বঙ্গ-নিউজ ডটকম : আসন্ন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচন (রাসিক) উত্তরাঞ্চলের স্থানীয় রাজনীতি এবং এ অঞ্চলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, রাসিক নির্বাচনের ফলাফল সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের বড় সুযোগ। একই সঙ্গে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল গত নবম সংসদ নির্বাচনেও ভুমিকা রেখেছিল। এবারও তার ব্যত্যয় হবে না।
নগরপিতা হিসেবে নাগরিকের প্রত্যাশা, রাসিকের বর্তমান প্রার্থীরা নাগরিকের চাহিদায় কতটুকু যোগ্য ও জাতীয় নির্বাচনে উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিতে এ নির্বাচনের প্রভাব নিয়ে বিশিষ্টজনের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে রাসিক নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতির নানা সমীকরণ। পাঠকের জন্য এ আলাচারিতা হুবহু তুলে ধরা হলো।
উপমহাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক রাসিক নির্বাচন নিয়ে তার প্রত্যাশিত মেয়র সম্পর্কে বলেন, “সমাজে অজস্র মানুষ আছেন। সকলের স্বার্থ একরকম নয়। এদের মধ্যে কেউ উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী। তাদের চাহিদা এক রকম। আবার সমাজের নিম্ন শ্রেণি, খেটে খাওয়া শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। তাদের চাহিদা আরেক রকম। আসন্ন রাসিক নির্বাচনে যিনিই মেয়র হবেন, তার উচিত হবে সকল শ্রেণির মানুষের চাহিদার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। তাদের স্বার্থ রক্ষায় যা কিছু করার দরকার তিনি তা করবেন।”
তিনি বলেন, “সমাজের ৮৫ ভাগ মানুষই নিম্ন শ্রেণির। এই ছিন্নমূল মানুষের স্বার্থ রক্ষায় যিনি কাজ করবেন তিনিই আমার প্রত্যাশিত মেয়র হবেন।”
বর্তমান মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে এমন কেউ আছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে হাসান আজিজুল হক বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা অনেক। দেশের সরকার কাঠামো ও রাজনৈতিক কাঠামো একটি গণ্ডির মধ্যে বাঁধা। এ ছকের বাইরে গিয়ে কেউ সমাজের জন্য কিছু করেছেন বলে আমার খুব বেশি মনে হয় না। তথাপি সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন গত পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করে নগরবাসীর জন্য কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন, এটা আমি স্বীকার করছি। তবে বৃহত্তর স্বার্থে আরো বেশি উন্নয়নের জন্য তাকে আরো একবার সুযোগ দিলে হয়ত তিনি নগরীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নজর দেবেন। এ কারণে সদ্য বিদায়ী মেয়রের পক্ষে যে নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছে, তাতে আমি সমর্থন দিয়েছি। অন্যান্য প্রার্থী সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই।”
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিতে এ নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে রাজনীতিকরাই মূল্যায়ন করবেন জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান কি। জনগণই ভোটের মাধ্যমে জবাব দেবেন, হরতাল-অবরোধের নামে হেফাজতের নৈরাজ্য কখনো গণতান্তিক অধিকার হতে পারে কিনা।”
একই বিষয়ে তিনটি প্রশ্নর জবাব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ব্রিটেনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক ড. এম সাইদুর রহমান খান।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিতে রাসিক নির্বাচনের প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, “এ নির্বাচন অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। একসঙ্গে চারটি সিটিতে নির্বাচন হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের জনপ্রিয়তার মূল্যায়ন হবে। যে কোনো সরকারের ইচ্ছায় নগরপিতারা তাদের উন্নয়ন কাজের বাস্তবায়ন করেন। তাই রাজশাহী সিটির যদি কোনো উন্নয়ন সদ্যবিদায়ী মেয়র করে থাকেন তা এ অঞ্চলের ভোটারের কাছে বর্তমান সরকারেরই উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে রাসিক নির্বাচন ভূমিকা রাখবে।”
প্রত্যাশিত মেয়র সম্পর্কে তিনি বলেন, “নাগরিক সুবিধা, যেমন- গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার যিনি উন্নয়ন ঘটাবেন, নাগরিক সুযোগ সুবিধার দিকে যিনি খেয়াল রাখবেন, নাগরিক সমাজ তাকেই নগরপিতা হিসেবে প্রত্যাশ্যা করেন। আমার প্রত্যাশাও তেমন। উত্তরাঞ্চলের একটি প্রাচীন ও বৃহৎ শহর রাজশাহী। দীর্ঘদিন এটি বঞ্চিত ও অবহেলিত ছিল। সদ্যবিদায়ী মেয়র বর্তমান সরকারের সহায়তায় কিছু উন্নয়ন করেছেন। তাই তাকেই আমার যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনে হয়েছে। বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল যেহেতু এ পদে কখনো দায়িত্ব পালন করেননি, তাই তার সম্পর্কে আমি সত্যিকারে কিছু জানি না।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বাংলানিউজকে বলেন, “কি ধরনের মেয়র চাই–এর উত্তর দিতে গেলে আগে বলতে হবে যে, প্রচলিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন প্রণালী আমি পছন্দ করি না। সমাজিক প্রতিনিধিত্ব চাই। রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র চাই না। সামাজিক গণতন্ত্র চাই। সামাজিক গণতান্ত্রিক প্রণালিতে একজন মহাপুরুষ অথবা খারাপ মানুষকে একটি সমাজের ভালো-মন্দ বা উন্নয়নের সকল দায়-দায়িত্ব দিয়ে দেয় না। সমাজের সকল মানুষ একটি সেলফ ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে একটি সমাজকে কীভাবে ভালো বা মন্দ করা যাবে তা নির্ধারণ করে দেবেন। তাই এ ক্ষেত্রে মেয়র পদে কে প্রার্থী হচ্ছেন তা আমার কাছে বড় বিষয় নয়। তবে বিদ্যমান সমাজের প্রেক্ষাপটে আমি যে সামাজিক গণতন্ত্র চাই তাতো রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক গণতন্ত্রে কোনো মহাপুরুষের পক্ষেই একার পক্ষে সমাজের ভালো-মন্দ করা সম্ভব নয়। এটা রাজনৈতিক গণতন্ত্র রাজনৈতিক বিবেচনায়ই সবাই চলবেন। তবে মানুষের মতামত নিয়ে, তাদের সিদ্ধান্তে যতোটা চলা সম্ভব চলবেন। মানুষের ভালো-মন্দ বিবেচনা করবেন তাকেই মানুষ সমর্থন দেবেন। রাজশাহীর মানুষ ভালো করেই জানেন কে ভালো মানুষ। এসব বিবেচনায় সদ্য বিদায়ী মেয়রকে আমার কাছে খারাপ মনে হয়নি।”
তিনি বলেন, “রাসিক নির্বাচন রাজশাহী অঞ্চলে অনেকখানি প্রভাবই রাখবে। রাজশাহী অঞ্চলের বাকি নির্বাচনে ও এটা প্রভাব ফেলবে। তবে তা কি পরিমাণ প্রভাব ফেলবে তা সামজিক বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে পরিমাপ করা কঠিন। কিন্তু অনুমান করা যায় বিরাট প্রভাব ফেলবে। আমরা অনেকগুলো নির্বাচন আগেও দেখেছি। কেউই তার ফলাফল সম্পর্কে আগে থেকেই অনুমান করতে পারেনি। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে দল ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে অন্ধভাবে ভোট চাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। রাজনৈতিক গণতন্ত্রে নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব সমর্থকদের কাছে অধরাই থেকে যায়।”
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন রিজভী কেমন মেয়র চান এ প্রশ্নের জবাবে বাংলানিউজকে বলেন, “নগরবাসীর প্রত্যাশা অবশ্যই সৎ, যোগ্য এবং নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিই মেয়র পদে প্রার্থী হবেন। আমিও এই রকম প্রার্থীই প্রত্যাশা করি।”
সদ্যবিদায়ী মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এই দুই প্রার্থীই সৎ ও যোগ্য বলে মনে করেন তিনি। তবে অপর জামায়াতের প্রার্থী ডা. জাহাঙ্গীর সর্ম্পকে তিনি তেমন কিছু জানেন না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিতে রাসিক নির্বাচনের প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, “এ নির্বাচন জাতীয় পর্যায়ে কিছুটা প্রভাব ফেলবে। কারণ মেয়র সমর্থকরা চাইবেন তাদের প্রার্থীই জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করুক।” তবে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি।
রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হাসান মিল্লাতের কাছে কেমন মেয়র চান জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “সৎ, রুচিশীল এবং প্রশাসনিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিই মেয়র প্রার্থী হোক, এমনই প্রত্যাশা করি আমি।”
তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে সদ্যবিদায়ী মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন নগরীতে যে দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন, সে দিক দিয়ে তিনি যোগ্য মেয়র প্রার্থী বলেই মনে করি আমি।”
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিতে রাসিক নির্বাচনের প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, “প্রায় ৮০০ বছরের ঐতিহ্য এবং উত্তরাঞ্চলের প্রথম ও প্রাচীন বিভাগীয় শহর রাজশাহী। এখানে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় এবং উত্তরবঙ্গের প্রাচীন ‘রাজশাহী কলেজ’। এখানকার যেকোনো ঘটনা রাজশাহী জেলা, উত্তরাঞ্চল ও জাতীয়ভাবে এর প্রভাব পড়ে। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে রাসিক নির্বাচন ভূমিকা রাখবে।”
দীর্ঘ ১৭ বছর পর সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত খায়রুজ্জামান লিটন জয় পেয়েছিলেন। এছাড়া নবম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ছয়টি আসনেও বিপুল ভোটে হেরে যায় বিএনপি।
সুত্রঃ bdnews24.com
বাংলাদেশ সময়: ১০:২৬:৫৫ ৪৯০ বার পঠিত