আমেরিকাকে ‘না’
Home Page » জাতীয় » আমেরিকাকে ‘না’বঙ্গ-নিউজঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই, বাংলাদেশস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনাকে নিয়ে এতদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম টিকা টিপ্পনী কেটেছেন। এবার প্রধানমন্ত্রী খোদ আমেরিকাকে নিয়েই কথা বললেন। মালয়েশিয়া থেকে সরকারি সফর শেষে দেশে ফিরে ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে বললেন,এক. কোনো দেশ পাশে থাকলে আমরা বেঁচে থাকব, আর পাশে না থাকলে মরে যাবÑ এটা ভাবা ঠিক না।
দুই. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয়, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বন্ধ করতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রীর কথায় সুস্পষ্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। ইতিপূর্বে নানাভাবে সে কথা তিনি বলেছেন। এবার তা পুনর্ব্যক্ত করলেন।
প্রশ্ন উঠছে, কেন প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কথা এত জোরে বলছেন। কেন তিনি মুখের ওপর ‘না’ বলছেন আমেরিকাকে? বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় আমেরিকার রাজনৈতিক ক্ষমতার কথা জেনেও আমেরিকাকে বাদ দিয়েই চলার পথ তিনি কেন খুঁজছেন? তার এই জনবার্তাই বা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
এক. প্রধানমন্ত্রী, তার দল, সরকার দেশের জনগণকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চান, তিনি হেলাফেলার কেউ নন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন কেউকেটা কেউ নয় যে তার বশ্যতা মানতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার আছে। সুতরাং তিনি দুর্বল রাষ্ট্রনায়ক নন।
দুই. ৫ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দশম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যেভাবেই তিনি ক্ষমতায় এসে থাকুন না কেন, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুনজরে নেয়নি। তিনি তার তোয়াক্কা করেন না। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই তিনি এই মার্কিন নীতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
তিন. প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত জনগণকে এই মেসেজ দিতে চান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে না থাকলেও ভারতের আমলাতন্ত্র, গোয়েন্দা স্টাবলিশমেন্ট এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার তার সঙ্গে আছে। প্রধানমন্ত্রীর হয়তো বিশ্বাস, এই অঞ্চলে ভারতকে ডিঙ্গিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশের বিষয়ে রাজনৈতিক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। ভারতকে বেজার করে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে কোনো ধরনের সক্রিয় চাপ দিতে খোদ আমেরিকাও অপারগ। সুতরাং ‘নো’ ফর আমেরিকা।
চার. প্রধানমন্ত্রী হয়তো ধরে নিয়েছেন, যে প্রক্রিয়ায়ই তিনি ক্ষমতায় বসে থাকুন না কেন, তার আমলে জনগণ ভালো আছে। নানাভাবে তিনি দেশের উন্নতি করে চলেছেন। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে তিনি যথাসাধ্য পরিশ্রম করছেন। জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে তার এই চেষ্টাকে জনগণ সুনজরে দেখছে। জনভাবনার এই ইতিবাচকতাই তার শক্তি।
পাঁচ. দেশের অর্থনীতি ভালো। খাদ্য সরবরাহ ভালো। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বিদেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হলেও রেমিটেন্সের স্বাস্থ্য ভালো। ব্যাংকের রিজার্ভ এখন যথেষ্ট। বিদেশি বিনিয়োগ এখন তেমন না হলেও ভবিষ্যতে সে ক্ষেত্রেও সাফল্য আসবে। পশ্চিমা বিনিয়োগ না হলেও ভারত, চীনের বিনিয়োগ অচিরেই আমাদের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করবে। ফলে আমেরিকা জিএসপি সুবিধা চালু না করলেও বাংলাদেশ এই বাধা অতিক্রম করবে তার নেতৃত্বেই। সুতরাং ‘নো’ ফর আমেরিকা তিনি বলতেই পারেন।
ছয়. রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক ও জ্বালানি বিষয়ক চুক্তি হয়েছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক দেনদরবারও ভালো। ভারতের বাইরে রাশিয়া, চীনের সঙ্গে এই সখ্যতাও প্রধানমন্ত্রীকে মার্কিনবিরোধী কট্টর অবস্থানে সাহসী করেছে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন, চীন-ভারত-রাশিয়া পাশে থাকলে আমেরিকাকে ‘না’ বলতে বাধা কোথায়?
২.
আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ। হালের পৃথিবীতে তার সমশক্তির কেউ নেই। এক সময় সোভিয়েত রাশিয়া ছিল আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী। পৃথিবী বিভক্ত ছিল আমেরিকান ও রাশিয়ানÑ এই দুই ব্লকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকাই হয়ে ওঠে পৃথিবীর ঈশ্বরসম শক্তিধর দেশ। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে সর্বত্রই তার রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির উপস্থিতি। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সে-ই হচ্ছে মোড়ল। তাহলে তাকে ‘না’ বলা কি বাস্তবিকই অলীক ভাবনা! এরকম ঘটনা কি পৃথিবীতে আদৌ ঘটে নাই। আমেরিকার মাতব্বরি কি অগ্রাহ্য করে নাই পৃথিবীর কোনো দেশ!
না, পৃথিবীর অনেক দেশই আমেরিকাকে বছরের পর বছর মুখের ওপর ‘না’ বলেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ ‘কিউবা’ আমেরিকাকে ‘না’ বলেই টিকে আছে। আমেরিকাকে ‘না’ বলে সব রকম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সয়ে ইসলামি বিপ্লবের শক্তিতে টিকে আছে খোমেনির ইরান। যদিও হালে তারা পারমাণবিক চুক্তির ইস্যুতে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসছে। ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমেদিনিজাদ আমেরিকায় এসেই তার মুখের ওপর ‘না’ বলেছেন বহুবার।
একসময় দোর্দণ্ড প্রতাপে আমেরিকাকে ‘না’ বলেছেন লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন। আফগানিস্তানের তালেবানরাও আমেরিকাকে ‘না’ বলেই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে বছরের পর বছর।
সিরিয়ার আসাদ সরকার ‘না’ মুখে নিয়েই যুদ্ধে আছেন আমেরিকার বিরুদ্ধে। গৃহযুদ্ধে সিরিয়া তছনছ কিন্তু গোঁ ছাড়েননি আসাদ সরকার। লাতিন আমেরিকায় ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়াসহ অনেক দেশই মার্কিনিদের ‘না’ বলে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক চেতনায়।
সুতরাং আমেরিকাকে ‘না’ বলার দেশ যে পৃথিবীতে নাই, এ কথা ঠিক না। যদিও বিপ্লববিধৌত কিউবা, ইরান কিংবা লাতিন দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। কেননা বাংলাদেশ কোনো বিপ্লবের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক লড়াই হচ্ছে একটি ন্যায্যতার দ্বারা চালিত আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সেই লড়াইয়ের পথে কোনো দেশকে ‘না’ বলার সংস্কৃতি খুব সুখকর অভিজ্ঞতা, এ কথা বলা যায় না। বাংলাদেশের প্রতিবেশী বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের দিকে তাকানো যাক। যে আমেরিকা ভিসা দেয়নি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে, সেই মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার পর অবশ্য ‘না’-এর পথ ধরেননি, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ভারতে আনার জন্য হ্যাঁ-এর পথে হেঁটেছেন। আমেরিকানদের ভারতমুখী ভিসার সব রুদ্ধ পথ খুলে দিয়েছেন ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের আশায়। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকার সঙ্গে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের মেলবন্ধন তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমেরিকাকে পাশে নিয়েই বাজার অর্থনীতির খোলা হাওয়ায় ভারতকে জাগাতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
৩.
আমেরিকাকে ‘না’ বলা দেশ যারা আছে, তারা কি খুব সুখকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? যে লিবিয়ার কথা আমরা বললাম, যে সিরিয়ার চেহারা আমরা দেখছি কিংবা যে ইরাকের পরিণতি আমরা পেয়েছিÑ তা কি কোনো দেশের কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হতে পারে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ক্রমাগত তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। সেখানে তার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ, কূটনৈতিকভাবে স্থিতিশীল, বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক সম্পর্ক তৈরি না করে একটা রাষ্ট্রিক বিরোধে আমরা জড়াচ্ছি কেন?
এতে আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক স্বার্থটাই বা কী?
বিষয়টা উল্টোভাবে দেখা যেতে পারে!
এক. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে একমত নয়। সেটিই যদি বর্তমান সরকারের গাত্রদাহের কারণ হয়, তবে সরকারের উচিত কূটনৈতিক চ্যানেলে আমেরিকাকে বোঝানো, এইভাবে নির্বাচন করা ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অসম্ভব ছিল।
দুই. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকারের ব্যাপারে নাখোশ হয়েই থাকে, তবে সরকারের উচিত আলোচনা চালিয়ে কূটনৈতিকভাবে আমেরিকাকে বোঝানো যে, এর চাইতে ভালো কোনো বিকল্প সরকারের হাতে ছিল না।
তিন. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ব্যাপারে অখুশি থাকেই, তবে তাকে কূটনৈতিকভাবে বার্তা দেয়া যে, এটা আমেরিকার সঠিক আচরণ নয়। যেখানে ভারত বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সয়ে নিয়েছে, যেখানে চীন এই নির্বাচন নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, সেখানে মার্কিনিদের এ বিষয়ে কথা বলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। কূটনৈতিক চ্যানেলেই আমেরিকাকে এ বার্তা দেয়া রাষ্ট্রনৈতিক আচরণ।
কিন্তু সরকার কী করছে? সরকার রাজনৈতিকভাবে সে বার্তা কূটনৈতিক চ্যানেলে পৌঁছাতে পারছে না। যুক্তি দিয়ে সে কথা জানাতে পারছে না। এমনকি বন্ধুপ্রতিম ভারতকে দিয়েও আমেরিকাকে বোঝাতে পারছে না।
৪.
বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবময় অর্জন। মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, গৌরবের সঙ্গে সবার সঙ্গে মর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে নেয়া। কোনো দেশের আচরণ যদি অপছন্দ হয়ই, তবে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কূটনৈতিক শক্ত অবস্থানের মাধ্যমে তা প্রতিহত করা। কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলা, কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের বুয়া’ অভিহিত করে দলীয় ফোরামে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর অভিধা দেয়া কিংবা কোনো দেশের মন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে প্রকাশ্য জনসভায় মন্তব্য করার মধ্যে কোনো মুনশিয়ানা নেই। বরং তাতে সরকারের অস্থিরতা ও দুর্বলতাই প্রকাশ পায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছে। তখন আমেরিকানদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করেছে। এই বক্তব্য সত্যি, কিন্তু পুরো ইতিহাস কি তাই? তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি আর এখনকার প্রেক্ষাপট কি এক?
এক. তখন বিশ্ব আমেরিকা ও রাশিয়া এই দুই ব্লকে বিভক্ত ছিল। ১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সোভিয়েত ব্লকের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে সোভিয়েত রাশিয়া উপর্যুপরি ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে।
দুই. তখন পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর একটি অন্যায্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। তখন, পাকিস্তানি হানাদাররা নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে না দিয়ে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছে। সেই অন্যায্য আচরণের বিপক্ষে ছিল বিশ্ব জনমত।
তিন. ১৯৭০ সালে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন হলেও সেই নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। পৃথিবীর কোনো দেশ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি।
চার. তখন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, চীনও পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছে।
পাঁচ. মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘না’ বলিনি। তাদের সাহায্য, সহযোগিতা নিয়েছি। বঙ্গবন্ধু মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
ছয়. ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত রাশিয়ান ব্লকের ছায়াতলে থাকা সত্ত্বেও, ভারতের সঙ্গে অকৃত্রিম মিত্রতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন রণনীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রনৈতিক বিজয় পাওয়া সম্ভবপর হয় নাই।
সুতরাং ১৯৭১ সালে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিজয় এলেও ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা বিরাজমান নয়। ১৯৭১ এবং ২০১৪ দুই বাস্তবতায়, সম্পূর্ণ দুই প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন এক অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা কূটনৈতিক অশিষ্টাচারের মধ্য দিয়ে আমেরিকাকে ‘না’ বলেননি। বরং পৃথিবীব্যাপী এক কূটনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে আমেরিকান অবস্থানের বিপক্ষে বাংলাদেশের জন্মার্জন ত্বরান্বিত করেছে। আমেরিকাকে কূটনৈতিকভাবেই পরাজিত করে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুস্থিত করেছে।
৫.
বিশ্বে এক নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থার আবির্ভাব হয়েছে। এককেন্দ্রিক আমেরিকানাইজেশন তার বিরুদ্ধে বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী গড়ে তুলতে দেয় নাই। পৃথিবীব্যাপী আমেরিকা এবং তার মিত্র শক্তি, বিশেষ করে ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বই জারি রেখেছে তাদের শাসন। ল্যাটিন আমেরিকাব্যাপী বামপন্থি সরকারগুলোর জাগরণ নতুন দিশা দেখাতে চাইলেও তার বিরুদ্ধেই নিজ দেশে প্রবল প্রতিরোধ উপস্থিত। তবুও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ল্যাটিন আমেরিকাব্যাপী এক লড়াই ক্ষীণস্বরে জারি আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার এই একতান্ত্রিক বিশ্ব শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল নব্য বুর্জোয়া রাশিয়া। ভøাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে বাজার অর্থনীতির মধ্য দিয়ে রাশিয়া হয়ে উঠছিল নতুনতর বিশ্বশক্তির প্রতিমূর্তি।
ইউরোপের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য আর চালু অর্থনীতি এক নতুনতর অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে রাশিয়াকে সামনে আনছিল। কিন্তু দ্রুতই বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার সেই কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রিক চেহারা বদলে যেতে থাকে। কেননা সামরিক আকাক্সক্ষা এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অনুপস্থিতি ক্রমশ রাশিয়াকে একনায়ক শাসিত দেশের অবয়ব দিতে থাকে। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি এবং ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার বিবাদ রাশিয়াকে আবার পশ্চিমা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন মওকা পায় উদীয়মান রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে। জারি হয় নতুন নতুন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে অভ্যন্তরীণভাবে বিপদাপন্ন করতে থাকে। কিন্তু একনায়ক পুতিন থামেন না। তার রণনীতি অপরিবর্তিত থাকে। ফলে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকে। বিদেশি বিনিয়োগ চলে যেতে থাকে। রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের ব্যাপক দরপতন ঘটে। রাশিয়ার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি জ্বালানির দাম কমতে থাকে। ক্রেতারা দূরে সরে যায়। তবুও ভ্লাদিমির পুতিন উগ্রজাতীয়তাবাদের গান জারি রেখেছেন উচ্চস্বরেই।
রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের এই ‘শাসন মডেল’ বিশেষ সুবিধা দেয় চীনকে। চীন আমেরিকার সঙ্গে একইভাবে বাণিজ্যিক মিত্রতা ও প্রতিযোগিতা দুটোই সচল রেখেছে। রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে তুলনামূলক কম দামে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি কেনার সুযোগ পায় চীন। আন্তর্জাতিক বাজারের চাইতে কম দামে রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ক্রয় চুক্তি চীনকে অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ সুবিধা দেয়।
রাশিয়ার এই ‘পুতিন’ শাসন মডেলের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে পুতিন কর্তৃক রাশিয়ার ক্ষমতায় টিকে থাকা। রাশিয়াতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে, রাজনৈতিক মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করে এক ধরনের পুতিনবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাশিয়ায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ কি ভারতের ওপর নির্ভর করে, আমেরিকাকে ‘না’ বলে একটা রাশান মডেলের রাষ্ট্রে পরিণত হতে চাইছে? বাংলাদেশের জনগণ শেষ বিচারে পুতিনমুখী সরকার এবং রাশান মডেলের রাষ্ট্রব্যবস্থা মেনে নেবে?
৬.
প্রশ্ন হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সমুন্নত হওয়ার বদলে কেন বাংলাদেশ সেই রকম ‘কালচার অব ডিনায়েল’ পথে হাঁটতে চাইছে? এটার কারণ হয়ত এরকম :
এক. একচ্ছত্র ক্ষমতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক ধরনের রাজনৈতিক মনোবৈকল্য তৈরি করে। তখন নিজেকে সীমাহীন কর্তৃত্বময় মনে হয়। চারপাশে বড়-ছোট সবকিছুকে তুচ্ছ মনে হয়। ব্যক্তি তো বটেই রাষ্ট্র, সমাজ, বৈশ্বিক বিবেচনাতেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভর করে। দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের নেতিবাচক, অন্ধত্ব তৈরি হয়।
দুই. নতুন আইডিয়া বা ধারণাকে মৃত মনে হয়। গণতান্ত্রিক বিকাশের সব পথ রুদ্ধ করে নিজেকেই ‘ঈশ্বর’ ভাবতে আনন্দযোগ ঘটে। দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিকতা এই ক্ষমতামদমত্ততাকে আরও প্রবল করে তোলে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থায় সেই ‘কালচার অব ডিনায়েল’ বা ‘অবজ্ঞার সংস্কৃতি’ ভর করেছে। আমাদের রাষ্ট্রনায়করা এখন কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরোয়া করছেন না। যারাই ৫ জানুয়ারি ২০১৪ এর দশম সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের ব্যাপারেই শাসকগোষ্ঠীর এক ধরনের অবজ্ঞার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হচ্ছে। দেশের মানুষ তো বটেই, বিদেশের রাষ্ট্রনায়কদেরও এই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরকম তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছেন।
তিন. এর মধ্য দিয়ে কথিত ক্ষমতাধরদের এক ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শনের মনোভঙ্গি প্রকাশ পাচ্ছে, যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
৭.
গণতান্ত্রিক শক্তির জোরে, শিক্ষার জোরে, উদ্ভাবনী শক্তির সক্ষমতায় অর্থনীতির প্রাবল্যে কিংবা যেকোনো সামাজিক-রাজনৈতিক বিপ্লবের জোরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একটা দেশের সরকার যদি আমেরিকার যেকোনো নেতিবাচক আবদারের বিপক্ষে ‘না’ বলতে পারে, তবে সেটা দেশের শক্তিমত্তাকেই বোঝায়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রবণতা কি সেই ধাঁচের? বাংলাদেশের সরকার যেভাবে, যে প্রক্রিয়ায়, যে বিবেচনাতে আমেরিকাকে ‘না’ বলতে চাইছে, তা যতটা না রাষ্ট্রনৈতিক, যতটা না কূটনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত, তার চাইতে অনেক বেশি ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত। রাষ্ট্রাচারে ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কোনো জায়গা নেই। বালখিল্যতার কোনো সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শুধু নিজেকেই গণতান্ত্রিক দাবি করে হৈ চৈ করলে হবে না, বিশ্বকেও বুঝতে হবে আচরণে-প্রক্রিয়ায়-রাষ্ট্রাচারে রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক। বিশ্ব যদি না বোঝে, তবে কী করলে বুঝবে, সেই কর্তব্য পথে হাঁটাই একটি রাষ্ট্রের পরিচালনায় যারা থাকেন তাদের দায়িত্ব।
আমেরিকাকে মুখের ওপর ‘না’ বলে যারা শক্তিমান বলে নিজেদের প্রচার করতে চাইছেন, তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রাচারের ন্যূনতম কূটনৈতিক পথেও হাঁটছেন না। এটা সুস্থতা নয়, রোগের লক্ষণ। এই সংস্কৃতি নিম্নমুখীন। এটা আত্মধ্বংসী। ক্রমশ এটা সরকার, সরকারদলীয় লোকজন এবং সরকারমুখীন দলদাস রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমলাতান্ত্রিক অংশে মহামারির মাত্রা ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন সবকিছুকেই তুচ্ছ মনে হবে। সব কিছুতেই ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। সব অনাচারকেই নিজেদের অনুকূলে সঠিক, ন্যায্য বলে মনে হবে। আখেরে যা পুরো দেশ, দেশের দূরবর্তী ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫২:০৩ ৩১৮ বার পঠিত
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)জাতীয়’র আরও খবর
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
কোয়ার্টারে ব্রাজিল ক্রোয়েশিয়া মুখোমুখি
ব্যাংকে টাকা নিয়ে গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির লটারি ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর
২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে করোনা টিকার চতুর্থ ডোজ
সউদী আরব তৈরি করবে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর
-
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত ওসমানীনগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২ -
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]