বঙ্গনিউজ ডটকমঃ জীবনে কোনো দিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা মো. ফজলুল হক রহিম। তবুও গ্রেফতার হয়েছিলেন গাড়ি পোড়ানোর মামলায়। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দুই উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল আলিম ও নজরুল ইসলাম তার কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন নগদ টাকা, ফ্ল্যাট ও গাড়ি মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পদ। এত কিছুর পরও ক্ষান্ত হননি পুলিশের ওই দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর ২৫ জুন থেকে আবার নিখোঁজ ফজলুল হক। এ ঘটনার পর চরম উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছেন ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা। নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও প্রতিকার পাচ্ছেন না স্ত্রী তাহ্মিনা আক্তার বৃষ্টি।
জানা গেছে, সর্বশেষ নিখোঁজ হওয়ার আগে জামিনে মুক্ত হয়ে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি উল্লেখ করে মিল্কি প্রপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক নিজেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বরাবর আবেদন করেছিলেন। ফজলুল হকের সঙ্গে আচরণকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র সচিবকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান কমিশন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। ২৪ জুন পুলিশ সদর দফতরের ডিসিপ্লিন বিভাগ থেকে (বার্তা নম্বর-১৩৬/ডিসিপ্লিন) ঢাকা মহানগর পুলিশের শেরেবাংলানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে ভুক্তভোগী ও তার স্ত্রীকে সশরীরে পুলিশ সদর দফতরে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। কিন্তু পরদিন ২৫ জুন বিকালেই নিখোঁজ হন ফজলুল হক। অন্যদিকে, গতকাল পর্যন্ত ডিবির অভিযুক্ত ওই দুই পুলিশ উপপরিদর্শক আগের কর্মস্থলেই দায়িত্ব পালন করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত আছি। তবে তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমার পরামর্শ হলো, ভুক্তভোগীর পরিবারের উচিত প্রতিটি বিষয় পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেলকে অবহিত করা।’ ভুক্তভোগীর পরিবার ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে করা আবেদনসূত্রে জানা গেছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনদুপুরে রাজধানীর পান্থপথ এলাকা থেকে ডিবির এসআই মো. আবদুল আলিম ও নজরুল ইসলামসহ ডিবির তিন-চার জন সদস্য ডেভেলপার ব্যবসায়ী ফজলুল হককে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে ডিবি অফিসে নিয়ে যান। ক্রসফায়ার ও গুমের ভয় দেখিয়ে তার কাছে ১ কোটি টাকা দাবি করে পুলিশ। স্বামীকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে ভুক্তভোগীর স্ত্রী বৃষ্টি প্রথম পর্যায়ে পুলিশকে ১০ লাখ টাকা দেন। এর মধ্যে ৬ লাখ টাকা আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যাংকের (চেক নম্বর ২৫১১৯২২৪) মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবুও মুক্তি মেলেনি ফজলুল হকের। দ্বিতীয় দফায় ২ মার্চ প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের ভুক্তভোগীর একটি প্রাডো গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-১৬১০) ডিবি অফিসে নিয়ে আটকে রাখে পুলিশ। পরদিন ৩ মার্চ তিন দফায় নয়টি চেকের মাধ্যমে মোট ৯০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় পুলিশ। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকা করে ব্র্যাক ব্যাংকের তিনটি চেকের মাধ্যমে (চেক নম্বর : ৩২১৭৮৫৪, ৩২১৭৮৫৫, ৩২১৭৮৫৬) ৩০ লাখ টাকা নেওয়া হয়। আশা ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেডের নামে ১০ লাখ টাকা করে ব্র্যাক ব্যাংকের চারটি চেকের (৩২১৭৮৫৭, ৩২১৭৮৫৮, ৩২১৭৮৫৯ ও ৩২১৭৮৬০) মাধ্যমে ৪০ লাখ এবং ১০ লাখ টাকা করে আইএফআইসি ব্যাংকের দুটি চেকের মাধ্যমে (২৫১১৯২৫, ২৫১১৯২৬) ২০ লাখ টাকা নেয় পুলিশ। এর বাইরে হাজতখানায় ‘মিল্কি প্রপার্টিজ’-এর হোল্ডিং নম্বর- ৯/২ কল্যাণপুর, ষষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাট আজিউল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে ৩০ লাখ টাকা দিতে অথবা তাকে ফ্ল্যাটটি লিখে দিতে হবে উল্লেখ করে ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নেয় পুলিশ। একই হোল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার আরেকটি ফ্ল্যাট ফজলুল হক নামের আরেক ব্যক্তির নামে ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে হাতিয়ে নেয়। এর পরও থামেনি পুলিশ।
চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দারুস্সালাম থানায় দায়েরকৃত একটি মামলায় ৪ মার্চ ফজলুল হককে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। একই সঙ্গে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে ফজলুল হককে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে লেনদেনের বিষয় গোপন রাখতে পুনরায় ক্রসফায়ারের হুমকি দেয়। ২০ এপ্রিল জামিনে মুক্ত হন ফজলুল হক। লালমাটিয়ায় ভুক্তভোগীর বাসায় বৃহস্পতিবার তাহ্মিনা আক্তার বৃষ্টির সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপের শুরুতেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। পাশে বসে থাকা পাঁচ বছরের ছেলে ওয়াসিম হক তূর্য এবং ১৫ বছরের মেয়ে তানহা হক মিমকে দেখিয়ে বলতে থাকেন, ‘বাবার শোকে এরা পাথর হয়ে গেছে। পড়াশোনা বন্ধ, খাওয়া-দাওয়া নাই। আমি ওদের কী সান্ত্বনা দেব। আমি এখন কী করব ভাই?’ নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে তিনি বলেন, ‘রিমান্ডে নেওয়ার পরই আমার স্বামীর ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। ওকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কয়েক দফায় ১ কোটি টাকা এবং কল্যাণপুরের দুটি ফ্ল্যাট লিখে নেন এসআই আলিম ও নজরুল।’ তিনি আরও জানান, নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েও তাকে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণে প্রথমে জিডি গ্রহণ করতেই রাজি হয়নি পুলিশ। অনেক অনুরোধের পর এক পর্যায়ে তা গ্রহণ করে। তাতেও অভিযোগ সহজ ও দুর্বল করা হয়েছে। স্বামীকে নিরপরাধ উল্লেখ করে বৃষ্টি বলেন, ‘ফজলুল হক জীবনে কোনো দিন রাজনীতি করেনি। দেশের কোনো থানায় ওর বিরুদ্ধে একটি জিডি পর্যন্ত নেই। তবুও তাকে কেন এ হয়রানি? আমি আমার স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত চাই’- বলেই মূর্ছা যান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০১:১৪ ৩০৪ বার পঠিত