তিন বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু মনে হচ্ছে এই যেন মাত্র সেদিনের কথা। যেন মাত্র গতকালই বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে আমি ঢাকায় এলাম। আমাকে এবং গ্রেসকে বহন করে নিয়ে আসা বিমানটি এই সেদিন মাত্র শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করল।
প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণ করে এসে আমরা বেশ ক্লান্ত ছিলাম… গ্রেস আগে নামল… এবং একটা বিশাল ব্যাগ টানতে টানতে আমি তাকে অনুসরণ করলাম। ব্যাগটা অনেক ভারী ছিল, কিন্তু আমি সেটাকে টানতে টানতে টার্মিনাল দিয়ে নিয়ে গিয়ে যেখানে সংবাদ সম্মেলন হবে সেই লাউঞ্জে রাখলাম। সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়া মাত্র একজন সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘আপনার ওই বিশাল ব্যাগের মধ্যে কী আছে?’ ‘আহ’, আমি বললাম, ‘ওটার মধ্যে আছে আমার ম্যান্ডেট… যে ম্যান্ডেট নিয়ে আমি বাংলাদেশে এসেছি… বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব আরও ব্যাপক, আরও গভীর ও শক্তিশালী করার ম্যান্ডেট।’ সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- কেন আমার ম্যান্ডেটটি এত বড়। উত্তরটি ছিল খুবই সোজা। বাংলাদেশ অনেক বড়; বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ, পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। বাংলাদেশ মধ্যমপন্থি, সহনশীল, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সহিংস চরমপন্থার বিকল্প একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র; যা অন্যান্য দেশে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা প্রতিহত করতে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা অভিযানে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রসারে এবং দুর্যোগ, বিশেষ করে ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আমেরিকা এমন একটি বাংলাদেশকে তুলে ধরে যা শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, সমৃদ্ধ, সুস্থ এবং গণতান্ত্রিক। বাংলাদেশ থেকে আমার বিদায়ের প্রাক্কালে আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যাপকতর, গভীরতর এবং অধিকতর শক্তিশালী; যা উভয় দেশের জনগণের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ২০১২ সালের বাংলাদেশ সফরকালে অংশীদারিত্ব সংলাপ শুরু করার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, যা দুই মাস আগে ওয়াশিংটনে তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে নিরাপত্তা সংলাপ ও দ্বিপক্ষীয় সামরিক সংলাপের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা অবকাঠামো চুক্তির (টিকফা) প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সম্পৃক্ততা আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও উজ্জীবিত করেছে, এগুলো আরও নতুন করে দিকনির্দেশনা পেয়েছে এবং আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব নানা চমৎকারভাবে ইতিহাস তৈরিতে সহায়তা করছে। * মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো যাতে করে বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে।
* বাংলাদেশিদের তাদের নিজেদের পরিবারের আকার বা সদস্যসংখ্যা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী নির্ধারণে সক্ষম করে তোলা। বাংলাদেশ আগামী বছর প্রতি নারীর জন্য প্রজনন প্রতিস্থাপন হার ২.১ অর্জন করবে… এটি এমন স্বেচ্ছা অর্জন যা নতুন করে ইতিহাস লিখেছে।
* যে বাংলাদেশ একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে বিখ্যাত ছিল, সেই বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে… এমন একটি অর্জন যা আগে কেউ কখনো কল্পনাও করেনি।
* বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে বন সংরক্ষণ যা বাঁধ হিসেবে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা থেকে জাতিকে রক্ষা করে এবং নতুন লবণাক্ততা, খরা ও বন্যা সহিষ্ণু বীজের ব্যবহার শুরু করে। * মানব, অস্ত্র ও মাদক পাচার রোধে সামুদ্রিক ও স্থলসীমার নিরাপত্তা, সন্ত্রাসীদের বাধা দেওয়া এবং জাতীয় সামুদ্রিক সম্পদের নিরাপত্তা প্রদান। সামুদ্রিক নিরাপত্তা আরও বাড়ানোর জন্য আমেরিকা পরবর্তী বসন্তে ৩৭৮ ফুট দীর্ঘ দ্বিতীয় আরেকটি ‘কাটার’ জাহাজ প্রদান করবে।
* দুর্যোগে বাংলাদেশিদের রক্ষায় আরও ১৩০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ এবং ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতিতে সাহায্য করা। এসব অর্জন বাংলাদেশকে পরবর্তী এশীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার জন্য শক্ত অবস্থান তৈরি করে দিচ্ছে। এই বাঘের চারটি শক্তিশালী পা রয়েছে : একটি ব্যাপক আকারের পোশাকশিল্প যা বিশ্বমানের শিল্পে রূপান্তরিত হতো যদি এর অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কারখানার কাঠামোগত দৃঢ়তা এবং শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়গুলো যথাযথ মানের হতো; বিশালকায় জুতা ও তৈরি চামড়াজাত পণ্য শিল্প যা বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়বে যখন সাভারের পরিবেশবান্ধব ট্যানারি পার্ক চালু হবে; বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ওষুধ যা আগামী বছর থেকে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়বে; এবং তথ্যপ্রযুক্তি, বিশেষত সফ্টওয়্যারের উন্নয়ন। ছোট মালবাহী জাহাজ, হিমায়িত চিংড়ি, সিরামিক, ফুল এবং পাট ও রেশম জাত পণ্য এই অর্থনৈতিক বাঘকে আরও শক্তিশালী করবে। সব শিশুর জন্য গুণগত শিক্ষা অর্জনে বাংলাদেশের সফলতা, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন (যেমন রাস্তা, রেলপথ, বন্দর এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ) এবং সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশকে, এশিয়ার পরবর্তী বাঘকে, অর্থাৎ এই রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে, বিশ্ব অর্থনীতিতে সদর্পে বিচরণের যোগ্য করে তুলবে। এই দারুণ ও সমৃদ্ধ জাতি ও এর চমৎকার, কঠোর পরিশ্রমী, সৃজনশীল, উদার, উদ্যোগী এবং সহনশীল জনগণকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আমি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে, যাদের আমি জেনেছি বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় আমার সফরের মাধ্যমে। যদিও আমার পরবর্তী বসতি অনেক দূরে, তবে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের সম্মিলিত লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করতে আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব আমি করে যাব। আবার দেখা হবে!
বাংলাদেশ সময়: ১২:১৮:৫৩ ৪০০ বার পঠিত