ডেস্কঃভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। দেশের ভেতরে ও সীমানা ঘিরে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার মতো একাধিক ফাটলরেখা (টেকটোনিক প্লেট বাউন্ডারি চ্যুতি বা পিবিএফ) রয়েছে। এ ছাড়া রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো ফাটলরেখা রয়েছে দেশের মধ্যেও। তাই ভূমিকম্প নিয়ে সাবধান হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশে পরিচালিত দেশি-বিদেশি একদল বিশেষজ্ঞ গবেষকের একটি যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। দলটিতে জাপান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের কয়েকজন গবেষক কাজ করেছেন।
অবশ্য তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য আপাতত স্বস্তির কথাও রয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরের সন্নিহিত অঞ্চলে অনেকগুলো ফাটলরেখা থাকলেও নিকট ভবিষ্যতে সেগুলো বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্পের উৎসস্থল (এপিসেন্টার) হওয়ার আশঙ্কা কম।
‘টাইম প্রেডিক্টেবল ফল্ট মডেলিং ফর সাইসমিক হ্যাজার্ড অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক এই গবেষণাটি চালানো হয় ২০০৯-১০ সালে। দেশের ভেতরে ও সীমানাসংলগ্ন অঞ্চলের ফাটলরেখায় (পিডিএফ) ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা নির্ধারণ ছিল এই গবেষণার বিষয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এ অঞ্চলের পিডিএফগুলোতে আগে যত সময়ের ব্যবধানে একেকটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে, সেই হিসাব অনুযায়ী নিকট ভবিষ্যতে তেমন কিছু হওয়ার কথা নয়। তবে পিডিএফ ছাড়া যে ফাটলরেখাগুলো আছে, বিশেষ করে ডাউকি ও মধুপুর ফাটলরেখা, সেগুলো অদূর ভবিষ্যতেও মধ্যম মাত্রার (রিখটার স্কেলে ৭ পর্যন্ত) ভূমিকম্পের উৎসস্থল হতে পারে। এ ছাড়া অচিহ্নিত কিছু ফাটলরেখা থাকাও অস্বাভাবিক নয়।
সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) অধীনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা ডিএফআইডি এই গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল গবেষণার প্রতিটি পর্যায় পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছেন। দলে অন্য সদস্যরা ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সফিউল্লাহ, অধ্যাপক মেহেদী আহম্মেদ আনসারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফতাব আলম খান ও একই বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হক (প্রয়াত)। গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ, বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ও সিডিএমপির তৎকালীন জাতীয় বিশেষজ্ঞ এ এস এম মাকসুদ কামাল।
বিপজ্জনক ফাটলরেখাগুলো
ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে সদা সঞ্চরণশীল পূর্বোক্ত পিবিএফ। বাংলাদেশের অবস্থান ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটে। এই প্লেটের দুপাশে রয়েছে ইউরেশীয় প্লেট ও বার্মিজ সাব-প্লেট। বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও পূর্বে ওই দুটি প্লেটের প্রান্তসীমা। এই প্লেটগুলোর প্রান্তবর্তী অধিকাংশ ফাটলরেখাই বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে কিংবা সংলগ্ন এলাকায়।
ফলে এসব ফাটলরেখায় বড় কোনো ভূমিকম্পের সৃষ্টি হলে দেশের মধ্যে তার প্রভাব বিধ্বংসী হবে। তাই সাবধানতা ও সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে। অবশ্য স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে এসব ফাটলরেখা বড় ভূমিকম্পের উৎস হওয়ার সম্ভাবনা কম।
গবেষকেরা বাংলাদেশ-সংলগ্ন পিবিএফগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন-পিবিএফ-১, পিবিএফ-২ ও পিবিএফ-৩। এগুলোতে বড় ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। পিবিএফ ছাড়াও দেশের মধ্যে অন্তত দুটি বড় ফাটলরেখা রয়েছে। একটি ডাউকি, অপরটি মধুপুর ফাটলরেখা। এর মধ্যে মধুপুর ঢাকার জন্য বিপজ্জনক। অতীতে পিবিএফ এবং এ দুটি ফাটলরেখা থেকে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতেও হতে পারে।
কবে হতে পারে
গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল উপরে উল্লিখিত ফাটলরেখাগুলোতে ভূমিকম্প কবে হতে পারে তার সম্ভাব্যতা নির্ণয় করা। এ জন্য উক্ত পাঁচটি ফাটলরেখার প্রতিটির আলাদা আলাদা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করে তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে কয়েকটি জায়গায় পরিখা খনন করে এবং ফাটলরেখা থেকে সংগৃহীত কাঠ ও অন্যান্য বস্তুকণার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই ফাটলরেখাগুলো থেকে সৃষ্ট অতীতের একাধিক ভূমিকম্পের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান (রেকারেন্স পিরিয়ড) নির্ধারণ করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, তিনটি পিবিএফেরই রেকারেন্স পিরিয়ড ৯০০ বছর। অর্থাৎ এই ফাটলরেখাগুলো অতীতে যেসব বিধ্বংসী ভূমিকম্পের (রিখটার স্কেলে সাড়ে সাত বা তার বেশি মাত্রার) উৎপত্তিস্থল হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে, এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান হবে ৯০০ বছর।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পিবিএফ-১ থেকে সর্বশেষ বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল ২৪৬ বছর আগে। পিবিএফ-২ ও পিবিএফ-৩ থেকে হয়েছিল ৫০৮ বছর আগে। কাজেই রেকারেন্স পিরিয়ড (৯০০ বছর) শেষ হয়ে এই ফাটলরেখাগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিধ্বংসী ভূমিকম্প (ক্যারেক্টারস্টিক আর্থকোয়েক) সৃষ্টি হতে এখনো বহু বছর বাকি।
পিবিএফ ছাড়া ডাউকি ফাটলরেখায় সর্বশেষ বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে, এখন থেকে প্রায় ১১৮ বছর আগে। গবেষণায় নির্ণিত ডাউকির রেকারেন্স পিরিয়ড ২৫০ থেকে ৩৫০ বছর। মধুপুর ফাটলরেখায় সর্বশেষ বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয় ১৮৮৫ সালে, এখন থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে। মধুপুরের রেকারেন্স পিরিয়ডও ৩৫০ বছর। কাজেই গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী এ দুটি ফাটলরেখায় আগামী ২২৫ থেকে ২৪০ বছরের মধ্যে বিধ্বংসী ভূমিকম্প (ক্যারেক্টারস্টিক আর্থকোয়েক) সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা কম।
তবু চিন্তার কারণ আছে
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, রেকারেন্স পিরিয়ডের মধ্যবর্তী প্রতি ২০ বছর পর পর এসব ফাটলরেখা থেকে ৭ মাত্রার কাছাকাছি পর্যন্ত ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। গবেষণার ভাষায় এগুলোকে বলা হয়েছে ওই ফাটলরেখাগুলোর ‘নন-ক্যারেক্টারস্টিক’ ভূমিকম্প।
ডাউকি এ ধরনের ভূমিকম্পের উৎসস্থল হলে সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চলের জন্য এবং মধুপুর উৎসস্থল হলে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও ঢাকার জন্য তা ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তবে জাতীয় গৃহনির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ভবন নির্মাণ করে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এই ধ্বংসের মাত্রা সীমিত রাখা সম্ভব বলে গবেষকেরা মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, একেকটি অঞ্চলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা সম্পর্কে জেনে-বুঝে সে অনুযায়ী ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ করলে এবং ভূমিকম্পের সময় ও পরের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হলে মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সীমিত রাখা সম্ভব।
অন্যান্য ফাটলরেখা
ওপরে উল্লিখিত পাঁচটি বিপজ্জনক ফাটলরেখা ছাড়াও দেশের ভেতরে আরও কয়েকটি ফাটলরেখা আছে বলে অনেকে মনে করেন। এর একটি (মানিকগঞ্জ, মতান্তরে বগুড়া ফাটলরেখা) থেকে ১৮৮৫ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। ১৯১৮ সালে আরও বড় ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল শ্রীমঙ্গল। এ ছাড়া গঙ্গা (রাজশাহী) ও সীতাকুণ্ড ফাটলরেখারও অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেক ভূতত্ত্ববিদ মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, মানিকগঞ্জ বা বগুড়া ফাটলরেখা যেটিকে বলা হয়, গবেষণায় দেখা গেছে, সেটি আসলে মধুপুর ফাটলরেখারই অংশ। একইভাবে শ্রীমঙ্গল ফাটলরেখা পিবিএফ-২-এর এবং সীতাকুণ্ড পিবিএফ-১-এর অংশ। আর গঙ্গা ফাটলরেখাটি বাংলাদেশের ভূ-সীমানায় সক্রিয় নয়।
পদ্মা-মেঘনা ও যমুনা নদীর মিলনস্থল চাঁদপুর অঞ্চলে নির্দিষ্ট কোনো ফাটলরেখার অবস্থান নির্ণিত না হলেও অঞ্চলটির ভূ-প্রকৃতি নাজুক বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ভূ-তত্ত্ববিদ। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (জিএসবি) সংশ্লিষ্ট গবেষক-কর্মকর্তারা প্রতিবেদককে বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মঝেমধ্যেই ৪ বা তার কিছু বেশি মাত্রার যে ভূমিকম্পগুলো হয়ে থাকে, সেগুলোর উৎস কিছু সাধারণ ফাটলরেখা (বেইজমেন্ট কন্ট্রোল ফল্ট)। এগুলোতে বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এমনকি বারবার হওয়া এসব ভূমিকম্প বিধ্বংসী কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও নয়। কারণ, বিপজ্জনক ফাটলরেখা ছাড়া বিধ্বংসী ভূমিকম্প সৃষ্টির নজির নেই।
এই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল ও জিএসবির বিজ্ঞানীরা এই প্রতিবেদককে বলেন, বড় ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর মৃদু যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে এবং মাঝারি যেসব ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেগুলো মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এই প্রস্তুতি হতে হবে চার ধরনের। এক, মানসম্পন্ন ভবন নির্মাণ। দুই, ভূমিকম্প হলে করণীয় কী সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি। তিন, ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্য অর্জন। চার, জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ পুনঃ শক্তিশালী (রেট্রোফিটিং) করা, যাতে জরুরি প্রয়োজনের সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ প্রয়োজনীয় সাড়া দিতে পারে।
মাকসুদ কামাল বলেন, সীমিত পরিসরে করা ‘ফল্ট মডেলিং’-এর গবেষণাটি আরও এগিয়ে নেওয়া দরকার। দেশের প্রধান প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ শহর-নগরের ঝুঁকি হ্রাসের কার্যক্রমও চালিয়ে যাওয়া জরুরি। কারণ, ফল্ট মডেলিংয়ের মাধ্যমেই কোনো অঞ্চল বা দেশের ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতি (সাইসমিক স্ট্যাটাস) জানা যায়। আর তার ভিত্তিতে তৈরি করা দরকার নির্মাণ বিধিমালা।
বাংলাদেশ সময়: ১০:১৫:১১ ৫৪১ বার পঠিত