বঙ্গনিউজ ডটকমঃ‘আজ সত্যিকার অর্থে আমরা স্বাধীন হলাম। যুগ যুগ ধরে লালন করা মনের আশা পূরণ হলো, আমরা কাগজে-কলমে বাংলাদেশি নাগরিক হলাম।’ জরিপের প্রথম দিন নিজের নাম লিখিয়ে এমনই অনুভূতি জানালেন লালমনিরহাট উত্তর গোতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা বৃদ্ধ আবদুস সাত্তার। একই রকম বাঁধভাঙা আবেগ পঞ্চগড়ের ছিটমহলের বাসিন্দা আইনুল হকের। তিনি বলেন, ‘হামরা বাংলাদেশতে থাকিমো, এইটে হামার বাব-দাদার নাড়ি পুঁতা আছে। এইঠে কী হবেতে হবে।’
স্থলসীমান্ত চুক্তির দলিল হস্তান্তরের এক মাস পর বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতরের মোট ১৬২টি ছিটমহলে জনগণনার কাজ শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে এই জরিপকাজ শুরু হয়। দুই দেশের যৌথ গণনাকারী দলের সদস্যরা ছিটের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে তথ্য সংগ্রহ করছেন। বাংলাদেশের ভেতরে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলে ৬৮ জন এবং ভারতে বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলে ৩৪ সদস্যের যৌথ দল গণনায় অংশ নিচ্ছেন। আগামী ১৬ জুলাই এই জরিপকাজ শেষ হবে। এরপর ৩১ জুলাই থেকে ছিটমহল বিনিময় শুরুর কথা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির তথ্য মতে, গতকাল জরিপ ক্যাম্পগুলোতে ১৫ শতাংশ ছিটমহলবাসী উপস্থিত ছিলেন। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জরিপকাজে সহায়তা করছেন ছিটমহলবাসী। গণনার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন বাংলাদেশ-ভারতের পক্ষে পৃথক দুইজন গণনাকারী, একজন করে সুপারভাইজার। বিস্তারিত আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের সরেজমিন প্রতিবেদনে-
লালমনিরহাট : লালমনিরহাট জেলায় থাকা ছিটমহলগুলোতে গতকাল সকাল থেকে শুরু হয় জরিপকাজ। পাঁচটি উপজেলার মধ্যে তিনটি উপজেলায় ভারতের ৫৯টি ছিটমহল রয়েছে। এর মধ্যে হাতীবান্ধা ও সদর উপজেলায় দুটি করে এবং বাকি ৫৫টি ছিটমহল রয়েছে পাটগ্রাম উপজেলার অভ্যন্তরে। এসব ছিটমহলেও জরিপের প্রথম দিন কেটেছে উৎসবের আমেজে।
সকাল ১০টার দিকে ওই ছিটমহলে এসে পৌঁছায় একটি জরিপ দল। দলে ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের পৃথক দুজন জরিপকারী ও একজন সুপারভাইজার। তাঁরা ছিটমহলের অফিস ঘরটিতে বসতে না বসতে ছুটে আসতে থাকেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। সকাল সোয়া ১০টার দিকে জরিপদলের প্রথম মুখোমুখি হন উত্তর গোতামারীর ১৩৫/১ নম্বর ছিটমহলের বাসিন্দা আবদুস সাত্তার (৬০)। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ সত্যিকার অর্থে আমরা স্বাধীন হলাম। যুগ যুগ ধরে লালন করা মনের আশা পূরণ হলো, আমরা কাগজে-কলমে বাংলাদেশি নাগরিক হলাম।’
দুপুরের দিকে ছিটমহল ১৩৫/২ নম্বর উত্তর গোতামারীও পরিদর্শন করেছে জরিপদলটি। মাত্র ২০ একরের এ ছিটমহলে ৯টি পরিবারের বাস। যাদের লোক সংখ্যা ৩৪ জন। ৯টির মধ্যে আটটি পরিবারই ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে বলে জানা গেছে।
নীলফামারী : গতকাল সকাল ১০টা থেকে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার অভ্যন্তরে ভারতীয় চার ছিটমহলে জনগণনা শুরু হয়েছে। এসব ছিটমহলে স্থাপিত জনগণনার ক্যাম্পে ভিড় জমে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের। সকাল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে আসতে শুরু করেন গণনার ক্যাম্পে। এ সময় ৩১ নম্বর ছিটমহল দক্ষিণ খড়িবাড়ীর বাসিন্দা শুকুর আলী (৬৫) বলেন, ‘এলা মোক খুব ভালো লাগেছে। এত দিন মাইনষির হিসাবোত হামার নাম আছিল না। আইজ থাকি হামোরাও মাইনষি বলি গণ্য হইনো বাহে।’
নীলফামারী জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন, পুলিশ সুপার জাকির হোসেন খান ও ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম সকালে যৌথ ওই কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। বিকেলে গণনাকারী দলের সদস্য আসাদুজ্জামান বলেন, ৩১ নম্বর ছিটমহল দক্ষিণ খড়িবাড়ীর (নগর জিগাবাড়ী) ৪৫ পরিবারের মধ্যে ১৭ পরিবারের জনগণনা শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ওই গণনার কাজ চলবে।
পঞ্চগড় : ‘হামরা বাংলাদেশতে থাকিমো, এইটে হামার বাব-দাদার নাড়ি পুঁতা আছে। এইঠে কী হবেতে হবে।’
কথাগুলো বলছিলেন, আইনুল হক (৪০)। তিনি ২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ের সময় যেমনটি বলেছিলেন গতকালও সেই একই কথা বললেন ‘বাংলাদেশে থাকবেন’। তবে এবার নতুন করে পরিবারের আগের সদস্যদের সঙ্গে নতুন জন্ম নেওয়া দেড় বছরের পুত্রসন্তান আবিরকে জনগণনায় অন্তর্ভুক্ত করাতে এসেছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পঞ্চগড় সদর, দেবীগঞ্জ ও বোদা উপজেলার ছোট-বড় ৩৬টি ভারতীয় ছিটমহলে গতকাল সকালে একসঙ্গে যৌথ জনগণনার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরেজমিন গারাতি ছিটমহলে গিয়ে মাদ্রাসা মাঠ, নারায়ণপাড়া জামে মসজিদ মাঠ ও জিন্নাত পাড়ায় আলমের বাড়িতে স্থাপিত তিনটি জনগণনা ক্যাম্পে লোকজনের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে।
এসব ছিটমহলের প্রায় সব নাগরিকই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বেছে নিচ্ছেন। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে গোনা কিছু লোক ভারতে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। সোমবারের সর্বশেষ গণনায় গারাতি ছিটমহলের মাদ্রাসা মাঠের ক্যাম্পে পাঁচটি পরিবারের ১৮ জন সদস্য ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। এদেরই একজন পলাশ রায় জানান, স্ত্রী লক্ষ্মী রানী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভারতে যাবেন। বাংলাদেশে তাঁর বাবা, তিন ভাই ও দুই বোন থেকে যাচ্ছেন।
কোচবিহার : গতকাল সকাল থেকে ক্যাম্প অফিসগুলোতে ছিলেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সদস্যরা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার ৫১টি বাংলাদেশি ছিট রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি জনবহুল ছিট ছাড়া বাকিগুলোতে কেউ বসবাস করে না। এই ৩৭টি ছিটের জনগণনার জন্য গতকাল থেকে ২৫টি ক্যাম্পে উভয় দেশের ৫০ জন প্রতিনিধি কাজ করছেন। এর সঙ্গে সমন্বয় কমিটির তরফেও ৫০ জন যুক্ত রয়েছেন। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, ছিটের বাসিন্দারা যেভাবে উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মাধ্যমে জনগণনার কাজে অংশ নিচ্ছেন তাতে মঙ্গলবার থেকে জরিপের হার ৪০ শতাংশে পৌঁছবে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার জেলা শাসক পি উলগনাথন বলেন, প্রথম দিন নির্বিঘ্নে গণনার কাজ চলেছে। দুই দেশের মোট ৭৫টি দল এই গণনার কাজে যুক্ত রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ২০১১ সালের জনগণনাকে ভিত্তি করে এবার এই গণনা চলছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় জনগণনা মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি ডাইরেক্টর এস কে চক্রবর্তী গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন ছিট পরিদর্শন করেন এবং ছিটমহলের বাসিন্দাদের ধন্যবাদ জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জরিপদলের সদস্যরা ছিটমহলগুলোয় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে জরিপ ও গণনা পরিচালনা করবেন। পরে এর প্রতিবেদন দেওয়া হবে জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে। স্থল সীমান্ত চুক্তি ও প্রটোকল অনুযায়ী, ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ হয়ে যাবে, বাংলাদেশের ৫১টি চলে যাবে ভারতের সঙ্গে। ছিটমহলবাসীকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিলে তারা বর্তমান বাসস্থানেই থেকে যেতে পারবেন। যদি ভারতের নাগরিকত্ব নিতে চান, তবে তাঁকে ওপারে চলে যেতে হবে। এ জন্য তাঁদের যৌথ দলের প্রতিনিধিদের কাছে আবেদন করতে হবে। ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পছন্দের দেশের মূল ভূখণ্ডে চলে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:১২:০৮ ২৭৭ বার পঠিত