বঙ্গনিউজ ডটকমঃ বিদ্যমান তথ্য প্রযুক্তি আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উদ্বেগের মধ্যে আইনটি সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।মঙ্গলবার ঢাকার এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “২০০৬ সালে এই আইনটি করার সময় এর ভিন্ন রকম ভ্যালু ছিল, সময়ের পরিবর্তনে যার আবেদন এখন বদলে গেছে। চলতি বছরের শেষে এর কিছু ধারার পরিবর্তন করে নতুন আইন করা হবে।”
‘আর্টিক্যাল নাইনটিন’ আয়োজিত সংসদ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে একথা বলেন আনিসুল হক। অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বারও ছিলেন।
ইন্টারনেটের প্রসারের পর ২০০৬ সালে তথ্য প্রযুক্তি আইন করে সরকার, যাতে কয়েকটি ক্ষেত্রে অপরাধের জন্য শাস্তির বিধানও রাখা হয়।
ওই আইনের ৪৬, ৫৭ ও ৭১ ধারা ‘বাক স্বাধীনতা পরিপন্থি’ বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ। মঙ্গলবারের আলোচনা সভায়ও বিষয়গুলো উঠে।
৪৬ ধারায় বলা আছে- বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, নিরাপত্তা কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নস্যাতের মতো কোনো কিছু প্রকাশ হলে সে তথ্য সম্প্রচারে বাধা দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ।
৫৭ ধারায় রয়েছে- ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোনো ব্যক্তির তথ্য যদি নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করে, এতে যদি কারও মানহানি ঘটে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তা হবে অপরাধ। এর শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা।
৭১ ধারায় অভিযুক্তদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে সাইবার ট্রাইব্যুনালকে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়।
আইনের এই ধারাগুলোর বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ, এতে নাগরিকদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। উল্টো পুলিশ যখন খুশি তখন যে কাউকে এই আইনের আওতায় গ্রেপ্তারের সুযোগ নিতে পারে।
আর্টিক্যাল নাইনটিন-এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক তাহমিনা রহমান বলেন, “আইসিটি অ্যাক্টের ৪৬ ও ৫৭ ধারায় বর্ণিত নির্দেশনা ইন্টারনেটে মত প্রকাশে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির বিরোধী। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি করেছে।”
২০০৬ সালে আইনটি প্রণয়নের পর ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফায় কয়েকটি ধারায় সংশোধন করা হয়। তবে আইনটি এখনও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছেনি বলে বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ।
ব্লগারদের মধ্যে আইরিন সুলতানাসহ কয়েকজন আলোচনায় অংশ নেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, “সময়ের পরিবর্তনে আইনের পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ব্রিটেনেও দুই বছর পর পর আইন রিভিউ করা হয়।
“আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় সংজ্ঞায়নেরও কিছু সমস্যা রয়েছে। এছাড়া আরও কিছু অসঙ্গতি রয়েছে, যা পরিবর্তনযোগ্য।”
মোস্তফা জব্বার বলেন, বিদ্যমান আইনটি বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়। আইসিটি ছাড়াও আরও দেড়শ আইন রয়েছে ডিজিটাল যুগে যার পরিবর্তন জরুরি। দেশে ডিজিটাল অপরাধ দমন আইন প্রণয়ন করা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ৫৭ ধারায় বর্ণিত দণ্ড পেনাল কোডের অনেক ধারার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিক অবরাধ করলে যেখানে মাত্র চার বছরের দণ্ডের বিধান রয়েছে, আইসিটি অ্যাক্টে সমান অপরাধ ইন্টারনেটে করলে ১৪ বছর কারাদণ্ডের কথা বলা আছে।
সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে আরও একটি নতুন আইন প্রণয়ন হচ্ছে জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, তাতে বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড উভয় বজায় রাখা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, “অফ লাইনের অপরাধের চেয়ে অনলাইনের অপরাধের প্রভাব অনেক বড়। তাই এর শাস্তিও বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত।”
বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের গুরুত্ব স্বীকার করে তিনি বলেন, “সাইবার সিকিউরিটি আইনের অভাবে আজ এতকিছু হচ্ছে। আইসিটি ডিভিশন ইতোমধ্যেই এই সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া করেছে, যা ধীরে ধীরে পরিণতির দিকে যাবে।”
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী, কাজী ফিরোজ রশীদ, শিরিন আখতার, মোয়াজ্জম হোসেন রতন, হোসনে আরা বেগম ডালিয়াও বক্তব্য রাখেন।
হোসনে আরা বলেন, “বাংলাদেশে কী পরিস্থিতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি করা হয়েছে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারা ব্লগার আর কারা ব্লগার না, সেটাও ঠিক করতে হবে।”
রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, “৯০ ভাগ মুসলিমের এই দেশে সবারই বলার অধিকার আছে। তবে অন্যের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার কারও নেই। যখন তখন এই আইনে হাত দেওয়া ঠিক হবে না।”
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫১:৪৮ ৩০৪ বার পঠিত