বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ ডা. শেজাদী আপসা চিকিত্সক হয়েও চিকিত্সাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। স্বামীর নিষেধ ছিল। তাই ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত সেনা কর্মকর্তা স্বামীর পথের কাঁটা ছিল ডা. শেজাদী। এ কারণে প্রায়ই তার উপর চলতো নির্যাতন। প্রেমের বিয়ে, আছে ১০ বছরের একটি ছেলে, তাই স্বামীর সব নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতেন তিনি। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় একবার শেজাদী চলে যান বাবার বাড়ি। দুই পরিবারের লোকজনের উপস্থিতিতে আর কখনো নির্যাতন করা হবে না স্বামীর এ আশ্বাসের পর এ মাসের ৭ তারিখে শেজাদী আবার স্বামীর কাছে ফিরেন। এতো কিছুর পরেও পারলেন না তিনি। তুচ্ছ একটি বিষয়ে ঝগড়ার পর স্বামী লে. কর্নেল শফিকুল ইসলামের পিটুনিতে গত ১৩ মে মারা যান শেজাদী। এর আগে সকাল পৌনে ১১টায় ছোট ভাই ডা. জাভেদ হোসেনকে ফোন করে নির্যাতনের বিষয়টি জানান ডা. শেজাদী। ভাইয়ের পরামর্শে কুমিল্লা সেনানিবাসের বাসা থেকে চিকিত্সা নিতে যান কুমিল্লা সিএমএইচে। চিকিত্সা নিয়ে বাসায় ফেরেন শেজাদী। দুপুর দেড়টার দিকে জাভেদ সেনানিবাসের বাসায় গিয়ে বোনের লাশ দেখতে পান। শেজাদীর স্বজনরা প্রশ্ন রেখে বলেন, স্বামীকে পরকীয়ায় বাধা দিলে কি পিটিয়ে মারতে হবে? আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
এ ঘটনায় ১৬ মে কুমিল্লা মডেল থানায় লে. কর্নেল শফিকুল ইসলামসহ ৪ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন ডা. জাভেদ। পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কোন আসামিকে গ্রেফতার করেনি। এদিকে সেনা আইন অনুযায়ী লে. কর্নেল শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে। শফিকুল ইসলাম নজরবন্দি আছেন। অন্যদিকে ডা. শেজাদী হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে দেশব্যাপী চিকিত্সকরা আন্দোলন শুরু করেছে। গতকাল কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে চিকিত্সকরা।
পুলিশ, নিহতের স্বজন ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালের ২৪ মার্চ নরসিংদী সদর উপজেলার ছগরিয়াপাড়া গ্রামের দেওয়ান আলীর ছেলে মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে একই উপজেলার জামালিয়াকান্দি গ্রামের মৃত শাহজাহান মিয়ার মেয়ে ডা. শেজাদী আপসারের (৩৪) বিয়ে হয়। কয়েক বছর আগে শফিকুল আয়েশা (মলি) নামে এক মহিলার সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। শফিকুল ইসলাম শান্তি মিশনে লাইবেরিয়ায় গেলে প্রেমিকা আয়েশা তার তত্কালীন কর্মস্থল চট্টগ্রামের হালিশহর আর্টিলারী ট্রেনিং সেন্টারের বাসার ঠিকানায় একটি চিঠি প্রেরণ করলে ওই চিঠি শেজাদীর হাতে পড়ে। শেজাদী স্বামীর পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি জানতে পারেন। শেজাদী বিষয়টি সেনাকর্মকর্তাদের অবহিত করলে শফিকুল ইসলামকে লাইবেরিয়া থেকে দেশে ফেরত আনা হয় এবং তার স্বীকারোক্তি নিয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়। এটা ডা. শেজাদীর জন্য কাল হয়ে দাড়ায়। এরপর তাকে পুনরায় লাইবেরিয়া যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, শফিকুল ইসলাম পরবর্তীতে লাইবেরিয়া থেকে দেশে ফিরে এসে পরকীয়া প্রেমের অভিযোগ করায় প্রতিশোধ হিসেবে স্ত্রী শেজাদীর ওপর শারীরিক-মানসিক অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে শেজাদী তার ছেলে আহনাফ ইনতিসার সামিনকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। পরবর্তীতে পারিবারিক বৈঠকের মাধ্যমে শফিকুল ইসলাম ও তার ভাই মফিজ উদ্দিনসহ আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধ ও নির্যাতন না করার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে শেজাদী গত ৭ মে শফিকুলের কুমিল্লা সেনানিবাসের নীলিমা-৭৪ নামক বাসায় ফিরে যান। এরপর তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা আগের চেয়ে বেড়ে যায়। একপর্যায়ে গত ১৩ মে সকাল ৭টার দিকে উভয়ের মধ্যে ঝগড়া বাধে। লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে শেজাদীকে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। পরে শফিকুল ইসলাম ফোনে শেজাদীর মা জাহানারা জাহানের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং তাকে কুমিল্লায় আসতে বলেন। খবর পেয়ে দুপুরে শেজাদীর ছোট ভাই ডা. মো. জাভেদ হোসেন ও তার মা জাহানারা জাহান কুমিল্লা সেনানিবাসের বাসায় এসে শেজাদীর লাশ তার বেডরুমের মেঝেতে চাদর দিয়ে ঢাকা অবস্থায় দেখেন। খবর পেয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের এরিয়া কমান্ডার ও জিওসি মেজর জেনারেল জাহিদুর রহমান, কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) আলী আশরাফ, সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম ও কোতয়ালী মডেল থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদসহ সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ওইদিন বিকাল ৩টার দিকে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর ময়না তদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায়। ময়না তদন্তের পর নিহতের লাশ কুমেক হাসপাতাল থেকে নিয়ে ঢাকার শাহজাহানপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। নিহত শেজাদীর ঠোঁট ও দাঁতের মাড়ী দিয়ে রক্ত পড়া, গলার পিছনে আঘাতের চিহ্নসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালো রক্তাক্ত জখমের দাগ রয়েছে বলে পুলিশ ও এজাহার সূত্রে জানা যায়। এ ঘটনায় ১৩ মে কোতয়ালী মডেল থানায় জিডি করা হয়। পরে ১৬ মে নিহতের ছোট ভাই ডা. মো. জাভেদ হোসেন (২৯) বাদী হয়ে শফিকুল ইসলামকে ১নং আসামি করে ৪ জনের বিরুদ্ধে কোতয়ালী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলার অন্য আসামিরা হচ্ছেন মফিজ উদ্দিন (৩২), আবদুল বাসেত (৪২) ও ইমদাদুল হক তালুকদার সোহেল (৪২)।
এ বিষয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের এরিয়া কমান্ডার ও জিওসি মেজর জেনারেল মো. জাহিদুর রহমান ১৬ মে সন্ধ্যায় জানান, ঘটনার পর থেকে ওই কর্মকর্তার কমান্ড রিমুভ করে সদরদপ্তরে যুক্ত করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য:
ডা. শেজাদী আপসার হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতয়ালী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ আইয়ুব গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জানান, ‘মামলাটি তদন্তের জন্য দায়িত্ব পেয়ে আমি সরেজমিনে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ভিকটিমকে নির্যাতনের বিষয়ে সাক্ষী-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
কুমিল্লায় চিকিত্সকদের মানববন্ধন:
এদিকে ডা. শেজাদী আপসার হত্যাকান্ডের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার সকালে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে চিকিত্সকরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালনসহ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এতে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় বিএমএ’র সহ-সভাপতি ডা. মহসিনুজ্জামান চৌধুরী, জেলা বিএমএ’র সভাপিত ডা. গোলাম মহিউদ্দিন দীপু, সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ। এসময় বক্তারা অবিলম্বে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
এরপর ২০০০ সালে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমবিবিএস তৃতীয়বর্ষে পড়ার সময় শেজাদীর বিয়ে হয়। ২০০২ সালে শেজাদী এমবিবিএস পাস করেন। নরসিংদীর সদর উপজেলার জামালিয়াকান্দি গ্রামের প্রয়াত শাহজাহান মিয়া ও জাহান আরার ৩ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে শেজাদী সবার বড়। পরিবারের ৪ ভাই-বোনের একজন আইনজীবী, অন্য ৩ জন চিকিত্সক।
বাংলাদেশ সময়: ১০:৩৫:২৭ ৫১৬ বার পঠিত