বঙ্গনিউজ ডটকমঃমুক্তমনা লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সাতজনের একটি দল। এই দলে এক তরুণ চিকিৎসক বা মেডিক্যালের ছাত্রও ছিলেন। অভিজিতের এই খুনিদের মধ্যে একজন রাজধানীর বেগুনবাড়ীতে আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এবিটির এই স্লিপার সেল বা আলাদা দলটির সঙ্গে ছিলেন না প্রধান সন্দেহভাজন রেজোয়ানুল আজাদ রানা। বিদেশে পলাতক এই এবিটি নেতার পরিকল্পনায়ই ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
তদন্তকারীরা বলছেন, ভিডিও ক্যামেরার ফুটেজ, ম্যানুয়াল তদন্ত এবং গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য মতে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া সাত জঙ্গির ছবি পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে তাদের পুরো নাম ও পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। এই ছবিগুলোর সূত্র ধরে চলছে তদন্ত। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের কাছে তদন্তের অগ্রগতির তথ্য পাঠানো হচ্ছে। এই সংস্থার মাধ্যমে অভিজিতের স্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রাফিদা আহমেদ বন্যার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে সাতজনের একটি দল। তাদের শনাক্ত করা গেছে। তবে পরিচয় জানা যায়নি। তারা সবাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য।’ তিনি আরো বলেন, ‘ফুটেজ ও ম্যানুয়াল অ্যানালাইসিসসহ বিভিন্নভাবে তদন্ত করে মাসখানেক আগে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যায় জড়িত থাকায় এবং আলামতের মিল থাকায় রানাকে সন্দেহ করা হলেও এই ঘটনায় এখনো রানার জড়িত থাকার তথ্য মেলেনি। রানা পালিয়ে বিদেশে চলে গেছে বলেই তথ্য পাওয়া গেছে।’
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী বন্যা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি এলাকায় তাঁদের চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় দুর্বৃত্তরা। দুজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত সাড়ে ১০টার দিকে অভিজিৎ মারা যান। ঘটনার পর এফবিআইয়ের একটি দল বাংলাদেশে আসে। তারা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নিয়ে যায়। বন্যার নিরাপত্তা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৩ মার্চ মার্কিন দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হয়।
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) প্রধান আসিম উমর ঘটনার দায় স্বীকার করে বলেন, তাঁর নেটওয়ার্কের অনুসারীরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এদিকে টুইটারে বার্তা প্রকাশ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামেও দায় স্বীকার করা হয়। তবে তদন্তে নেমেই গোয়েন্দা পুলিশ দাবি করে, এই হত্যাকাণ্ডে উগ্রবাদী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গিরা জড়িত। গত ২ মার্চ সন্দেভাজন শফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁকে দফায় দফায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো তথ্য পায়নি গোয়েন্দা পুলিশ। এরই মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল তরুণ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে বেগুনবাড়ী এলাকায় একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তিন দুর্বৃত্ত। পালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়ে জিকরুল্লাহ ও আরিফুর রহমান। পরে যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় সাইফুলকে। গত ২০ এপ্রিল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সাইফুল। অন্য দুই আসামিকেও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সাইফুল জবানবন্দিতে জানান, ফেসবুকে ইসলামবিরোধী লেখালেখির কথিত কারণে ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হয়। যাত্রাবাড়ীর নয়ানগরের একটি বাসায় বৈঠক করে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয় গত ২৩ মার্চ। ওই বৈঠকে ‘মাসুল’ (ইকবাল), কথিত ‘বড় ভাই’ আব্দুল্লাহ ওরফে হাসিব, শরীফ, তাহের, আবরার, জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও সাইফুল উপস্থিত ছিলেন। পুরো দলটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আরেকটি স্লিপার সেল বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওয়াশিকুর হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনকেই অভিজিতের সম্ভাব্য খুনিদের ছবি দেখানো হয়। তাঁদের একজন ছবির একজনকে নিজেদের প্রশিক্ষক হিসেবে শনাক্ত করেন। ওই আসামি জানিয়েছেন, তাঁদের অস্ত্র-চাপাতি চালনা ও হত্যাকাণ্ডের পর কিভাবে পালিয়ে আসা যায়, এর কলাকৌশল শিখিয়েছেন ওই প্রশিক্ষক। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে ‘প্রশিক্ষক’ ওই ব্যক্তিকেই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সূত্র মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও কথিত ‘বড় ভাই’ ছিল ওয়াশিকুরের হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। অভিজিৎ হত্যাকারীদের দলে রানা ছিলেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবীতে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার পরিকল্পনাকারী রানা এই হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে ছিলেন বলে তথ্য মিলেছে। তবে ঘটনার আগে তাঁর দেশে থাকার আলামতও পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:১৪:৪৩ ২৭৫ বার পঠিত