বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী ও সমমনা বিশিষ্ট নাগরিকেরা দলটিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এ মতের সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতৃত্বও প্রায় একমত। বিএনপির নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন এমন তিনজন নেতা প্রথম আলোকে এ তথ্য দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেছেন, চট্টগ্রাম ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে শিগগিরই দলীয়ভাবে ঘোষণা আসতে পারে। এর আগে তিন সিটির সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থীর নাম ঠিক করা হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে এক অংশের ভিন্নমতও আছে। আন্দোলনে ইস্তফা দিয়ে সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া কতটা যৌক্তিক হবে, সে প্রশ্ন তুলছেন এই অংশের নেতারা।
গত দুই দিনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সিটি নির্বাচনও প্রাধান্য পেয়েছে। এ ছাড়া দলীয় অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমেও নির্বাচন সম্পর্কে সমমনা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, শুভাকাঙ্ক্ষীদের বেশির ভাগই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে শক্তিশালী প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, চলমান আন্দোলনের মধ্যে সরকারের সিটি নির্বাচন দেওয়ার উদ্দেশ্য দুটি। এক, জনগণকে বিভ্রান্ত করে মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরানো। দুই, বিএনপি নির্বাচনে না এলে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে তা দেখানো এবং এ সুযোগে তিন সিটিতে নিজেদের লোককে জয়ী করে আনা।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য বিএনপি যে আন্দোলন করছে, সিটি নির্বাচনে গেলে সেই মূল দাবি ব্যাহত হবে না। আশা করি, দলের নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন।’
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে চলমান অবরোধ-হরতালকেন্দ্রিক আন্দোলনকে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। কারণ, স্বীকার না করলেও দলের নীতিনির্ধারকদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আড়াই মাস ধরে সারা দেশে চলা অবরোধ-হরতাল ইতিমধ্যেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর ফলে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও উপজেলা শহরের জনজীবনও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় চলমান অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি আরও টেনে নেওয়া কঠিন। আবার উপযুক্ত অজুহাত ছাড়া কর্মসূচি গুটিয়ে নেওয়াও মুশকিল। এ অবস্থায় সিটি নির্বাচন একটা মোক্ষম সুযোগ হতে পারে।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দলের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। এক, আন্দোলন কর্মসূচি কঠোরভাবে পালন করে নির্বাচন ভন্ডুল করে দেওয়া। দুই, আন্দোলনের অংশ ধরে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া।
দুটি পথের প্রথমটি সম্পর্কে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, আন্দোলন করে ঢাকা বা চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন ভন্ডুল করার মতো শক্তি-সামর্থ্য এখন দলের নেই। আড়াই মাসের আন্দোলনে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেওয়াই শ্রেয়। তাঁরা এ-ও মনে করছেন, গুম-খুন ও নির্যাতন-নিপীড়নের সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছে দলের অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। এ পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে উদ্বেগজনক। এ অবস্থায় জনমত ক্রমাগত সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে। তাই সিটি নির্বাচনের সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া, মেয়র পদপ্রার্থীদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখা গেলেও ওয়ার্ডের দলীয়-নির্দলীয় কাউন্সিলরদের ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
নেতারা জানান, আরও একটি কারণে বিএনপিকে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তা হচ্ছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিরোধ করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। এর পর থেকেই এই জোট দাবি করে আসছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে যায়নি বা ৫ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছে। এ কারণে দেশ-বিদেশের কাছে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কিন্তু এখন দুই বড় শহরে সেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তাঁরা।
নেতারা মনে করছেন, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলীয় ও প্রশাসনিক সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। তখন সরকার নিজেদের দলের এবং দলের বাইরের মেয়র ও কাউন্সিল পদে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিতে পারে। এর ফলে নির্বাচন একদিকে অংশগ্রহণমূলক, আরেক দিকে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত তা করা গেলে সরকার ভোটের হার বেশি করে দেখাবে এবং আন্তর্জাতিক মহলকে এ কথা বলার সুযোগ পাবে যে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সন্ত্রাসের কারণে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেনি। সিটি নির্বাচনে সন্ত্রাস ছিল না বলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। সরকারের এ কৌশল ঠেকাতে হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অপরিহার্য।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, সরকার ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মতো সিটি নির্বাচন থেকেও বিএনপিকে বাইরে রাখার কৌশল নিয়েছে। বিএনপি যাতে আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সে জন্য এ সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে। এখন বিএনপি যদি সত্যি সত্যি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত সরকার নির্বাচন থেকে সরে আসতেও পারে। তবে সরকারের কৌশল যা-ই হোক, দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, হরতাল-অবরোধের কারণে বিএনপিসহ জোটের নেতা-কর্মীরা একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। নির্বাচনের সুযোগে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করা যাবে এবং জনসম্পৃক্ততার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে নেতা-কর্মীরা মাঠে নামলে এ আতঙ্ক কেটে যাবে। আমার তো মনে হয়, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে শেষ পর্যন্ত ভরাডুবি দেখলে সরকার নির্বাচন দেবে না।’
২০১২ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর মেয়র পদে বিএনপির অনেকের প্রার্থী হওয়ার গুঞ্জন ছিল। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন, অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
এবার নির্বাচন নিয়ে দলীয়ভাবে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত না হলেও ইতিমধ্যেই ঢাকা উত্তর সিটিতে আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং দক্ষিণে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লার নাম শোনা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে মিন্টু ও বরকত উল্লার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। গয়েশ্বর অবশ্য জেলে আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২৩:৩৬ ২৮৬ বার পঠিত