খোকন: তিন ম্যাচের সিরিজের এক ম্যাচ হাতে রেখেই পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয় করে নিল টিম বাংলাদেশ। মিরপুরে দ্বিতীয় ম্যাচে পাকিস্তানকে ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজ জিতে নিল মাশরাফি বিন মর্তুজারা।
পাকিস্তানের করা ২৩৯ রান তাড়া করতে নেমে ৩৮.১ ওভারেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় টিম মাশরাফি। পুরো ম্যাচে কখনওই মনে হয়নি বাংলাদেশ হেরে যেতে পারে। সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুধ করলো বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করে অসাধারণ এই জয়ে অবদান রাখলেন ওপেনার তামিম ইকবাল। ১১৬ রানে শেষ পর্যন্ত অপরাজিতই থাকলেন তিনি। অসাধারণ অবদান ছিল মুশফিকুর রজিমেরও। ৭০ বলে শুধু ৬৫ রানেই করলেন না। তামিমের সঙ্গে গড়লেন ১১৮ রানের গুরুত্বপুর্ণ একটি জুটিও।
পাকিস্তানের ওয়াহাব রিয়াজ, জুনায়েদ খান কিংবা রাহাত আলিদের মতো পেসারদের চোখ রাঙানিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন তামিম ইকবালরা। পাত্তাই দিলেন না সাঈদ আজমলকে। একের পর এক বাউন্ডারিতে স্বাগতম জানিয়েছেন পাকিস্তানি বোলারদের। ১৯৯২ বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের এই দলটির চেয়ে যে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি শক্তিশালি, অনেক পরিণত একটি দল, সেটা মাঠের প্রতিটি নড়চড়াতেই বুঝিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
২০১০ সালেই নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ বুঝিয়ে দিয়েছিল ঘরের মাঠে তারা কতটা শক্তিশালি। এরপর তো কিউইদের আরও একবার হোয়াইটওয়াশ করেছিল। বিশ্বকাপের আগে সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। তার ধারাবাহিকতা ছিল বিশ্বকাপে। উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে পাকিস্তান সিরিজেও।
তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই সিরিজটি ঐতিহাসিক। ১৯৯৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে জাগরণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই দেশটিকে টেস্ট মর্যাদা দেওয়া হবে কি হবে না, তা নিয়ে যখন ব্যাপক জ্বল্পনা ওঠে, তখনই ১৯৯৯ বিশ্বকাপে প্রথম কোন টেস্ট প্লেইং দেশ হিসেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় পায় বাংলাদেশ। যেটা নতুন মাত্রা যোগ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। টেস্ট মর্যাদার দাবি জোরালো করে এবং ক্রিকেটের কুলীন শ্রেনীর অন্তর্ভূক্তও করে দেয়।
অথচ, সেই পাকিস্তানকে গত ১৬ বছর আর হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু সবগুরো পরাশক্তিকেই হারানো গেছে। কিন্তু পাকিস্তান ছিল অজেয়ই। অনেকবার কাছাকাছি গিয়েও জয় ধরা দিল না বাংলাদেশের হাতে। কখনও কম রানে অলআউট করে দিয়ে, আবার কখনও ৩২৬ রানের মত স্কোর করেও জয় অধরা। পাকিস্তান যেন কঠিন-দুর্বোধ্য একটি দল বাংলাদেশের সামনে। অবশেষে ১৬ বছরের আক্ষেপের অবসান হলো শুক্রবার। ৭৯ রানে দাপটের সঙ্গে জয় দিয়ে শুরু হলো সিরিজ জয়ের মিশন। যার পূর্ণতা পেলো আজ, দ্বিতীয় ম্যাচে ৭ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে হারিয়ে। এবার তৃতীয় ম্যাচে হারানো গেলে পূর্ণতা পাবে হোয়াইটওয়াশ কীর্তির।
পাকিস্তানের ছুড়ে দেওয়া ২৩৯ রান তাড়া করতে নেমে সূচনাটা ভালোই করেছিল বাংলাদেশের দুই ওপেনার সৌম্য সরকার এবং তামিম ইকবাল। কিন্তু তৃতীয় ওভারের পঞ্চম বলে জুনায়েদ খানের আউট সুইঙ্গারে ঠিকমত ব্যাট চালাতে পারেননি সৌম্য সরকরা। ব্যাটের কানায় লাগিয়ে ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে সরফরাজ আহমেদের হাতে।
দলীয় ২২ এবং ব্যাক্তিগত ১৭ রানে ফিরে গেলেন সৌম্য সরকার। মাত্র ১১ বল খেলে চারটি বাউন্ডারিতে এই ১৭ রান করেন সৌম্য। অপর ওপেনার তামিম ইকবাল ৬ বল খেলে ৪ রান নিয়ে ক্রিজে রয়েছেন।
সৌম্য সরকারকে দ্রুত হারালেও দমে যায়নি বাংলাদেশ। দমে যাননি তামিম ইকবালও। বরং, রীতিমত টর্নেডো বইয়ে দিচ্ছেন পাকিস্তানি বোলারদের ওপর। একের পর এক বাউন্ডারি ছাড়া করছেন জুনায়েদ খান, রাহাত আলি কিংবা সাঈদ আজমলদের। ৬ষ্ঠ ওভারে রাহাত আলিকে, ৯ম ওভারে সাঈদ আজমলকে এবং ১০ ওভারে ওয়াহাব রিয়াজকে পরপর তিনবার করে বাউন্ডারি ছাড়া করেন তামিম।
বাংলাদেশের এই ড্যাশিং ওপেনারের ব্যাটিং তাণ্ডবে ৯ ওভারেই বাংলাদেশের রান ৭০ পার হয়ে যায়। এর একটু পরই ৩১ বলে হাফ সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করেন তামিম। ১২ বাউন্ডারিতে এই অসাধারণ কীর্তি গড়েন তিনি।
তামিমের হাফ সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানিদের ওপর ছড়াও হয়ে বসতে না বসতেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের উইকেট হারায় বাংলাদেশ। সাঈদ আজমলকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে পুরোপুরি পরাস্ত হন মাহমুদুল্লাহ। বল গিয়ে আঘাত হানে সোজা তার স্ট্যাম্পে। অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের অজুহাতে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার পর এটাই আজমলের প্রথম উইকেট।
রিয়াদ ফিরে গেলেও তামিমের সঙ্গে এসে জুটি বাধলেন মুশফিকুর রহিম এবং বাংলাদেশের রানের চাকা দুর্দান্ত গতিতে সচল রাখেন এই দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। শেষ পর্যন্ত ১১৮ রানের জুটি গড়ে বিচ্ছিন্ন দু’জন। এর আগেই টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে গেলেন তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করলেন তামিম। এর আগে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করেছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
৩১ বলে হাফ সেঞ্চুরি করলেও সেঞ্চুরি পেতে বেশ সময় নেন তামিম। ১০৮ বলে ক্যারিয়ারের ৬ষ্ঠ সেঞ্চুরির দেখা পেলেন বাংলাদেশ ওপেনার। বাউন্ডারির মার ছিল তাতে ১৬টি। শুধু তামিম সেঞ্চুরিই করেননি। সঙ্গে হাফ সেঞ্চুরি করেছে মুশফিকুর রহিমও। ৫৭ বলে ৬টি বাউন্ডারি আর একটি ছক্কায় ক্যারিয়ারের ২২তম হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করেন বাংলাদেশের উইকেট রক্ষক ব্যাটসম্যান। এরপর অবশ্য ৭০ বলে ৬৫ রান করে রাহাত আলির বলে ফাওয়াদ আলমের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান মুশফিক। দলের রান এ সময় ২১৮ রান।
মুশফিক আউট হয়ে গেলেও জয়ের জন্য বাকি কাজটা খুব সহজেই শেষ করে দিয়ে যান তামিম আর সাকিব। ১১৬ বলে ১১৬ রান করে অপরাজিত ছিলেন তামিম ইকবাল। আর ৭ রানে অপরাজিত থাকেন সাকিব আল হাসান।
সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড
পাকিস্তান: ২৩৯/৬, ৫০ ওভার ( সাদ নাসিম ৭৭*, ওয়াহাব রিয়াজ ৫১*, হারিস সোহেল ৪৪, আজহার আলি ৩৬, মোহাম্মদ রিজওয়ান ১৩, সরফরাজ আহমেদ ৭; সাকিব আল হাসান ২/৫১, নাসির ১/১৭, রুবেল ১/২৭, আরাফাত সানি ১/৪১, মাশরাফি ১/৫১)।
বাংলাদেশ: ২৪০/৩, ৩৮.১ ওভার ( তামিম ১১৬*, মুশফিক ৬৫, সৌম্য সরকার ১৭, মাহমুদুল্লাহ ১৭, সাকিব ৭*; সাঈদ আজমল ১/৪৬, রাহাত আলি ১/৫৭, জুনায়েদ খান ১/৬১)।
ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী। ম্যাচ সেরা: তামিম ইকবাল। টস: পাকিস্তান।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩৬:২১ ২৭৫ বার পঠিত