঘাটতি থেকে যাওয়ায় নতুন ঋণ না পেলে আগের কিস্তি পরিশোধ করা আবারও অসম্ভব হয়ে দেখা দেবে।
আমরা যারা ব্যাংকিং খাতের জটিল নানা রকম হিসাবপত্র নিয়ে খুব বেশি ওয়াকিবহাল নই, তাদের কাছে গ্রিসের দাবিকে সহজেই অযৌক্তিক মনে হতে পারে। ঋণ যখন গ্রিস নিয়েছে, তখন সেই ঋণ পরিশোধের দায়িত্বও দেশটির। গ্রিসও কিন্তু ঠিক সে কথাই বলছে। গ্রিসের সরকার বলছে না যে ঋণ এথেন্স পরিশোধ করবে না। তবে গ্রিসের দাবি হলো, ঋণের পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা দরকার এবং এ রকম একটি ঋণ পরিশোধব্যবস্থা ঠিক করে নেওয়া উচিত, যেটা কিনা ঋণ পরিশোধের নামে নাগরিক জীবনকে আরও বেশি অসহনীয় করে তুলবে না।
গ্রিসের কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের জমা হওয়া ঋণের মোট পরিমাণ হচ্ছে ২৪ হাজার কোটি ইউরো। ২০০৮ সালে গ্রিস প্রথমবারের মতো আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হওয়ার পর সংকট উত্তরণে দুই দফায় গ্রিসকে দেওয়া বিশাল অঙ্কের ঋণ জমা হয়ে এমন এক ঋণের ফাঁদ এখন গ্রিসের জন্য সেটা তৈরি করে দিয়েছে, যা থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথ দেশটির সামনে খোলা রাখা হয়নি। আগের দুই দফার ঋণ অবশ্যই শর্তহীন ছিল না। ঋণ পাওয়ার জন্য দেশটিকে যেসব শর্ত হজম করে নিতে হয়, তার মধ্যে ঋণদাতাদের অত্যন্ত পছন্দনীয় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় সংকোচন এবং বৃদ্ধদের পেনশন ভাতা হ্রাস অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঋণদাতারা এসব শর্ত ঋণ গ্রহণকারী দেশের উপকারের কথা বিবেচনা করে নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ বিবেচনা করেই আরোপ করে থাকে। যুক্তি এখানে হচ্ছে এ রকম যে সরকারের খরচ কমিয়ে আনা হলে বাড়তি যে আয় সরকারের হাতে আসবে, সেটা দিয়ে ঋণের কিস্তি সরকার পরিশোধ করতে পারবে।
অন্যদিকে আবার বিশাল অঙ্কের নতুন যে ঋণ শর্ত মেনে নেওয়া সাপেক্ষে দেওয়া হয়, তারও সিংহভাগ চলে যায় ঋণদাতাদের ব্যাংকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ। অর্থাৎ, নতুন ঋণের বড় অংশ ঋণ গ্রহণকারী দেশ চোখে দেখারও সুযোগ পায় না, দাতাদের কাছ থেকেই সেই অর্থ বরং চলে যায় দাতাদের দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে। আগের দুই কিস্তির ঋণের ৭০ শতাংশেরও বেশি এভাবেই চলে গিয়েছিল দাতা দেশগুলোর ব্যাংকে।
সরকারের ব্যয় হ্রাসের অন্য যে প্রেসক্রিপশন দাতারা দিয়ে থাকে তা হলো, সরকারের আকার ছোট করে নেওয়া। যার অর্থ অন্য কথায় সরকারি চাকরির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা। ফলে আমরা যা দেখতে পাই তা হলো, ঋণদাতাদের আরোপিত শর্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যারা হচ্ছে, তারা হলো ঋণ গ্রহণকারী দেশের প্রান্তিক জনগণ-পেনশন ভাতা কমে যাওয়া বৃদ্ধ, চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসায় বেকারত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়া তরুণ সমাজ এবং সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা থেকে বঞ্চিত সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষজন।
এসব হিসাব সামনে রেখেই জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বামপন্থী নেতা অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের রাজনৈতিক দল সিরিজা জনগণের সমর্থন পেলে ঋণের শর্তাবলি পুনর্নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি ভোটারদের কাছে দিয়েছিল। ফলে দাতারা আবারও নতুন ঋণ প্রদানের বিনিময়ে আগের একই রকমের সব শর্ত গ্রিসের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইলে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনগণের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন ঋণ প্রশ্নে জনতার রায় শোনার জন্য। ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ বলেছেন দাতাদের শর্ত মেনে নিতে তারা রাজি নন।
গ্রিস যে হচ্ছে আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত একটি দেশ, সেই প্রশ্নে কোনো রকম সন্দেহ একেবারেই নেই। গত দুই দশকে বছরের পর বছর ধরে ঋণের পর ঋণ গ্রিস নিয়ে গেছে এবং সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশটি যে সংকটময় পথের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, ঋণদাতাদের চোখে সেটা পড়েনি, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে তারপরও গ্রিসকে ঋণ দিতে কোনো রকম কুণ্ঠাবোধ তারা করেনি। কেন করেনি, সেই প্রশ্নও এক গোলকধাঁধার মধ্যে আমাদের ফেলে দেয়। তবে পুঁজির থলের ভেতরের খেলার দিকে নজর দিলে প্রশ্নের উত্তরও আমরা হয়তো সহজেই পেয়ে যেতে পারি।
ইউরো মুদ্রার দেশগুলোর মুদ্রা-সংকটসংক্রান্ত বিষয়াবলি সাধারণভাবে ট্রয়কা নামে পরিচিত যে তিনটি খুবই প্রভাবশালী সংগঠন দেখাশোনা করে থাকে, তারা হচ্ছে ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। কোনো একটি দেশে ঋণ কিংবা মুদ্রাসংকট দেখা দিলে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মধ্য দিয়ে সেই সংকট উত্তরণের পথের সন্ধানও এরাই দেখিয়ে দেয়। প্রয়োজনে বিশাল অঙ্কের নতুন ঋণও এদের কাছ থেকে কিংবা এদের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্যান্য ব্যাংকের কাছ থেকে আসে। গ্রিসের সংকট যেহেতু হঠাৎ করে দেখা দেওয়া সমস্যা নয়, ফলে গ্রিসকে সংকট থেকে বের হয়ে আসার পথের দিশাও আগে থেকে এরা দেখিয়ে আসছে। তবে কথা হচ্ছে, সংকট উত্তরণে এদের সহায়তার হাত যতটা না হচ্ছে, সংকটকবলিত দেশটিকে সাহায্য করার জন্য, তার চেয়ে বেশি সেটা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সংকটমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে। গ্রিসকে দেওয়া আগের ঋণের হিসাব-নিকাশ সেই সত্যতার প্রমাণ সহজেই আমাদের কাছে রাখতে সক্ষম।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর গ্রিসের জন্য দুই দফায় মোট ২৪ হাজার কোটি ইউরো ঋণ হিসেবে বরাদ্দ করা হয়। তবে নিঃশর্ত ঋণ তা কোনো অবস্থাতেই ছিল না। বরং শর্তের শৃঙ্খল ছিল খুবই কঠোর। ফলে বিশাল সেই পরিমাণের আর্থিক সহায়তার সিংহভাগ চলে গিয়েছিল পশ্চিমের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন ব্যাংকের জমায় ঋণের কিস্তি পরিশোধের আকারে। আর এটাই হচ্ছে ঋণে জর্জরিত কোনো একটি দেশকে আবারও ঋণ দেওয়ার পেছনের খেলা। ঋণের মধ্যে দিয়ে দেশটিকে সহজেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেওয়া সম্ভব বলে ঋণের অর্থ ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি সেখানে থাকে কম।
গ্রিসের আগের উদ্ধার ঋণের বেলায় কিস্তি পরিশোধ ও অন্য শর্তাবলির জন্য অর্থ খরচ করার পর মোট থোকের মাত্র প্রায় ১০ শতাংশ সরকারের ভান্ডারে এসে জমা হয়, যেটা দিয়ে গ্রিসকে তখন আবার অসাধ্য সাধন করতে বলা হয়েছিল। সরকারের আর্থিক ভিত পোক্ত করে নিয়ে ভবিষ্যতে সংকট এড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কাঠামোগত সংস্কারের নামে যেসব শর্ত গ্রিসের ওপর তখন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পেনশন ভাতা হ্রাস ও সরকারের নির্ধারিত সর্বনিম্ন বেতন কমানো। আগের সেই উদ্ধার পরিকল্পনার নেট ফলাফল হিসেবে গ্রিস যা পেয়েছে তা হলো, অর্থনীতি ২৫ শতাংশ সংকুচিত হয়ে আসা এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশে বৃদ্ধি পাওয়া। ফলে আগের সেসব শর্ত গ্রিসের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী আবারও নতুন আলোচনায় বসার আহ্বান ঋণদাতাদের প্রতি জানিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, আলোচনার পথ সুগম করে দিতে অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস পদত্যাগ করেছেন। দাবার পরবর্তী চাল তাই এখন দাতাদের দেওয়ার কথা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৮:০৬ ৪৮৪ বার পঠিত