বঙ্গ-নিউজ: ভালুকা ও গৌরীপুর হানাদার মুক্ত দিবস ৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বস্তরের জনতা ও মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে ভালুকা ও গৌরীপুরের আকাশে উড়িয়েছিল লাল-সবুজ আর মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। রক্তঝরা ৯ মাসের য্দ্ধু শেষে বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছিল ভালুকা ও গৌরীপুরের মুক্তিযোদ্ধা-জনতা।
১৯৭১ সালের ৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে গৌরীপুরবাসী উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন। তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের স্থানীয় সদস্য মরহুম হাতেম আলীর নেতৃত্ব সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। গৌরীপুর কলেজ ও রাজবাড়ীতে স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ছাত্র যুবকরা ক্যাম্পে এসে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। দু’জন সাবেক সেনা সদস্য ক্যাম্প দুটিতে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহেই শহীদ হারুন উদ্যানে ছাত্রলীগ কর্মীরা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বিমান থেকে গোলা বর্ষণ ও রেলপথে এসে ভারী অস্ত্রে হামলা চালিয়ে গৌরীপুর শহর দখল করে নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান। শহর দখলের সময় পাকিস্তানি সেনারা কালীপুর মোড়ে স্কুল শিক্ষক নরেন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে। তারা শহরে ঢুকে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় অগ্নিসংযোগ করে ও লুটপাট চালায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গৌরীপুর ছিল ১১নং সেক্টরের অধীনে। এই সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়পুর, চারুয়াপাড়া বিওপি, কলমাকান্দা, ফুলপুর, গৌরীপুর, কলসিন্দুর, পূর্বধলা, ময়মনসিংহ, নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে। কোম্পানি কমান্ডার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি প্লাটুনে বিভক্ত হয়ে ময়মনসিংহ সদর, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুরসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগুপ্তা হামলায় পাকিস্তানি বাহিনী তখন দিশেহারা। মুক্তিযোদ্ধারা গৌরীপুরকে হানাদারমুক্ত করতে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অবস্থানের খবর পেয়ে হানাদাররা তাদের শহরের ক্যাম্প গুটিয়ে রাতের আঁধারে ময়মনসিংহ শহরে পালিয়ে যায়। রেখে যায় তাদের দোসর রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের। ৮ ডিসেম্বর রাজাকার ও পুলিশরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ সময় ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গৌরীপুর। মুক্তিযোদ্ধারা লাল-সবুজ আর মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেন।
মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, আনোয়ারুল হক, সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুল হাই, হাতেম আলী, আফাজ উদ্দিন, জসীম উদ্দিন, আনোয়ারুল ইসলাম মঞ্জু, সিরাজুল হক, আব্দুল মতিন ও সুধীর বড়-য়া মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে শহীদ হন।
৮ ডিসেম্বর ভালুকা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত দিবস: ৭১ এর ৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে আফসার বাহিনীর চারটি কোম্পানির মুক্তিসেনারা তিনদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমন শুরু করলে ভোর রাতে ভালুকা ক্যাম্পের শতাধিক পাক সেনা ও ৮ শতাধিক রাজাকার-আলবদর ক্যাম্প ছেড়ে গফরগাঁওয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই দিন ভোরে আফসার বাহিনীর মুক্তিসেনারা ভালুকা সদরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তেলন করে ভালুকাকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করে।
দিবসটি পালনের জন্য ভালুকা মুক্তদিবস উদযাপন কমিটি দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ব্রিটিশ-ভারত সেনাবাহিনীর (অবঃ) সুবেদার মেজর তৎকালীন ভালুকা থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আফসর উদ্দিন আহমেদ পারুলদিয়া গ্রামের আব্দুল হামিদ মেম্বারের একটিমাত্র রাইফেল ও ৮ জন সদস্য নিয়ে ভালুকা থানার মল্লিকবাড়ি বাজারে মুক্তি বাহিনী গঠন করেন। আফছার উদ্দিনের ৮ সদস্যের বাহিনীটি পর্যায়ক্রমে সাড়ে ৪ হাজার সদস্যে উন্নীত হয়ে একটি অনিয়মিত বাহিনীতে পরিণত হয়। পরে এই বাহিনী সামরিক বাহিনীর মত ২৫টি কোম্পানিতে ভাগ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। আফসার বাহিনীর ৫৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মেঘালয়ে ডালুকালিপুরা ক্যাম্পে উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অফসার বাহিনীর যুদ্ধ এলাকা ছিল ভালুকা, গফরগাঁও, নান্দাইল, ত্রিশাল ও ফুলবাড়িয়া থানা, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর থানা, টাঈাইল জেলার বাসাইল, বর্তমান সখিপুর ও কালিহাতি থানা এলাকা। এ সব এলাকায় আফসার বাহিনীর মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে শতাধিক সন্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়। এসব যুদ্ধে কয়েক’শ পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয় এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এসব যুদ্ধে আফসার বাহিনীর ৩০ জন যোদ্ধা শহীদ হন।
৮ ডিসেম্বর ভালুকা মুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা জনতার র্যালী ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন মুক্তদিবস উদযাপন কমিটির আহবায়ক ও উপজেলা কমান্ডার মফিজুর রহমান।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৫৮:১০ ৩৮০ বার পঠিত