বঙ্গনিউজ ডটকমঃ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাধারণ যাত্রীদের হয়রানির শেষ নেই। বিশেষ করে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্মকর্তাদের আচরণ এবং লাগেজ তল্লাশির নামে হয়রানি থেমে নেই। যাত্রীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শুধু নামেই, কাজে কর্মে নেই। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তার কিছুই নেই। প্রতিদিন স্বর্ণ, সিগারেটের কার্টুন, ওষুধ, শত শত মোবাইল সেটসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী বের হচ্ছে কাস্টমস কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই। চোরাকারবারীদের সাথে অবৈধ লেনদেন এবং চুক্তিভিত্তিক মাসোয়ারা পরিশোধ করে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী পাচার হচ্ছে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে। অথচ সাধারণ যাত্রীদের ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। লাগেজ খুলে মালামাল তছনছ করা হয়। এ ব্যাপারে অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রীরা। গত কয়েকদিন সরেজমিনে পরিদর্শনকালে ও যাত্রীদের সাথে কথা বলে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়। গতকাল লন্ডন থেকে আসা সিলেটের এক যাত্রী অভিযোগ করেন, তার লাগেজ খুলে কাস্টমস কর্মকর্তারা মালামাল তছনছ করেন। আমদানি নিষিদ্ধ কিংবা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোনো ধরনের পণ্যসামগ্রী লাগেজে না পেলেও বিনা কারণে তাকে ৩০/৩৫ মিনিট আটকিয়ে রাখেন। ওই যাত্রীর নাম হাবিবুর রহমান। সউদী আরবের রিয়াদ থেকে আসা সউদী প্রবাসী জাহিদ হোসেন জানান, লাগেজে স্বর্ণ আছে কি না জানতে চাইলে নেই বলার পরেও ২টি লাগেজই খোলানো হয়। যাত্রী জাহিদ হোসেন আরও জানান, কাস্টমস হলে নিয়ে সবকিছু তল্লাশি করার পরেও ২০/২৫ মিনিট আটকিয়ে রাখা হয়। বিনা কারণে নানা প্রশ্ন করে। যতসব অবাস্তব প্রশ্ন। তিনি বলেন, রিয়াদ থেকে বিমানে ওঠার আগেই মালামালসহ ২টি লাগেজ তল্লাশি করা হয়েছে। যথারীতি রিয়াদে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহের সময় সবকিছু তল্লাশি করা হয়। তারপরেও বিনা কারণে হয়রানি করা হচ্ছে শাহজালাল বিমানবন্দর কাস্টমসে। রফিকুল ইসলাম নামের এক যাত্রী জানান, তিনি ব্যবসায়িক কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। কোথাও এমন দৃশ্য দেখেননি। রফিকুল আরো জানান, বিমান থেকে নামার পর পরই যাত্রীদের লাগেজ চলে যায় বিমানবন্দরের আন্ডার গ্রাউন্ডে সংরক্ষিত স্ক্যানিং মেশিন এলাকায়। তারপর সেখান থেকে মেশিনের সাহায্য লাগেজ চলে আসে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাগেজ বেল্টে। পৃথিবীর সব দেশের বিমানবন্দরে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু শাহজালালে তা নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দরের কর্মরত একটি সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, কাস্টমসের কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সাধারণ যাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। লাগেজ তল্লাশির নামে সাধারণ যাত্রীদের আটকিয়ে তল্লাশি হলে ভীড় জমায়। অন্যদিকে, যারা চোরাচালানী করে তাদের পণ্যসামগ্রী বিনা বাধায় বের করে দেয়া হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, চাকরি ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। কিন্তু কোথাও এ ধরনের হয়রানি তার চোখে পড়েনি।বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ (এপিবিএন) এর সিনিয়র এএসপি আলমগীর হোসেন শিমুল বলেন, যদি বিমান বন্দরের আন্ডার গ্রাউন্ডে লাগেজ স্ক্যানিং-এর ব্যবস্থা থাকে, তাহলে সেখানে মেশিনের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই লাগেজপত্র তল্লাশি হবে। এতে করে যাত্রীদের সময় বাঁচবে এবং কাস্টমস কর্মকর্তারাও আগ থেকেই নিশ্চিত হতে পারবেন কোন লাগেজে কি ধরনের পণ্যসামগ্রী আসছে। ফলে যাত্রী হয়রানি বা সময়ক্ষেপনের অভিযোগ উঠবে না। এএসপি আলমগীর বলেন, বিমানবন্দরের অবকাঠামো এমন হওয়া প্রয়োজন যদি প্রতি ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০টি ফ্লাইট অবতরণ করে তারপরেও যাত্রীদের লাগেজ যাতে সঙ্গে সঙ্গে আন্ডার গ্রাউন্ডের স্ক্যানিং মেশিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চেক হয়ে নিচ থেকে উপরের গ্রাইন্ড ফ্লোর বা ফাস্ট ফ্লোরে লাগেজ চলে আসবে। এমন ব্যবস্থা পৃথিবীর প্রায় সকল বিমানবন্দরেই আছে। তিনি আরো বলেন, এতে করে চোরাচালানও বন্ধ হবে।অপর একটি সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চোরাচালানে কাস্টমসের কর্মকর্তারা জড়িত তার অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে। কাস্টমস হল চেক হয়ে লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার পর লাগেজ বহনকারীকে আটক করে স্বর্ণ, সিগারেট, ওষুধ ও মোবাইল ফোন সেটের বড় বড় চালান আটক করার নজির রয়েছে। জানা যায়, গতবছর জুলাই মাসে শাহজালাল বিমানবন্দরে চোরাচালানের ১৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এ চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছে কাস্টমসের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ সিভিল অ্যাভিয়েশনের কর্মচারী। এই ১৪ কোটি স্বর্ণ জব্দ করার মামলায় (মামলা নং-৫১) গত ১৪ জুন রোববার কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান ও কাস্টমস কর্মকর্তা হানিফকে ডিভি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। একবছর আগে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় ওই ১৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এ ব্যাপারে মামলা চলছে। এছাড়া গত মাসের ২০ তারিখে অর্থাৎ চলতি বছরের ২০ মে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় এপিবিএন’র পুলিশ কর্মকর্তারা বৈদেশিক মুদ্রাসহ বহনকারীকে আটক করে। প্রায় ২০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার চালানটি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ওই ২০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার চালানটি আটকের পরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিমানবন্দরের ভিডিও ফুটেজে দেখতে পান মুদ্রা বহনকারীদের কাস্টমসের কর্মকর্তারা সহযোগিতা করছেন। তন্মধ্যে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন মজুমদার কাস্টমস প্রিভেনটিভ শামসুল ইসলামসহ আরো কয়েকজন ওই মুদ্রা পাচারে জড়িত রয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।এভাবে প্রতিদিনই কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা, শত শত কার্টন ভর্তি সিগারেট, কোটি কোটি টাকার ওষুধপত্র ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রীসহ মোবাইল ফোন সেট বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছে। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। এ ব্যাপারে কর্মরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কারণ, চোরাকারবারীদের কাছ থেকে তারা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বিনা কারণে প্রতিদিন শত শত যাত্রীকে হয়রানি করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে লাগেজ তল্লাশির নামে হয়রানি করা হচ্ছে।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, যুগ্ম-কমিশনার তাজুল ইসলাম বলেন, সব অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, বিমানববন্দর কাস্টমস আর ঢাকা কাস্টমস ২টি আলাদা। তবে বিমানবন্দরে যদি কোনো কাস্টমস কর্মকর্তা বিনা কারণে হয়রানি করেন এবং কেউ অভিযোগ করে তবে তদন্ত সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন। কাস্টমস সূত্র জানায়, গত এক বছরের ৩৪৫ কোটি টাকার পণ্য জব্দ করা হয়েছে। তন্মধ্যে মোবাইল ফোন সেট, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, সিগারেট, স্বর্ণ, ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী রয়েছে। এসব পণ্যসামগ্রী ভুয়া ডিক্লিয়ারেশন দিয়ে এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বিমানবন্দর দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। এ পরিসংখ্যান থেকেই বুঝা যায় কি পরিমাণ পণ্যসামগ্রী সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে বের করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২০:৩৭ ৪৪৯ বার পঠিত