বঙ্গনিউজ ডটকমঃ ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যানের সাজায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ‘অবমাননাকর’ বিবৃতি দেওয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জাফর উল্লাহ চৌধুরীকে সাজা দিয়েছে আদালত।শাস্তি হিসাবে তাকে এক ঘণ্টা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছে এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা না দিলে তাকে একমাস জেল খাটতে হবে।
একই ঘটনায় আরও ২২ বিবৃতিদাতাকে অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বুধবার এই রায় দেয়।
ব্লগে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ লেখার মাধ্যমে বিচারাধীন বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর দায়ে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে গতবছর ২ ডিসেম্বর সাজা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ৫০ জন নাগরিকের একটি বিবৃতি একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
ওই বিবৃতি ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রতি কটাক্ষ’ মনে হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল বিবৃতিদাতাদের আচরণের ব্যাখ্যা চায়।
৫০ বিবৃতিদাতার মধ্যে ২৬ জন নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। আর একজন আগেই বিবৃতি থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন।
বাকি ২৩ জনের বিরুদ্ধে গত ১ এপ্রিল অবমাননার রুল জারি করে ট্রাইব্যুনাল-২। ১৪ মে ওই ২৩ জনের দেওয়া জবাবের ওপর শুনানি করে আদালত রায়ের দিন ঠিক করে দেন।
এর মধ্যে ২২ জনকে বুধবার রায়ে আদালত অবমাননার সাজা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন বিচারক। কিন্তু এর আগেও একটি ঘটনায় অবমাননার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল জাফর উল্লাহ চৌধুরীকে সতর্ক করে দিয়েছিল বলে এবার তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে।
সেই ঘটনাটি ছিল ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে প্রচারিত ‘মুক্তবাক’ অনুষ্ঠানে দুই আলোচকের বক্তব্য নিয়ে।
আলোচক জাফর উল্লাহ চৌধুরী এবং সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের সেক্রেটারি জেনারেল মাহফুজ উল্লাহ সেখানে দাবি করেন, ট্রাইব্যুনালের মামলায় যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ‘অধিকার খর্ব’ করা হয়েছে এবং এতে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ‘সন্দেহ’ সৃষ্টি হবে।
এরপর চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী পরিচালক, হেড অব প্রোগ্রাম, ‘মুক্তবাক’ অনুষ্ঠানের ওই পর্বের প্রযোজক, অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং দুই আলোচকের বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগ আনা হয় ট্রাইব্যুনালে।
এ বিষয়ে শুনানি শেষে গতবছর ১২ জুন ট্রাইব্যুনালের বিচারক তাদের সতর্ক করে দিয়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন।
সেই রায়ে বলা হয়, “যারা টকশোতে কথা বলেন,তারা অবশ্যই দায়িত্বশীল। দায়িত্বশীল ব্যাক্তিরা ভবিষ্যতে আদালত নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করার সময় দায়িত্ব নিয়ে মন্তব্য করবেন।”
এরপরও ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘অবমাননাকর’ বিবৃতি দেওয়ায় এবার জাফর উল্লাহ চৌধুরীকে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার সাজা এবং জরিমানা করে আদালত।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে অব্যাহতি পাওয়া ২২ জন হলেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, নারী অধিকারকর্মী শিরিন হক, নৃ-বিজ্ঞান গবেষক রেহনুমা আহমেদ, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক সি আর আবরার, সাংস্কৃতিক কর্মী লুবনা মারিয়াম, অধিকারকর্মী মুক্তাশ্রী চাকমা সাথী ও নারী গ্রন্থ প্রবর্তনার নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, সাংবাদিক ও লেখক আফসান চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক বীণা ডি কস্টা, লেখক শবনম নাদিয়া, লেখক মাহমুদ রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসরিন সিরাজ এ্যানি, আলাল ও দুলাল ব্লগের সম্পাদক তীব্র আলী, নৃবিজ্ঞানী দেলোয়ার হোসেন, মাসুদ খান, অ্যাডভোকেট জিয়াউর রহমান, জরিনা নাহার কবির, আলী আহম্মেদ জিয়াউদ্দিন, সঙ্গীতশিল্পী আনুশেহ আনাদিল, অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী লিসা গাজী।
প্রথমবার এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় আদালত তাদের সবাইকে ভবিষ্যতে বক্তব্য ও বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক করে অব্যাহতি দিয়েছে বলে অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ জানান।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ আদেশের পর সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ের ফলে বিবৃতিদাতাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই ট্রাইব্যুনালের ক্ষমা পেলেন।
৫০ নাগরিকের মধ্যে মানবাধিকার কর্মী ও নারীনেত্রী খুশি কবির ওই বিবৃতি প্রকাশের পরপরই নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ১৪ জনের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত।
ওইদিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান, সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ও আমেনা মহসিন, বাংলাদেশ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর ডা. নায়লা জামান খান, ড. শাহনাজ হুদা, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল, মানবাধিকারকর্মী জাকির হোসেন, সংগীত শিল্পী অরূপ রাহী, লেখক শাহীন আক্তার ও অধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান আদালতের ক্ষমা পান।
এরপর ৩ মার্চ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে রেহাই পান বিবৃতিদাতা আরও ১০ জন।
এরা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেইট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের শিক্ষক ড. আলী রিয়াজ, ড. পারভিন হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ফিরদৌস আজিম, প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ, মানবাধিকার আইনজীবী ড. ফস্টিনা পেরেইরা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিয়া হক, ড. সেঁউতি সবুর, তাসমিন সারা সাহাবুদ্দীন ও লেখক তাহমিমা আনাম।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দিনা এম সিদ্দিকী ও অধিকারকর্মী রেজাউর রহমানও পরে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে রেহাই পান।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩২:৫৭ ৭৪৫ বার পঠিত