পানির গতি, মাটির প্রকৃতি, মাছের মেজাজ সব বিবেচনায় নিয়ে তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু। কাজ শুরু হয়েছে। স্বপ্নের সেতুর জন্য আর মাত্র চারটি বছরের অপেক্ষা। পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা, খ্যাতিমান প্রকৌশলী, শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এ কথা বলেন। খবর বাংলানিউজ।
প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পদ্মা প্রমত্ত, আমাজনের পর এটিই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পানির স্রোত। একটি স্রোতস্বিনী নদীর মধ্য দিয়ে সেতু বয়ে নিয়ে যাওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ, সে চ্যালেঞ্জ নির্মাণের, চ্যালেঞ্জ নদী শাসনের। পদ্মার মাটি নরম, এখানে তলদেশে যে কোনো মুহূর্তে তৈরি হয় বড় বড় খাদ, এটিকে মাথায় রেখে নদীকে বসে আনার কাজ রয়েছে। পদ্মার এ সেতু এলাকায় প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি বয়ে যায়, সে প্রবাহ অবাধ রাখা একটি বড় কাজ। আর পদ্মার ইলিশের স্বাদ গোটা বিশ্বে পরিচিত, সে মাছ পদ্মায় ধরা পড়ে। মাছের মেজাজ যেন বিগড়ে না যায়, যেমন আসছে তেমনই আসতে পারে, ধরা পড়তে পারে জেলেদের জালে সেও কিন্তু কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়। প্রকৌশল বিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা ঢেলে দিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন দেশের এ অন্যতম প্রযুক্তিবিদ। তিনি তুলে ধরেন পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো। তবে কাজ শুরুর আগের বাধাগুলো সফলভাবে অতিক্রম করে এখন পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানালেন তিনি। তিনি বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। আমার দৃষ্টিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল সেতুর নির্মাণ কাজ আর নদী শাসন। মনে রাখতে হবে, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত স্রোত পদ্মায় প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। এত পানির প্রবাহ আমাজন নদীর পরে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। সেতুর বয়সকাল ১০০ বছর ধরে এটি নির্মাণ করা হবে, তবে প্রত্যাশা এটি টিকে থাকবে আরও দীর্ঘকাল ধরে। সেতুর নিচে ভরা মৌসুমে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রতি সেকেন্ডে প্রবাহিত হয়। প্রবাহ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এ কারণেই একেকটি পিলারের মাঝখানে ১৫০ মিটার দূরত্ব রাখা হচ্ছে। যমুনা সেতুতে নদীর পানির প্রবাহ যতটা আটকে দেওয়া হয়েছে, পদ্মায় প্রবাহ তার চেয়ে অনেক কম বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানান এই প্রকৌশলী। তিনি বলেন, যমুনায় ভরা মৌসুমে নদী বিস্তৃত হতো ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত। যা আটকে দিয়ে ৪.৫ কিলোমিটার সেতু দিয়ে বন্ধন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পদ্মার যে এলাকা দিয়ে সেতু তৈরি হচ্ছে সেখানে ভরা মৌসুমে নদীর বিস্তৃতি ১০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। পানির প্রবাহ কম ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়টি মাথায় রেখেই এ সেতু টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৬.১৫ কিলোমিটার। তিনি বলেন, নদীর এ বেল্টে মাটি খুবই নরম। এর ওপর পড়বে মূল সেতুর ভার। রেল ও রোড ট্রাফিকে ট্রেন-গাড়ির চাপ যুক্ত হবে, তাও গিয়ে পড়বে মাটির ওপর। নরম মাটি চাপ সইতে পারে না, এ ছাড়া তলদেশে ক্ষয়ের সৃষ্টিও হতে পারে, ভূমিকম্পে হতে পারে বড় ধস। একেকটি ক্ষয়ে ৬২ মিটার পর্যন্ত মাটি সরে যায় পদ্মার গভীরে। এ অবস্থায় প্রতিটি পাইল ১১৮ মিটার গভীর পর্যন্ত পুঁতে দিতে হবে।
খ্যাতিমান এ প্রযুক্তিবিদ বলেন, কঠিন কাজ হচ্ছে পাইলগুলো পুঁতে দেওয়া। এ জন্য বিশ্বে একটি মাত্র কোম্পানি পাওয়া যায় দক্ষ। এটি জার্মান কোম্পানি। এ কোম্পানি পাইল বসানোর জন্য বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ভারী হাইড্রোলিক হ্যামার তৈরির কাজ শুরু করেছে। এ হ্যামার দিয়ে পদ্মার গভীরে পুঁতে দেওয়া হবে ২৫০টি পাইল। এটিও নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকল্পের এ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পাঁচটি প্রধান প্যাকেজে ভাগ করে কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কাজ ১৫০ কোটি ডলার (প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা) ব্যয়ে মূল সেতু নির্মাণ। আর ১০০ কোটি ডলার (প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) ব্যয়ে নদী শাসন। রয়েছে তিনটি অপেক্ষাকৃত ছোট প্রকল্প। যার মধ্যে অন্যতম অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ। মাওয়া অংশে কেবলই সড়ক, তবে জাজিরা অংশে রয়েছে সড়কের পাশাপাশি আরও পাঁচটি সেতু নির্মাণের কাজ। এর বাইরে বিশাল এ কর্মযজ্ঞের প্রয়োজনেই গড়ে উঠছে অফিস ভবন, আবাসন। গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন। স্থানীয়ভাবেই ঠিকাদার নিয়োগ করে এ কাজগুলো সম্পন্ন করা হচ্ছে। তিনি জানান, মূল সেতুর জন্য মালামাল আসতে শুরু করেছে। নদী তীরে মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। তিনি বলেন, পদ্মা ব্রিজের নকশায় নদীর ইলিশের কথাও বিবেচনা করা হয়েছে। পদ্মায় ধরা পড়ে বিপুল সংখ্যায় ইলিশ। ইলিশ মাছের আনাগোনা যাতে খুব কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সব দিক বিবেচনায় প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক। আমি আশাবাদী আগামী চার বছরের মধ্যেই এ সেতু যান চলাচলের জন্য চালু করতে পারব। এর মধ্য দিয়েই পূরণ হবে কোটি মানুষের স্বপ্ন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি দিকের সমন্বয় সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি মনে করি সরকারের এ রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তরিকতার এতটুকু অভাব নেই। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও প্রকল্পের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, এমন একটি সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লেগে যায়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই এমন, এতে সরকার পাল্টে যায়। কিন্তু কেউই এ ধরনের প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করে না। যমুনা সেতুর উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এরশাদ সরকার এ সেতুর প্রথম উদ্যোগ নেয়, খালেদা জিয়া এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, আর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বাজেটের ১৫ শতাংশ অর্থছাড়ও দেওয়া হয়েছে। এটি একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সেতু বাস্তবায়নের অর্থ জোগানের চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমন এর কারণে অন্যান্য ছোট কিছু খাত পেছনে পড়েও যেতে পারে। তবে সে বিষয়টি খুব বড় করে দেখার কোনো কারণ নেই বলেন তিনি। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এ সেতুর সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিক হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন। সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। এরপর বাংলাদেশিদের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ আর থাকবে না। একটি আস্থা তৈরি হবে, এত বড় প্রকল্প আমরা নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে পারি। সর্বোপরি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিশ্ব দেখবে বাংলাদেশ কী পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:২৭:৫৮ ৫৮৩ বার পঠিত