বঙ্গ-নিউজঃ চলমান অবরোধ-হরতালে সঙ্কটে পড়েছেন দেশের কৃষকেরা। সরবরাহব্যবস্থা ভেঙেপড়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। শীত মওসুমে রবি ফসল উৎপাদন করে কৃষকদের বেশি লাভবান হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অনেক চালকল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় বাজারে কমে গেছে ধানের দাম। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন বিপুল চাতাল ও কৃষিশ্রমিক। পথে বসার উপক্রম অনেকেই। পরিস্থিতি এখন এমনপর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছেÑ বিক্রি করলেও লোকসান, না করলেও লোকসান। তবে বিক্রি করে লোকসানের মাত্রা কমানোই যেন এখন কৃষকের মূল ল্য। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের সবজির চাহিদাপূরণে উত্তরাঞ্চল থেকে বেশির ভাগ শাকসবজি সরবরাহ করা হলেও হরতাল ও অবরোধের কারণে এখন তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে েেতই নষ্ট হচ্ছে বিপুল সবজিসহ রবি ফসল। ফলে সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে গোটা কৃষি খাত।
এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলকেই দোষারোপ করেছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা। তাদের অভিযোগ, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতে আগে পাইকারি বাজারে এক মণ শিম বিক্রি করে পাওয়া গেছে ১২০০-১৩০০ টাকা। এখন হরতাল-অবরোধের কারণে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৩০০-৩৫০ টাকা। প্রতি বছর এ সময়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে টমেটোচাষিরা উৎসবে মেতে থাকতেন। আর এখন সেখানে বিরাজ করছে চরম হতাশা। শুধু রাজশাহীর টমেটোচাষিরা কেন, বগুড়ার আলুচাষি, ঝিনাইদহের ফুলচাষিদেরও একই অবস্থা।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন হাটবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন প্রতি কেজি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে এক টাকায়। অথচ কৃষি বিভাগের হিসাবে প্রতি কেজি ফুলকপি উৎপাদনে কৃষকের নিট খরচ পড়েছে চার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে কৃষকের লোকসান যাচ্ছে তিন টাকা। অবরোধের আগে আলুর মণ ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়। একই চিত্র অন্যান্য সবজির েেত্রও। সবজিচাষিরা জানান, শীত মওসুমে সবজি বিক্রি করে বাড়তি অর্থকড়ির মুখ না দেখলে সারা বছর পেটেভাতে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এক মওসুমে মার খেলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরবর্তী মওসুমে। এর ফলে ধার দেনায় জর্জরিত কৃষকের আর্থিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে।
টানা অবরোধে বগুড়ার কৃষকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। তারা জানান, বগুড়া থেকে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাকে সবজির সরবরাহ হয়ে থাকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলাতে। এতে দৈনিক গড়ে কোটি টাকার সবজি বেচাকেনা হতো। কিন্তু এখন তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। মহাস্থান হাটের আড়তদার বিশাল ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী তাহেরুল ইসলাম জানান, ৩৫ থেকে ৪০ টাকা মণ দরে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে। তাহলে প্রতি কেজির মূল্য দাঁড়ায় মাত্র এক টাকা। স্থানীয় শিম বিক্রেতা মজনু মিয়া জানান, এনজিও থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সবজি চাষ করেছি। এখন অবরোধের কারণে সবজির দাম কমে যাওয়ায় কিভাবে যে কিস্তির টাকা পরিশোধ করব ভেবে পাচ্ছি না ।
বিক্রি করলে লোকসান, না করলে পুরোটাই : শিবগঞ্জ মহাস্থানহাটে ক্রেতারা ফুলকপি কিনছেন ৭০ টাকা মণ দরে। এতে ােভ প্রকাশ করে বগুড়া সদর উপজেলার লাহেরীপাড়ার ফজলুর রহমান জানান, অনেক দেখেছি, এমন কষ্টের সময় পার করিনি আর কখনো। বহু আশা করে ফুলকপি চাষ করেছিলাম। এখন ইচ্ছে করছে না কপি বিক্রি করতে। কিন্তু না করেও উপায় নেই। বিক্রি করলে তো ক্ষতি হচ্ছেই। আর না করলে পুরোটাই তি। তিনি জানান, সাত-আট বিঘা জমিতে তিনি ফুলকপি চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমি চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এখন বিঘাপ্রতি কপি বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় দু’জন চাষি জানান, ২৫ থেকে ৩০ বিঘা জমিতে এবার রুমানা পাক্রী ও কার্টিলাল জাতের আলু চাষ করেছেন তারা। বিঘায় খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা। এখন প্রতি বিঘা আলু বিক্রিতে লোকসান হচ্ছে পাঁচ-সাত হাজার টাকা। পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েই লোকসানে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। অপর এক পাইকারি বিক্রেতা জানান, পরিবেশ স্বাভাবিক থাকলে তিন কেজি ওজনের একটি লাউ পাইকারি বিক্রি হতো ৫০ টাকা পর্যন্ত। এখন সেটি ২০ টাকা বিক্রি করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। টমেটো বিক্রেতা মইনুল ইসলাম সরকার বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে লোকসানের পরিমাণ এতই বেশি যে, কত দিনে তা পুষিয়ে নেয়া যাবে, এটাই এখন ভেবে দেখার বিষয়। আলুর আড়তদার আব্দুল হালিম জানান, হরতাল-অবরোধের কারণে দারুণভাবে তিগ্রস্ত হচ্ছেন জমির মালিক ও চাষিরা।
বগুড়া কৃষি অধিদফতরের সহকারী সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জানান, বগুড়া থেকে উৎপাদিত তরকারি শাকসবজির ৭০-৭৫ শতাংশই জেলার বাইরে চলে যায়। এখানকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধা অঞ্চলে যায়।
একই অবস্থা নরসিংদীর কৃষকদের। টানা অবরোধে পাইকারশূন্য হয়ে পড়েছে সেখানকার সবজির হাটগুলো। কমে গেছে সবজি রফতানিও। এ ভরা মওসুমে পাইকারি ক্রেতারা স্থানীয় বিভিন্ন বাজার থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫০ ট্রাক শাকসবজি রাজধানী ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলায় সরবরাহ করেন। কিন্তু অবরোধের কারণে পাইকারি ক্রেতা কমে যাওয়ায় কমে গেছে সবজির দাম। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণপুর সবজির হাটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন আর আগের মতো নেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের হইচই। সবজিচাষি মোমেন ৩০০ টাকা করে দু’টি ভ্যান ভাড়ায় বাজারে বিক্রির জন্য মুলা এনেছেন। কিন্তু হাটে পাইকার না আসায় মুলা তিনি বিক্রি করতে পারছেন না। এখন কিভাবে ভ্যান ভাড়া দেবেন সে দুশ্চিন্তাই যেন গ্রাস করেছে তাকে।
কমেছে ধানের দাম : চাল উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ধানের বাজারে। হাটবাজারে ক্রেতা সঙ্কটে কমে গেছে ধানের দাম। হরতাল-অবরোধের কারণে বাইরের বেপারিরা ধান কিনতে আসতে না পারায় ধানের দাম প্রকারভেদে মণপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা ও চালের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা কমে গেছে। স্থানীয় কৃষক আব্দুছ সাত্তার জানান, হরতাল-অবরোধের আগে প্রতি মণ গুঁটি স্বর্ণা বিক্রি করেছেন ৭২০ থেকে ৭৪০ টাকা, মামুন ৭১৫ থেকে ৭৩০ টাকা, রঞ্জিত ৮২০ থেকে ৮৪০, বিআর-৪৯ ৮৩০ থেকে ৮৫০ ও মিনিকেট ১০০০ থেকে ১০৫০ টাকা। এখন ক্রেতা না থাকায় মণপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ ছাড়া ক্রেতা সঙ্কটে সব হাটবাজারে ধান বিক্রি করা যাচ্ছে না।
উত্তরাঞ্চলে চালের অন্যতম মোকাম বগুড়ার শেরপুরে ব্যবসায়ীদের গুদামে চাল অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। শেরপুর আজিম বয়লারের মালিক হানিফ উদ্দিন জানান, মিল মালিকেরা দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ থেকে ধান কিনে থাকেন। কিন্তু হরতাল অবরোধের কারণে ওই সব মোকাম থেকে ধান আনা সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে দিনাজপুর জেলার বেশির ভাগ অটো ও চাতাল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে ধানের দামের ওপর। স্থানীয় কৃষকেরা জানান, আমন ধান কাটা মাড়ার সময় কাঁচা অবস্থায় ধান ৭৫ কেজি বস্তা ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। অথচ বর্তমানে শুকনা ধানের বস্তা ১২৫০ থেকে ১৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
একই অবস্থা কুষ্টিয়ায়ও। টানা অবরোধের কারণে জেলার অধিকাংশ চাল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার কৃষিশ্রমিক। কুষ্টিয়ার রশিদ অটো রাইস মিলের মালিক আব্দুর রশিদ জানান, আগে যেখানে ১০০ ট্রাকে দেশের বিভিন্ন মোকামে চাল পাঠানো হতো, এখন তা ৩০ থেকে ৩৫টিতে নেমে এসেছে। এ ছাড়া ভাড়াও বেড়েছে।
তিগ্রস্ত ফুলচাষিরাও : চলমান হরতাল-অবরোধে যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গার ফুলচাষিদের কমপে ছয় কোটি টাকা তি হয়েছে। বিক্রি করতে না পেরে চাষিরা তে থেকে ফুল তুলে ফেলে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, যশোর জেলায় বছরে ২০০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন হয়। পাশাপাশি ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়ও ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন হয়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে ফুলের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে ফুলের দামও। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে ফুলের চালান কোথাও পাঠানো যাচ্ছে না। অবরোধ শুরুর আগে প্রতিদিন গদখালী ফুলের হাটে গড়ে ১৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হতো। এখন প্রতিদিন তিন থেকে চার লাখ টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। আবার দামও কম। এতে চাষিদের ব্যাপক তি হচ্ছে। তিনি জানান, প্রতি ১০০ ডবল স্টিক রজনীগন্ধার দাম ছিল ৪০০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, গোলাপ ৪৫০ টাকা থেকে কমে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গাঁদা ফুল এক হাজার পিসের প্রতি ঝোপা ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। এখন তা ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
60
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৭:১৪ ৩৫৭ বার পঠিত