বঙ্গনিউজ ডটকমঃ মুক্ত মত প্রকাশের দারুণ সমর্থক ছিলেন পাকিস্তানের মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মী সাবিন মাহমুদ। তিনি করাচিভিত্তিক এমন এক ক্যাফে পরিচালনা করতেন, যেখানে রাজনীতি, সমাজ ও মানবাধিকার নিয়ে সবার খোলাখুলি মত প্রকাশের সুযোগ ছিল। মাস দেড়েক আগে এই মুক্তমনা মানুষটির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। দিনটি ছিল ২৪ এপ্রিল। গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। একজন বন্দুকধারীর গুলি প্রাণ কেড়ে নেয় তাঁর। কাছেই বসে ছিলেন মা। চোখের সামনে মেয়েকে লুটিয়ে পড়তে দেখেন তিনি। প্রাক শৈশব শিক্ষার পুরোধা ৬৪ বছর বয়সী এই মা বিবিসি অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন সেই বেদনাদায়ক ঘটনা এবং মেয়ের নানা কর্মকাণ্ডের কথা।
করাচি-ভিত্তিক ক্যাফে দ্য সেকেন্ড ফ্লোরের (টিটুএফ) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিলেন সাবিন (৪০)। সংগঠনটি নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করে থাকে। মানুষের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আয়োজিত একটি সেমিনার থেকে ফেরার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মা বলেন, অস্ত্রধারীদের এগিয়ে আসতে দেখে ভেবেছিলাম ছিনতাইকারী। তারা হাতব্যাগ বা মোবাইল ফোনটি হয়তো ছিনিয়ে নিতে চায়। করাচিতে এটা এখন বেশ স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু যখন গুলির শব্দ পেলাম, দেখলাম আমাদের গাড়ির কাচ ভেঙে চুরমার, মেয়ে আমার গুলিবিদ্ধ হলো…নিমেষে মিলিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা। আমার গায়ে লাগল দুটি গুলি। মেয়ের গায়ে লাগে পাঁচটি। রক্তে ভেসে গেল গাড়ির ভেতরটা। আমি পেছনের আসন থেকে দ্রুত সামনের আসনের দিকে গেলাম। মেয়েকে বললাম, ‘সাবিন, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? কিছু বলো। আমরা তোমাকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’আমাদের গাড়িচালক দ্রুত আমাদের হাসপাতালে পৌঁছে দিল। ওই হাসপাতালে আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। সাবিনকে নেওয়া হয় হাসপাতালেরই অন্য কোথাও। আসলে আমার মেয়েকে নেওয়া হচ্ছিল মর্গে। আমাকে আরেকটি বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় তারা। খবর শুনে বহু লোক হাসপাতালে ভিড় জমায়। টিভি চ্যানেলগুলো তাৎক্ষণিক খবরটি প্রচার করেছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দ্রুত এই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
সাবিনের জানাজা ও দাফন অনুষ্ঠানে অনেক মানুষ এসেছিল। কত মানুষ, আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে দুই হাজারের বেশি তো হবেই। ওই দিন বহু মানুষ আমাকে সশরীরে সান্ত্বনা জানাতে আসে। আমি অনেকটাই বিধ্বস্ত ছিলাম। এর পরও এই অনুভূতি হলো, সাবিন ছিল আমার পরিবার, আমার অংশ। সে আমার মেয়ে। কিন্তু এত মানুষ যারা শোক জানাতে এসেছে, তারা কারা? একটা শ্রদ্ধা-মিশ্রিত সম্মান অনুভব করলাম আমি।
পাকিস্তানের শহরের বস্তিগুলোতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া মেহনাজ মাহমুদ কীভাবে নিজের মেয়েকে গড়ে তুলেছিলেন, সে কথাও তুলে ধরেন লেখায়। তাঁর ভাষায়, আমার জন্ম ভারতের কলকাতায়। আমার বয়স যখন পাঁচ, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) ঢাকায় চলে যায় আমার পরিবার। আমার শৈশবটা কেটেছে চমৎকার। আমার দেখাশোনা করতেন একজন ক্যাথলিক নারী। প্রতি রোববার তাঁর সঙ্গে আমি গির্জায় যেতাম। কলকাতা ও ঢাকায় আমি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি, যা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। এ কারণে আমি আমার মেয়েকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছি। আমি তাকে এই বলে বলে বড় করেছি, ‘দেখো, সবাই ভালো। কেউই খারাপ নয়। দেশ, বর্ণ, ধর্ম, ধনী বা গরিব-কোনো কিছুই আসলে ব্যাপার না। আমরা সবাই সমান। সবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।’ মেয়ে আমার এই কথাগুলো আত্মস্থ করেছিল, সেভাবেই জীবনকে দেখেছে।
সাবিনের বয়স যখন ১৯, তখন স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে মা মেহনাজ মাহমুদের। এ ব্যাপারে মূল উদ্যোগ ছিল সাবিনেরই। বাবা-মায়ের দাম্পত্যের টানাপোড়েন বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন কলেজ পড়ুয়া সাবিন। তিনি একদিন মাকে বললেন, ‘দেখো মা, তুমি আমার জন্য এই বিয়েটা টিকিয়ে রেখো না। দোহাই লাগে, এটা করো না।’ তারপর নিজে আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে বাবা ও মায়ের স্বাক্ষর নিয়ে তাদের বিচ্ছেদ ঘটান সাবিন। এর পর থেকে মা আর মেয়ে মিলেই ছিল তাঁদের জগৎ।
মা মনে করেন, তাঁর মেয়েকে শুধু অধিকারকর্মী বা শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বর্ণনা করলে তা হবে তার প্রতি অবিচার। সে ছিল ন্যায়বিচারের পক্ষে। কোনো অন্যায় সে মেনে নিতে পারত না, প্রতিবাদ করত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে নিজেদের প্রকাশ করতে পারত না, তা নিয়ে ভাবনায় ছিল সাবিন। সে তাদের সুপরামর্শ দিত, চেষ্টা করত স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ দিতে। তাই তাকে একক কোনো পরিচয়ে আবদ্ধ করা যাবে না; সে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমি তাকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে মনে রাখতে চাই, যে মানুষের বাক-স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিল। ছিল প্রাণবন্ত, বুদ্ধিমতী, আমুদে আর অন্যের প্রতি দারুণ যত্নশীল।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৪:৩৮ ৩১৬ বার পঠিত