বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ আমি কখনোই কল্পনা করতে পারিনি বের হতে পারব। সব আল্লাহর ইচ্ছা। সব সময় আল্লাহরে ডাকছি।’ সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিনের মাথায় জীবিত উদ্ধার হওয়া রেশমা গতকাল গণমাধ্যমের সামনে এসব কথা বলেন।উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই রেশমার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদ্গ্রীব ছিল দেশের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও। গতকাল সোমবার বিকেলে সেই সুযোগ মেলে। দুপুরে সাভার সেনানিবাসের মুন্সী আব্দুর রউফ ফটকে জড়ো হন অর্ধশতাধিক দেশি-বিদেশি সংবাদকর্মী। বেলা তিনটার দিকে সাংবাদিকদের নেওয়া হয় সেনানিবাসের ভেতরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) চত্বরে। দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর পাঁচটার দিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) দরজা দিয়ে একজন সেবিকাকে একটি হুইলচেয়ার ঠেলে বের হতে দেখা গেল। সেখানে গোলাপি-বেগুনি ম্যাক্সি আর মাথায় পশমি চাদর জড়িয়ে বসা রেশমা। অনেকটা পাথরের মতো নির্জীব। কয়েকবার চোখ বন্ধ করলেন, ঠোঁট কামড়ালেন। রেশমাকে দেখেই আলোকচিত্র সাংবাদিকদের ক্যামেরাগুলো ক্লিক ক্লিক করে উঠল, তৎপর হয়ে উঠলেন টিভি সাংবাদিকেরা।
রেশমার একপাশে বসলেন মনোচিকিৎসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশফাকউজ্জামান চৌধুরী, আরেক পাশে রেশমার চিকিৎসায় গঠিত বোর্ডের প্রধান কর্নেল আজিজুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন আরও জনা বিশেক সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য।
আশফাকউজ্জামান বললেন, উদ্ধারের পরপর রেশমা ভীতসন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত ছিলেন। তাঁর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, স্পর্শ করলেই ভয়ে কেঁপে উঠছিলেন। তাঁকে স্বাভাবিক করার অনেক চেষ্টা হয়েছে। তিনি এখন অনেকটাই সহজ হয়েছেন। আগের চেয়ে অনেক ভালো।
এরপর আজিজুর রহমান বলেন, রেশমার শারীরিক অবস্থা ভালো। তিনি এখন নিজের হাতেই খাচ্ছেন। তাঁর হাতে স্যালাইনের সুচের (আইভি চ্যানেল) মাধ্যমে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। অচিরেই তাঁকে আইসিইউ থেকে সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়া হবে।
রেশমা খুব নিচু ও ধীরগলায় কথা বলছিলেন। অনেক সময় কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। শুরু করেন এভাবে, ‘সকালবেলা কাজ করতে গেছি। শুনছি যে পিলার ফাটছে, আমরা যেতে চাইনি। স্যাররা বলছে, “কিছু হয়নি। পানির জন্য ওয়াল ফেটে গেছে। তোমরা যার যার জায়গায় গিয়ে কাজ করো।” এর পরে ফ্লোরে উঠে দেখি সবাই চিল্লাইতেছে। না, কাজ করা যাবে না। তখন অনেকেই বের হয়ে যেতে চাচ্ছে। একটা আপু বলল, “রেশমা তুমি আমার সাথে যাবা? তুমি-আমি একসাথে বের হব।” আপুর হাত ধরে বের হচ্ছি। তখনই ভবন ভেঙে পড়ে। আর আমার মাথায় পড়ল ইট। আমি অনেকক্ষণ পড়ে ছিলাম। পরে দেখি, খুব গরম লাগে। খুব অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কারা যেন চিল্লাইতেছে। বলতেছে, “রেশমা, রেশমা পানি দাও।” আমি বললাম, পানি পাব কোথায়। কয়েকটা ভাইয়া আছে। বলে, “আপু, আমাদের বাঁচাও।” আমি বলি-ভাইয়া, ক্যামনে বাঁচাব। আমি নিজেই বাঁচতে পারতাছি না। একজন বলে, “পানি দাও।” আমি খুঁজলাম, পানি পাই না। পরে আমি আস্তে আস্তে শুয়ে শুয়ে নড়াচড়া করতে থাকি। রাস্তা খুঁজতে থাকি। কিছুই দেখা যায় না।’ একটানে কথাগুলো বলে একটু থামলেন রেশমা।
এরপর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাঁর বক্তব্যগুলো স্পষ্টভাবে আরেকবার বলেন। তারপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রেশমা বলেন, ‘এখন আমার অনেক ভালো লাগছে।’
ভবন ভেঙে পড়ার পরপর কী হয়েছিল জানতে চাইলে রেশমা বলেন, ‘মাথায় অনেক ব্যথা পাইছি তো। ভেঙে পড়ার পর কখন কী হইলো ঘটনা মনে করতে পারছি না।’ কী খেয়েছিলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি জাস্ট একটু পানি পাইছি আর চার পিস বিস্কুট। আর কোনো খাবার পাইনি। অনেক খুঁজছি আর পাইনি।’
আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল কি না-জানতে চাইলে রেশমা বলেন, ‘আমার সঙ্গে অনেকেই ছিল। তারা মারা গেছে। অনেক চিল্লাইছিল “বাঁচাও বাঁচাও” করে। আমি চেষ্টা করছি, বের হওয়ার পথ পাইনি।’ এত অন্ধকারে সাহস কোথায় পেলেন জানতে চাইলে রেশমা বলেন, ‘আমি নিজেও জানি না এত সাহস কোত্থেকে পেলাম। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।’
ভেতরে থাকার সময় কোনো উদ্ধারকর্মীর ডাক শুনেছিলেন কি না-জানতে চাইলে বলেন, ‘কোনো উদ্ধারকর্মীর ডাক শুনিনি। যেদিন বের হয়ে আসছি, সেই দিনই একজনের ডাক শুনতে পাইছি। তবে উদ্ধারকাজের অনেক আওয়াজ পাইছিলাম। আমি শুয়ে ছিলাম। এক হাতের মতো ওয়াল হবে মাথার ওপর।’
রেশমা বলেন, ‘আমি তিনতলায় ছিলাম গার্মেন্টসে। আশপাশে অনেক ইট। হাত দিয়ে ইট সরাইছি। মেশিনের একটা লাঠি পাইছিলাম। লাঠি দিয়ে খুঁচাইয়া ভেতরে কিছু পানি বের করছিলাম। শুয়ে নড়াচড়া করায় জামাকাপড় সব ছিঁড়ে গেছিল।’
উদ্ধারের দিনের বর্ণনা দিয়ে রেশমা বলেন, ‘তখন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, আলো দেখতে পাচ্ছি। কেউ চিৎকার করে বলছে, এখানে জীবিত লোক আছে। আমি বলছি-ভাই, আমারে বাঁচাও। তারা শুনতে পারছে। কিন্তু কাপড়চোপড় তো ছিঁড়ে গেছে। তার পরে আমি ভাবতাছি যাব, ক্যামনে যাব। আমি তো মেয়ে, ছেলে না। ভাবতাছি কী করব, কী করব। তারা যখন উদ্ধার করে, তখন একজন একটা টর্চ লাইট দিছে। বলছে, “আপু, টর্চ নিয়া ভেতরে যাও।”‘ পরের কথা কিছুটা জড়িয়ে যায়।
সেনা কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তিনি শুয়ে শুয়ে চলায় তাঁর জামাকাপড় ছিঁড়ে যায়। পরে আলো দেখতে পেয়ে তিনি যখন উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারলেন, একজন উদ্ধারকর্মী তাঁকে তখন একটি টর্চ দেন। সেই টর্চের আলো জ্বালিয়ে তিনি দেখেন, তিনি মার্কেটে রয়েছেন। পরে তিনি শুয়ে শুয়েই সেখান থেকে একটি নতুন জামা নিয়ে পরে ফেলেন।
জানতে চাইলে রেশমা বলেন, ‘আর কখনো গার্মেন্টসে কাজ করব না।’ এর পরে কী করতে চান, এ প্রশ্নের আর কোনো জবাব দেননি তিনি। প্রশ্নটি শোনার পর আরও বিষণ্ন হয়ে যান রেশমা।
রেশমা জানান, ২০১০ সালের জুন মাসে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আসেন রেশমা। চলতি বছরের ২ এপ্রিল ধসের ২২ দিন আগে রানা প্লাজার ওই কারখানায় যোগ দেন চার হাজার ৭০০ টাকা মূল বেতনে। কারখানার নাম ঠিক মনে করতে পারেননি।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৩:০০ ৫০৯ বার পঠিত