বঙ্গনিউজ ডটকমঃ ইয়েমেনে হামলায় সৌদি আরব যে এফ-১৫ বিমান ব্যবহার করছে সেগুলো আমেরিকান কোম্পানি বোয়িং থেকে কেনা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৈমানিকরা ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় এফ-১৬ নামের যে বিমান থেকে বোমা ফেলছে সেগুলো মার্কিন কোম্পানি লকহীড মার্টিনের তৈরি।
প্রতিবেশীদের ওপর নজরদারি করার জন্য আমিরাত খুব শিগগিরই আরেক আমেরিকান কোম্পানি জেনারেল অ্যাটোমিক্স-এর কাছ থেকে এক ঝাঁক অত্যাধুনিক প্রিডেটর ড্রোন কেনার চুক্তি করতে যাচ্ছে।
এভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যতই যুদ্ধ, গোষ্ঠিগত দ্বন্দ্ব এবং উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িত হচ্ছে ততই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিগত বছরগুলোতে কেনা সামরিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করছে এবং একই ধরনের অস্ত্র-সরঞ্জাম আরো চাচ্ছে। এর ফলে এই অঞ্চলের শক্তিগুলোর মধ্যে বিপজ্জনক অস্ত্রপ্রতিযোগিতা বাড়লেও আমেরিকান অস্ত্র ব্যবসায়ীদের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে।
গত সপ্তাহে দেশটির অস্ত্র শিল্পের উর্ধ্বতন কর্তারা কংগ্রেসকে জানিয়েছেন যে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তারা সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, জর্ডান এবং মিশরের মতো আরব মিত্রদের কাছ থেকে হাজার হাজার মিসাইল, বোমাসহ অন্যান্য অস্ত্র কেনার অর্ডার আসবে বলে আশা করছেন।
এতে গত এক বছর থেকে প্রায় অলস পড়ে থাকা তাদের অস্ত্রগুদামগুলো আবার সরগরম হয়ে উঠবে।
আরবদের ঐতিহাসিক শত্রু ইসরাইলের সামরিক স্বার্থ রক্ষার্থে আমেরিকান কোম্পানিগুলো কী ধরনের অস্ত্র আরবদের কাছে বিক্রি করতে পারবে তার ওপর দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের বিধি নিষেধ আরোপ করে রেখেছে। কিন্তু বর্তমানে ইরানকে মোকাবিলায় প্রকৃতপক্ষে ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর মিত্রতা চলছে।
এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখন উপসারগরীয় দেশগুলোর কাছে সর্বশেষ প্রযুক্তি সম্বলিত অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করতে ওবামা প্রশাসন আগের চেয়ে অনেকটা আগ্রহী। যদিও এ ব্যাপারে ইসরাইলে কিছুটা প্রকাশ্য আপত্তি রয়েছে।
২০০৮ সালে মার্কিন কংগ্রেস ইসরাইলের সামরিক সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে এমন কোনো অস্ত্র আরবদের কাছে না বিক্রি করতে আইন পাস করে। তবে বর্তমানে ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন শক্তিকে মোকাবিলায় বাছাইকৃত কয়েকটি আরব দেশের সেনাবাহিনীগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলার ব্যাপারটিও ভাবছে ওবামা প্রশাসন।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক অ্যান্থনী এইচ কোর্ডেসম্যান বলেন, আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন ইসরাইলের কৌশলগত হিসাবনিকাশ খুবই সাধারণ। উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরাইলের জন্য বাস্তবে কোনো হুমকিই নয়। তবে তারা ইরানের বিপরীতে জোরালো একটা প্রতিপক্ষ।
অস্ত্রশিল্পের বিশ্লেষক এবং মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলে চলমান অস্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য শিয়াপন্থী ইরানের বিরুদ্ধে সুন্নী দেশগুলো লড়ে যাওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র কেনার হিড়িক পড়ে যাবে।
টীল গ্রুপের বিশ্লেষক রিচার্ড এল. আবুলাফিয়া বলেন, এতদিন ধরে উপসাগরীয় সেনাবাহিনীগুলো মূলত ‘আত্মরক্ষার প্রতীক’ আর ‘বিমান চালনার জাতীয় ক্লাব’- এই দুইয়ের মাঝামাঝি কিছু একটা ছিল। তবে এখন হঠাৎ করে তাদেরকে কাজা লাগানো হচ্ছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সৌদি আরব ৮০ বিলিয়ন ডলারের (৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা) অস্ত্র কিনেছে। যেটা দেশটির ইতিহাসে কেনা সবচেয়ে বড় অস্ত্রের চালান।
এমনকি, দেশটি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের চেয়েও বেশি অস্ত্র কেনে এ বছর। একই বছর আরব আমিরাত কিনেছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা) অস্ত্র, যা দেশটির ২০০৬ সালে কেনা অস্ত্রের তিনগুণ।
কাতারও এখন অস্ত্র কেনার নেশায় মেতেছে। গত বছর পেন্টাগনের সাথে ১১ বিলিয়ন ডলারের অ্যাপাচি আ্যাটাক হেলিকপ্টার এবং প্যাট্রিয়ট ও জ্যাভেলিন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে দেশটি। এখন চাচ্ছে তাদের কাছে বর্তমানে থাকা ফ্রান্সের তৈরি মিরেজ জেট বাদ দিয়ে বোয়িংয়ের তৈরি এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের একটি বিশাল চালান কিনতে।
আগামী মাসে উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতাদের ওয়াশিংটন সফরের সময় কাতারের পক্ষ থেকে ওবামা প্রশাসনকে অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনার একটা তালিকা দেয়া হবে।
এদিকে আমেরিকান অস্ত্র কোম্পানিগুলো টাকার পেছনেই লেগেছে। একাধিক কোম্পানি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের শাখা খুলেছে। পেন্টাগনের বাজেট সংকোচনের মধ্যে অনেকে চাচ্ছে আগামী বছরগুলোতে তাদের আয় বাড়াতে ব্যবসা আরো প্রসারিত করতে।
যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রক্সি যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে আমেরিকার ‘আলাদিনের চেরাগ’ বলে পরিচিত এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য আগ্রহী করে তুলবে।
এই বিমানটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধাস্ত্র যেটির অনেক্ষ অজানা ক্ষমতা রয়েছে। এটি এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন মিত্রদের কাছে বিক্রি করা হলেও ইসরাইলের সেনাবাহিনীর কথা মাথায় রেখে এখনো আরবদের কাছে বিক্রি করা হয়নি।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন হতে থাকলে এবং রাশিয়া ইরানকে আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করলে এফ-৩৫ বিমানের চাহিদা বেড়ে যাবে। কারণ, শুধু এটি দিয়েই সম্ভবত রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ভেদ করে ইরানে হামলা চালানো সম্ভবত হবে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আরবরা এটিকে কতটা সঠিক পথে ব্যবহার করবে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অভিযোগ তুলেছে, ইয়েমেনে হামলার জন্য দেয়া অনেক অস্ত্র সৌদি আরব সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। যদিও দেশটি তা অস্বীকার করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:২৭:৪৭ ৩৩১ বার পঠিত