বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ একটা টি-শার্ট কারখানা চালু করা খুব কঠিন কিছু নয়। শ্রমিক (বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত), কিছু পুরাতন সেলাই মেশিন ও একটা ভাড়া নেওয়া ভবন- ব্যস, শুরু করে দেওয়া যায় এ ব্যবসা। মোটামুটি দুই বছরের মধ্যেই বিনিয়োগ তুলে আনা সম্ভব। আর তা না হলে যন্ত্রপাতি অন্য কোনো দরিদ্র দেশের উদ্যোক্তার কাছে বিক্রি করে দেওয়া যায়।এ কারণেই হয়তো প্রায় প্রতিটি ধনী দেশই কোনো না কোনো সময় এই ‘টি-শার্ট যুগ’ অতিক্রম করেছে। অনেক দেশেরই দরিদ্র কৃষকরা অনুর্বর জমিতে চাষাবাসের চিন্তা বাদ দিয়ে এ কঠিন শর্ত ও কম মজুরির বিনিময়ে পোশাক কারখানার কাজ বেছে নিয়েছিলেন। ব্রিটেনে এই টি-শার্ট যুগ শুরু হয়েছিল ১৮ শতকের শেষদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরে ১৯ শতকে ও দক্ষিণে ২০ শতকে। এরপর গত ৮০ বছরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন- জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন টি-শার্ট যুগ অতিক্রম করে ধীরে ধীরে আরও বড় অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে এগিয়েছে। আর কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও ভারত এখন এই সময়টা পার করছে।
কিন্তু বাংলাদেশ টি-শার্ট যুগ বেশ দোলাচল একটা অবস্থানে আছে। এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি এখান থেকে ওইসব দেশের মতো আরও উন্নত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাবে, নাকি হাইতির মতো এক জায়গায়ই স্থির হয়ে পড়বে?
২১টি দেশের সাড়ে তিনশ’র বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস বলে, টি-শার্ট যুগের এক পর্যায়ে এমন ক্রান্তিকাল আসবেই। আর্জেন্টিনার এক সময়ের নিষ্ঠুর শ্রমপ্রথার কারণে অনেক আদিবাসী শ্রমিককে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাপানের এ শিল্পকে স্থবির করে দিয়েছিল। জার্মানি বিভক্ত হওয়ার পর তাদের পোশাকশিল্প দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা অবশ্য কিছুটা ভালো ছিল, তবে সেখানে শ্রমিকদের চাপের মুখে পরিস্থিতির উন্নতি করতে হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই টি-শার্ট যুগ স্থায়ী নয়। বিরাট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে যতক্ষণ পর্যন্ত আর কোনো উপায় থাকে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি টিকে থাকে। একে তাই অনেকে ‘অস্তিত্বের লড়াই’ বলে থাকেন। এসময় কারখানা মালিকদের মধ্যে কম মূল্যে পণ্য উৎপাদনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যে যত কম মূল্যে পোশাক তৈরি করতে পারে, তার চাহিদা ততো বাড়ে। এটা সম্ভব হয় ওইসব দরিদ্র গোষ্ঠীকে কম মজুরি দেওয়ার মাধ্যমে।
কিন্তু কম মজুরি দেওয়ার একটা পর্যায়ে এই নীতি আর চলে না, তখন শুরু হয় ‘উপরে ওঠার লড়াই’, অর্থাৎ ভালো পণ্য তৈরি করার প্রতিযোগিতা। সাধারণ টি-শার্টের বদলে নানা ডিজাইনের আধুনিক পোশাক তৈরির দিকে তখন ঝুঁকে পড়ে কারখানাগুলো, দরকার হয় দক্ষ শ্রমিকের। এসময়ই শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হয়, গড়ে ওঠে ইউনিয়ন, বাড়ে মজুরি।
বাংলাদেশ বর্তমানে এমনটা অবস্থায় আছে, যখন কমমূল্যের প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে উপরে ওঠার লড়াই শুরু হয়েছে মাত্র। সত্তরের দশকে যেটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ, বর্তমানে সেটিই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক। শূন্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশ এখন বছরে রপ্তানি করে ১৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। একে পাঁচ হাজার কোটি ডলারে পরিণত করাও অসম্ভব নয়। তবে সেজন্যে উপরে ওঠার লড়াইয়ে বাংলাদেশকে আরও পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সরকারকে কারখানার নিরাপদ পরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব করতে গিয়ে অবধারিতভাবে উৎপাদন খরচ বাড়বে।
কিন্তু এখানেই সমস্যা। কম্বোডিয়া শ্রমিকদের চাপে বাধ্য হয়ে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ৭৮ ডলার করেছিল, যা বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানির কম্বোডিয়ায় একটি টি-শার্ট তৈরিতে খরচ পড়ে আড়াই ডলার, যা বাংলাদেশের চেয়ে ৮২ সেন্ট বেশি। এই ৮২ সেন্টের পার্থক্যই বাংলাদেশের জন্য পোশাকশিল্পের বিশেষত্ব। কিন্তু উৎপাদন খরচ বাড়ালেই এই বিশেষত্ব হারাবে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতা পরামর্শক মাইক ফ্ল্যানাগানের মতে, বাংলাদেশ যদি ৫০ সেন্ট মজুরিও বাড়ায়, তার ফল হবে ভয়াবহ। এখন যে পোশাক খাতে ৪০ লাখ চাকরি আছে, সেখানে চার হাজার চাকরিও থাকবে না।
অনেক বাংলাদেশিও মনে করেন, বাংলাদেশে পোশাকের উৎপাদন খরচ একটু বাড়লেই আন্তর্জাতিক ক্রেতারা অন্যান্য দেশের দিকে ঝুঁকে পড়বে। নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ঘানার মতো দেশগুলোয় পাঠানো শুরু হবে বাংলাদেশের সেলাই মেশিন। অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। আফ্রিকার দেশগুলোয় অদক্ষ শ্রমিক থাকলেও অন্যান্য দিক দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তাদের সম্ভব নয়।
টি-শার্ট যুগ পার করা যেসব দেশের কথা আগে বলা হয়েছে, তারা এমন এক সময়ই দিক পরিবর্তন করেছে। পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর চেয়ে তারা ঝুঁকে পড়েছে আরও লাভজনক নতুন ব্যবসার দিকে। যেসব অর্ধদক্ষ ও দক্ষ শ্রমিক ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, তাদের কাজে লাগিয়ে শুরু করেছে ছোটখাটো ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতির ব্যবসা। কেউ কেউ তা-ও অতিক্রম করে গড়ে তুলেছে বৃহৎ শিল্প কারখানা। আজকের যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে ঠিক এই চিত্রই দেখা যায়। তাদের উৎপাদন খাতে রয়েছে মূল্যবান ও আধুনিক যন্ত্রপাতি, যার জন্য উচ্চ দক্ষ কর্মী দরকার হয়। অথচ এক সময় অদক্ষ শ্রমিকদের মাধ্যমেই তাদের শুরু করতে হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- এক সময় যুক্তরাষ্ট্র যেখানে শুধু ওষুধ তৈরি করতো, সেখান থেকে আজ বহুমূল্য মেডিকেল যন্ত্রপাতি তৈরি করছে।
বাংলাদেশও কি তাহলে এমন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে? শত বছর ধরে যে পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছে, তা কি আরও উন্নত অর্থনীতি দ্বারা প্রতিস্থাপন হচ্ছে? সময়ই এর উত্তর দেবে। তবে সেজন্য সবার আগে শ্রমিকদের ভালো মজুরি দিতে হবে, নিরাপদ কাজের পরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:০৪:৪৯ ৫৫৫ বার পঠিত