বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকার আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি বর্ষণে হতাহতের খবরে বৃহত্তর নোয়াখালীর (নোয়াখালী-ফেনী-লক্ষ্মীপুর) সর্বস্তরের মানুষ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
তৎকালীন নোয়াখালী জেলা যুবলীগের সভাপতি খাজা আহমদ (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ এমসিএ), সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান, নোয়াখালী সদর মহকুমা যুবলীগের বজলুর রহমান ও নোয়াখালী সদর মহকুমা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রইস উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নোয়াখালীতে বাংলাকে মাতৃভাষা করার দাবিতে আন্দোলন হয়।
তাদের সঙ্গে এ আন্দোলনে যে তিনজন ছাত্র নেতা সক্রিয় অংশ নেন তারা হলেন- নুরুল হক চৌধুরী (কমরেড মেহেদী), কাজী মেজবাহ উদ্দীন ও নিখিল দাশগুপ্ত।
ভাষা আন্দোলনের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে ফেনী থেকে খাজা আহমদ, শামসুল হুদা, স্কুলছাত্র কাজী মেসবাহ উদ্দীন, নিখিল দাশগুপ্ত, মাইজদী থেকে আবুল কাসেম, চৌমুহনী থেকে রইস উদ্দীন আহমদ, ফজলুল করিম, ডা. রাস বিহারী দাস, চিত্তরঞ্জন সাহা (পুঁথিঘর প্রকাশনী) ও নুরুল হক মিয়া গ্রেফতার হন। তবে নুরুল হক চৌধুরীর (কমরেড মেহেদী) বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি হলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি।
নুরুল হক মেহেদী: মহান ভাষা সৈনিক। বর্তমানে গণতান্ত্রিক কর্মী শিবিরের সভাপতি। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নুরুল হক মেহেদী আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। স্মরণ করেন, তার এক সময়ের শিক্ষক মরহুম মাস্টার আবদুল করিমকে। এই শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তিনি ও তার সহপাঠীরা নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে নোয়াখালীতে প্রথম শহীদ মিনারটি স্থাপন করে শহীদ দিবস পালন করেছিলেন।
তিনি জানান, সেদিন একুশের রাতে দুইবার মুসলিম লীগের ‘টাউট’রা শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার পরও তারা দমে যাননি। স্থানীয় ছাত্র-জনতাকে সংঘবদ্ধ করে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তৃতীয়বার শহীদ মিনার স্থাপন করেন। এরপর কয়েক বছর অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার তৈরি করে দিবসটি পালন করে আসছিলেন তারা।
১৯৫৪-৫৫ সালে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কমরেড মেহেদী। সে সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
কামাল উদ্দিন আহমেদ: মহান এই ভাষা সৈনিক ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ায় ইংলিশ কামাল নামেই খ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন নোয়াখালীর তৃণমূল পর্যায়ের একজন প্রবীণ সাংবাদিক। মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন তিনি। ২০০৭ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
তার লেখা একটি গ্রন্থে ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, চার আনা দামের আলতা আর পাটখড়ির টুকরো দিয়ে কালি-কলম বানিয়ে দৈনিক আজাদের কয়েকটি পাতায় লিখে ফেললেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। নিচে আবার- বাংলা চাই, বাংলা চাই। এরপর নগেন্দ্র স্যারের নির্দেশে সতর্কতার সঙ্গে শেষ রাতে তিনি ও তার বন্ধুরা লক্ষ্মীপুর-ভবানীগঞ্জ জেলা বোর্ড সড়কের পাশে আম গাছের কাণ্ডে সূতা দিয়ে আটকে দেন সেই পোস্টার। কাঁচা হাতের লেখা, লেখা হয়েছে পুরানো সংবাদপত্রের কাগজে। পাঠোদ্ধার সহজ ছিল না। আবার দুপুরের এক পশলা বৃষ্টিতে আলতার লাল রঙ ফ্যাকাসে হয়ে লেখা মুছে গেছে। এটি ১৯৪৮ সালের মার্চের ঘটনা। তখন তিনি স্কুলে পড়েন।
কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, লক্ষ্মীপুর থানার ভবানীগঞ্জে তাদের বাড়ির দক্ষিণে উত্তাল মেঘনা। এর দক্ষিণ পাড়ে রামগতির হাজিরহাটে তোয়াহা সাহেবের বাড়ি। তোয়াহা সাহেব ও তার অনুসারী সামছুল হক মুখার্জির কাছে প্রথম ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারেন।
পড়ালেখার সুবাদে ঢাকায় পড়তে আসেন। ৫২’র কথা সেই সময়। তখন ঢাকা ছিল একটি ছোট্ট শহর। ঢাকা কলেজের ছাত্র তিনি। গোলক পাল লেনে থাকেন তিনি। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুর রহমানের কাছে জানতে পারলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের ঘটনা।
২১ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রেলক্রসিং পেরিয়ে কলা ভবনের সামনে চলছে ভয়ানক উত্তেজনা। গাজীউল হককে প্রথম দেখলেন তিনি। দুপুরের দিকে মেডিকেল কলেজের উত্তর গেটের উত্তর পশ্চিমে রাস্তার উত্তর দিকে কাঠ আর ঢেউটিনের ঘরে একটি স্টলে ঢুকে হাতে সিঙ্গারা নিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়েছেন, ঠিক সেই সময় হাফপ্যান্ট পরা পেট মোটা অসংখ্য পুলিশের নানা হুমকি আর অ্যাংলো গুলির শব্দ শোনা গেল। গুলির শব্দ হচ্ছে। পুলিশের অ্যাকশনের ভয়াবহতায় পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। ছাত্রদের মিছিল চলছে। পরিস্থিতি খারাপ হলে কোনো রকমে পালিয়ে যান তিনি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এমএলএ আনোয়ারা বেগমের ঢাকেশ্বরী বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ একটি সভায় যোগ দেন। সেই সভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপস্থিত ছিলেন।
আবদুল জলিল: প্রফেসর আবদুল জলিল স্কুলে পড়া অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে লক্ষ্মীপুর বার্তার একটি সংখ্যায়- আমার ফেলে আসা দিনগুলি- শীর্ষক অসমাপ্ত জীবনস্মৃতিতে তিনি লেখেন, এখনও স্পষ্ট মনে আছে সাংবাদিক ফজলুল করিমের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শামছুদ্দিন আহমেদসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের গাড়ি আটকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রতিশ্রুতি আদায় করি।
সেই সময় আবদুল জলিল ছিলেন মাইজদীর অরুণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। দেয়াল লিখন করেছেন। পোস্টার লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি।
ফারুক মুজাম্মেল হক: এই ভাষা সৈনিক নোয়াখালী জিলা স্কুলে পড়ার সময় মিছিল করেছেন, দেয়াল লিখন করেছেন। পরে জহির রায়হানের সঙ্গে আন্দোলনও করেছেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও তৎকালীন বাম ছাত্র রাজনীতির সক্রিয় সংগঠক। ছাত্র ইউনিয়নের প্রাদেশিক পরিষদের অফিস সেক্রেটারিও ছিলেন তিনি। তখনকার সময়ের কথা তিনি একটি লেখায় সহজ-সাবলীলভাবে লিখেছেন-আমার ওদিকে ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সময় চলে যেত। … মনে করিয়ে দিতেন। কিন্তু উপায় নেই। দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির স্বার্থে সেই ত্যাগ আমার যে করতেই হবে। এ রকম একটা প্রোজ্জ্বল দেশপ্রেমের ভাবনা জলিল ভাইসহ আমাদের অনেককেই সে অগ্নিযুগে পেয়ে বসেছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪২:২৮ ৩০৭ বার পঠিত