বিশেষ প্রতিনিধিঃখোশ-মেজাজে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির অবরোধ কর্মসূীচ কাংখিত মাত্রা না পওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া অবরোধ কর্মসূচিকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দিতে পারছেন এমন বিশ্বাসে বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। নিজ নিজ অবস্থানে বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী অনড় রয়েছেন। তাতে দেশবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছে। আতঙ্ক আর সংশয়ের মধ্যদিয়ে প্রতিদিনের জীবনযাপন করছেন দেশের প্রতিটি মানুষ। আন্দোলনের নামে চলমান সহিংসতায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। গত ৭দিনে ১২ জন মারা গেছেন। গাড়ি পুড়েছে ৬৩টি। এফবিসিসিআইয়ের হিসাব মতে অবরোধে প্রতিদিন অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার কোটি টাকা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর অনেকটাই ফুরফুরে মেজাজে দেশ পরিচালনা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সারাদেশে তেমন সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছিল না। তবে এ নির্বাচনের এক বছরপূর্তিতে বিএনপি হঠাৎ করেই মাঠে নেমেছে। ঘোষণা দিয়েছে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। এমন অবস্থায়ও প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ ৫ বছর শেষ করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
তবে রাতের বেলায় সারাদেশে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া গাড়িতে হামলা ও নাশকতা বেড়ে যাওয়ায় শেখ হাসিনা কিছুটা চিন্তিতও।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কয়েকবার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের মানুষ শান্তিতে আছে। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। এ সব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী।’
তিনি আরও বলেন, ‘সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছুটা চিন্তিত। তবে, এই নাশকতা মোকাবেলা করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শতভাগ আত্মবিশ্বাসী। প্রধানমন্ত্রী এই নাশকতা মোকাবেলা করেই দেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন এমন আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে দেখেছি। ‘
আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমি এরমধ্যে কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। প্রধানমন্ত্রী ২০১৯ সালের আগে নির্বাচন কিংবা বিএনপির সঙ্গে আলোচনা না করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। উনাকে অত্যন্ত দৃঢ় ও সাহসী মনে হয়েছে। উনি সরকার প্রধান হিসেবে কঠোর হস্তে বিএনপির এই নাশকতা দমন করতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন,‘ বিএনপির চলমান এই নাশকতামূলক কাজে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আর কয়েকদিন পরেই বিএনপির আন্দোলন হারিয়ে যাবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী বিএনপির আন্দোলন নিয়ে খুব একটা চিন্তা করছেন না। তার একটাই চিন্তা দেশের উন্নয়ন ও মানুষের উন্নয়ন।’
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এডভোকেট আফজাল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি যা করছে, তা আন্দোলন নয়, সন্ত্রাস। সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। এদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স।’
তিনি আরও বলেন,‘ প্রধানমন্ত্রী এদেশের ৪০ বছরের রাজনীতির উত্থান-পতন দেখেছেন। উনি একজন অসাধারণ ক্রাইসিস ম্যানেজার। পিলখানা থেকে শুরু করে সকল ক্রাইসিস মোমেন্ট উনি ট্যাকেল দিয়েছেন। বর্তমানে বিএনপি যা করছে তা নিয়ে উনি মোটেও চিন্তিত নন। বরং বিএনপিকে কঠোর হস্তে দমনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ়।’
এদিকে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষনেতা দ্য রিপোর্টকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা নিজেরাই কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর আমাদের মনোবল বেড়েছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী কিছুটা চিন্তিত থাকলেও বিএনপিকে প্রতিরোধের ব্যাপারে উনি শতভাগ কনফিডেন্ট।’
আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রী আরো বলেন,‘ প্রধানমন্ত্রী সাফ বলেদিয়েছেন, আমি যা বলি তাই করি। বিএনপি যাই করুক ৪ বছরের আগে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না। কোনো শক্তির চাপেই আমি বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসবো না।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া
নিজের ‘অবরুদ্ধতার’ মাঝেও অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচিতে দলের সিনিয়র নেতাদেরকে কাছে না পেলেও মনোবলের দিক দিয়ে বেশ চাঙ্গা আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পুলিশের পিপার স্প্রের কারণে শ্বাস কষ্টসহ অন্য শারীরিক অসুস্থতাও তাকে দমাতে পারেনি। সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে পিছু না সরে তা আরও জোরালোভাবে চালিয়ে যেতে চান তিনি। গত ৩ জানুয়ারি রাতে অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে দেখা করতে আসা দলের নেতা ও সুশীল সমাজের নাগরিকরা এমনটাই জানিয়েছেন।
৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে তালা দেয় পুলিশ। এরপর ৮ জানুয়ারি দুপুর পৌনে ১২টার দিকে খুলে দেওয়া হয়। তালা খুলে দিলেও খালেদা জিয়া তার কার্যালয় থেকে বের হতে পারেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার সঙ্গে সেখানে অবস্থানকারী একজন বিএনপি নেতা জানান, বেগম জিয়া আপাতত বাসায় ফিরছেন না। গুলশান কার্যালয়ের ‘অবরুদ্ধ অবস্থা’ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তিনি কার্যালয় ছাড়বেন না।
এ দিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ নন। ইচ্ছে করলে পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে বাসায় ফিরতে পারেন। তার বাসায় যেতে কোনো বাধা নেই।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা পেশাজীবী নেতারা জানান, ম্যাডাম নয়াপল্টন কার্যালেয়ে যেতে চান। তিনি সেখান থেকে আন্দোলন পরিচালনা করবেন। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে শনিবার রাতে সাবেক সরকারি আমলাদের ১১ সদস্যের দল নিয়ে দেখা করেন সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব এ এস এম আবদুল হালিম। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘খালেদা জিয়া আগের চেয়ে সুস্থ বোধ করছেন। আগের চেয়ে বেশ চাঙ্গা আছেন।’
চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, সেহেতু আমরা চাই আলোচনার মাধ্যমে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসুক।’
ওই রাতেই দেখা করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলাম। তিনি অসুস্থ, শ্বাস কষ্টে ভুগছেন। তবে এখনও তিনি পুরো চাঙ্গা আছেন। মনোবল শক্ত আছে। আমি কথা বলার সময় বেশ চাঙ্গা দেখেছি।’
এ ছাড়া গত ৮ জানুয়ারি বিএনপির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নেতৃত্বে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির একটি প্রতিনিধি দল।
মাজহারুল আনোয়ার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ম্যাডাম আমাদের বলেছেন, আমি রাজনীতি করি মানুষের জন্য। আমি দেশের মানুষের সঙ্গে ছিলাম, বর্তমানেও আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। তিনি দেশবাসীর কাছে তার শারীরিক সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা করেন।
ওইদিন রাতেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে সিনিয়র শওকত মাহমুদ বলেন, ‘দেশনেত্রী বলেছেন, অবরোধ কর্মসূচি চলবে। কোনো বিরতি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত বিজয় না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার এই আন্দোলন চলবে।’ খালেদা জিয়ার মনোবল কেমন দেখলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে, তার মনোবল আগের চাইতে দৃঢ়।’
৭ জানুয়ারি বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে বলেন, ‘চেয়ারপারসন অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন।’
মাহফুজ বলেন, ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি চেয়ারপারসনের এই অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি বর্তমানে খুবই অসুস্থ এবং চিকিৎসাধীন। তবে বিএনপি প্রধান অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন।’
ওইদিনই খালেদার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য আ ফ ম ইউসুফ হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, ‘চারদিন ধরে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ হলেও মনোবল হারাননি।’
তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) অসুস্থ। বেশি কথা বলতে পারছেন না। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। তবে তার মনোবল দৃঢ় রয়েছে।’
রবিবার রাতে গুলশানে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। দীর্ঘ সময় দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন এই নেতারা।
এ সময় ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া উপস্থিত সাংবাদকিদের বলেন, ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পুরণ না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচির অবসান ঘটবে না বলে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাদের জানিয়েছেন।’
গত আটদিন ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানে নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। কার্যালয়ের সমানের রাস্তার দক্ষিণ পাশে একশ গজের মধ্যেই একটি জলকমান ও উত্তর পাশে দুটি পুলিশ ভ্যান আড়াআড়িভাবে রাখা আছে। নিরাপত্তা পাহারায় সর্তক অবস্থানে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গুলশানের ৮৬ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ি খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সমানের সড়কে যথারীতি পুলিশে তল্লাশি চৌকি বসানো আছে। ওই সড়কে সাধারণ মানুষ ও যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থার আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। রবিবার সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠার পর সকালের নাস্তা করেন। অবরুদ্ধতার কারণে সরাসরি বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে যেতে না পারলেও কার্যালয়ে বসে ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। এরপর তিনি সারাদেশের অবরুদ্ধর চিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। এ ছাড়া জেলার নেতাদের সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।
‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস উপলক্ষ্যে ৫ জানুয়ারি সমাবেশ ডাকে ২০ দলীয় জোট। ওই সমাবেশকে ঘিরে ৩ জানুয়ারি রাতে নয়াপল্টনে কেন্দীয় কার্যালয়ে অসুস্থ দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে দেখতে তিনি বের হতে চাইলে পুলিশ তার পথ রোধ করে। এরপর থেকেই গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৩৩:১৭ ৪৮৬ বার পঠিত