বঙ্গনিউজ ডটকমঃ ইদানীং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে ও পাঠ করে মনে হচ্ছে দুর্বল বিএনপিকে সবল করার বাইরে তাঁদের কোনো কাজ নেই। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায়, টেলিভিশনে আওয়ামী লীগের জাঁদরেল নেতারা বিএনপিকে টিকিয়ে রাখতে হলে কী কী করতে হবে, কীভাবে দলকে এগিয়ে নিতে হবে, সেসব নিয়ে উপদেশ বর্ষণ করে চলেছেন। আওয়ামী লীগের একজন তুখোড় সাংসদ ও একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিএনপির জন্য পাঁচ দফা করণীয় বাতলিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের স্বেচ্ছায় পদ থেকে সরে দাঁড়ানো, যুদ্ধাপরাধীর বিচারে সম্মতি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা না করা। তাঁর শেষ তিনটি প্রস্তাবের সঙ্গে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। কেননা, কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলই যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে পারে না, তেমনি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডকেও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে না। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্ব কে দেবেন কিংবা কে কবে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন, সেসব নিয়ে সরকারি দলের নেতার কিছু করণীয় আছে বলে মনে করি না।
বিএনপি নেতৃত্ব দুর্বল হলে কিংবা দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তায় ধস নামলে তো আওয়ামী লীগেরই লাভ এবং নেতাদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা খুশি না হয়ে হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন কেন? এর একটি কারণ হতে পারে তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভয় পান। আরেকটি কারণ হতে পারে নেত্রীকে খুশি করা। নেত্রীকে খুশি করার দুটি উপায় আছে-অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন ও তোষামোদ। প্রথম কাজটি কঠিন বলেই ডিজিটাল জমানার আওয়ামী লীগের অনেক নেতা সহজ পথটি বেছে নিয়েছেন। এতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কিংবা সরকারের কোনো লাভ না হলেও নেতাদের সুবিধা নিশ্চিত। কিন্তু এই নেতারা একবারও ভেবে দেখেন না যে তাঁরা যত বেশি বিএনপির নেত্রীকে নেতৃত্ব ছাড়ার কথা বলবেন, তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি তত বেশি বাড়বে। এটি অনুমানের কথা নয়, অঙ্কের কথা। চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই তেমনি বাংলাদেশে কোনো দল নিজ গুণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে না। একসময় বিএনপির দুর্বলতা আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছে। এখন আওয়ামী লীগের দুর্বলতা খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির শক্তি জোগাচ্ছে। আওয়ামী লীগ জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে না ঠিকই কিন্তু সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে বিএনপির কোনো নেতা হত্যা করেননি। র্যাব সদস্যদের দিয়ে খুন করিয়েছেন নুর হোসেন নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেক নেতা। তাঁকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন একজন আওয়ামী লীগ সাংসদ। ফেনীর উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমদের খুনিও বিএনপি থেকে আসেনি। দুটো ঘটনায়ই অভিযোগের তির স্থানীয় সাংসদের প্রতি।
বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে বর্তমানে শেখ হাসিনার মতো অনুকূল পরিবেশ কেউ পাননি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছিলেন দুই তরফেই, চরম ডান ও চরম বাম। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময়ও বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছিল। এমনকি নবম সংসদেও তাঁকে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, সংখ্যায় তারা যত কমই হোক না কেন। এবারে ‘বিরোধী দলও’ সরকারের অংশ। বাম ও ডানদের একাংশও সরকারের সঙ্গে আছে। বিএনপি বিভ্রান্ত ও বিশৃঙ্খল। তাহলে আওয়ামী লীগের ভয় কী? ভয়টি হলো দলের ভেতরে গড়ে ওঠা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা। যেহেতু সংসদের ভেতরে-বাইরে কোনো বাধা নেই, তাই তারা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছেন। মন্ত্রী নেতাকে মানছেন না, নেতা মন্ত্রীকে মানছেন না। মন্ত্রী সাংসদকে উপেক্ষা করছেন আর সাংসদ উপজেলা চেয়ারম্যানকে পাত্তা দিচ্ছেন না। শেখ হাসিনা দলকে তৃণমূল পর্যায়ে যতই শক্তিশালী করার কথা বলুন না কেন, তৃণমূলের নেতারা দলকে সংগঠিত করার চেয়ে বখরা নিয়েই মারামারিতে ব্যস্ত আছেন। এই যে দেশে মানব পাচারের মহাবিপর্যয় ঘটে গেল; সেটি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। এই যে ঢাকা শহর মুমূর্ষু হয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কেও মন্ত্রী-সাংসদদের মুখে কোনো কথা নেই। তাঁরা সবাই উদ্বিগ্ন আছেন বিএনপির করণীয় নিয়ে।
আওয়ামী লীগের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা, যিনি শেখ হাসিনার আগের কেবিনেটে পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন; বলেছেন, বিএনপি এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। তিনি খালেদা জিয়াকে দলের চেয়ারপারসনের পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার রাজনীতির পাঠশালায় ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। লক্ষ করুন, তিনি লাইফ সাপোর্টে থাকা বিএনপির নেত্রীকে শেখ হাসিনার পাঠশালায় ভর্তি হতে বলেছেন। কিন্তু অনেক আগে থেকে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের পারফরম্যান্স যে মোটেই ভালো নয়, বর্তমান বাংলাদেশই তার প্রমাণ।
আরেকজন মন্ত্রী বলেছেন, বিএনপির দিন শেষ। মিডিয়া বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের যতই উজ্জীবিত করার চেষ্টা করুন না কেন, বিএনপি আর শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়াতে পারবে না। মাননীয় মন্ত্রী যদি সরকারের পুলিশ, র্যাব, বিজিবি বাদ দিয়ে মাঠে খেলতে নামতেন, দেখতেন কত ধানে কত চাল। সিটি করপোরেশন নির্বাচনী প্রচারে খালেদা জিয়া নামতে না-নামতেই আওয়ামী লীগের কর্মীদের গায়ে জ্বর উঠে গিয়েছিল। এরপর যা ঘটেছে, সেই জ্বরের প্রতিক্রিয়া। মিডিয়া নয়, বিএনপিকে চাঙা করে রাখছে মন্ত্রী-সাংসদ নেতাদের গরম বক্তৃতা-বিবৃতি। অনেক সময় দেখা যায়, যে বিষয়েই সেমিনার বা আলোচনা হোক না কেন, আওয়ামী লীগের নেতারা খালেদা জিয়া বা বিএনপিকে সেখানে টেনে আনবেনই।
মন্ত্রী-সাংসদেরা সংসদের বাইরে ও ভেতরে অবিরাম বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে আসছেন। কিন্তু নিজ দলের নেতা-কর্মীরা যে দেশজুড়ে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন, সেসব নিয়ে তাঁদের আদৌ কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। যখন রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায়, যখন মানব পাচার ও ইয়াবা ব্যবসায় সরকারি দলের সাংসদ জড়িয়ে পড়েন কিংবা একজন নারী সাংসদের ছেলে গুলি করে দুজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেন, তখন তাঁদের টুঁ শব্দটি করতে দেখা যায় না।
তাঁদের এসব সদুপদেশ শুনে চারদলীয় জোট এবং তার আগে ‘একদলীয়’ বিএনপি সরকারের সময়ে বিএনপি নেতাদের অযাচিত বক্তৃতা-বিবৃতির কথা মনে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে বলছেন, বিএনপি কোনো দিনই আর মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পারবে না। ক্ষমতায় থাকতেও বিএনপি নেতারা ৪১ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে ফরমান জারি করেছিলেন। এমনকি খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে এক ছাত্রসমাবেশে খালেদা জিয়া বলেছিলেন যে বিরোধী দলকে মোকাবিলায় তাঁর ছাত্রদলই যথেষ্ট। বিএনপি নেতারা তখন এমন কথাও বলে বেড়াতেন যে শেখ হাসিনা যত দিন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী থাকবেন, তত দিন আর তাঁদের কোনো ভাবনা নেই। ভাবনা আছে কি না, এখন টের পাচ্ছেন। আশা করি, বর্তমান শতকে না হলেও আগামী শতকের কোনো একসময় আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাচ্যুত হবে, তখন এই দলের নেতারা অথবা তাঁদের উত্তরসূরিরাও টের পাবেন।
পত্রিকায় দেখলাম, নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, যারা নদী দখল করে, তারা এ যুগের রাজাকার। রাজাকার শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যা-ই থাকুক না, রাজাকার বলতে এ দেশের মানুষ একশ্রেণির ঘৃণ্য মানুষকেই বোঝে, যারা একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে, এখনকার নদী দখলকারীরা যদি সেই রাজাকারের শিরোপা পেয়ে থাকে, মন্ত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, সেই রাজাকাররা কোন দলের? একাত্তরের রাজাকারদের চিহ্নিত ও বিচার করার কাজটি সরকার করছে। কিন্তু মন্ত্রী এ যুগের রাজাকার অর্থাৎ নদী দখলকারীদের তালিকা টাঙিয়ে দিলে মানুষ তাদের নাম-পরিচয় জানতে পারত।
সংসদের ভেতরে বিরোধী দল নেই। রাজপথে বিরোধী দল নেই। তিন মাসের ভুল আন্দোলনের খেসারত দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া এখন ঘরে চুপচাপ বসে আছেন। এত বড় রাজনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা করতে তিনি সাহস পাচ্ছেন না। তারপরও বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের এত উদ্বেগ কেন? তাঁরা যদি বিএনপিকে নিয়ে সারাক্ষণ না ভেবে একটু সময় দেশের ও দলের কথা ভাবতেন, তাহলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতো। আগুন-বোমার রাজনীতি দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। এর অর্থ এই নয় যে তারা দলীয় মাস্তানি-চাঁদাবাজির রাজনীতিকে বুকে আলিঙ্গন করে নেবে।
এই মুহূর্তে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ নয়। চ্যালেঞ্জ হলো নিজ দলের ভেতরে জন্ম নেওয়া ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা। ছিপি খুলে যাদের বের করে দেওয়া হয়েছে, তাদের আবার শিশিতে পোরা খুবই কঠিন কাজ। সেই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েই আওয়ামী লীগের নেতারা হাওয়ায় ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫৩:০২ ৪০৫ বার পঠিত