বঙ্গ-নিউজঃঅ্যালার্জি শব্দটির সাথে পরিচিত নন এমন লোক খুব কমই আছেন। এটি একটি গ্রিক শব্দ। এর অর্থ হলো পরিবর্তন প্রতিক্রিয়া।চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরভাষায় অ্যালার্জি হলো শরীরের এক ধরনের প্রতিরোধগত পদ্ধতি, যার মধ্য দিয়ে শরীরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সে অনুযায়ী শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে।শরীরের ভেতর যখনই কোনো অসহনীয় পদার্থ যেমন এন্টিজেন প্রবেশ করে তখন তাকে শনাক্ত এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে শরীরের সাহায্যকারী টি (T) কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয় এবং প্রতিরোধক এন্টিবডি আইজিই (IgE) উৎপন্ন হয়।
এই প্রতিরোধক এন্টিবডির সাথে একত্রিত হয় শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন আরো অনেক রাসায়নিক পদার্থ। এরপর শুরু হয় প্রতিক্রিয়া। সব শেষে প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বের হয় হিস্টামিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসায়নিক পদার্থটি বহিরাগত অচেনা বস্তুটিকে নিষ্ক্রিয় এবং নিষ্ক্রান্ত করে, আবার অনেক সময় এই ভয়ানক প্রতিক্রিয়ায় শরীর নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি
অ্যালার্জির রয়েছে বিচিত্র সব ধরন। যেমন
অ্যানাফাইলেক্সিস
এটি সবচেয়ে ভয়াবহ অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া। রোগ নিরূপণকারী রেডিও কনট্রাস্ট মিডিয়া; কিছু ওষুধ যেমন পেনিসিলিন, হেপারিন, আফিম, বিভিন্ন পোকামাকড়, মৌমাছি, সাপের কামড় ইত্যাদিকে যে মারাত্মক অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া হয় তাতে একজন মানুষের মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে। এ ধরনের অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়ায় যেসব উপসর্গ দেখা দেয় সেসব হলো শ্বাসকষ্ট, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া, ডায়রিয়া, বমি, চোখমুখ ফুলে যাওয়া প্রভৃতি।
খাবারজনিত অ্যালার্জি
কারো কারো ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাবার যেমন দুধ বা দুধজাত পণ্য, মাছ, গরুর গোশত, ডিম, নারকেল, কচু, পুঁইশাক ইত্যাদি খাওয়ার পর বিভিন্ন উপসর্গ যেমন চোখ-মুখ ফুলে যাওয়া, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকে ফুসকুড়ি, বমি এবং ডায়রিয়া দেখা দেয়। মূলত এসব অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া। আবার জন্মগতভাবে ল্যাকটোজজাতীয় খাবারের প্রতি অসহনীয়তা যেকোনো শিশুর দুধজাত খাবারে ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে। সাধারণত এটা হয় শিশুকে দ্রুত বড়দের খাবার ও গরুর দুধে অভ্যস্ত করতে চাইলে। তবে দেখা গেছে, যেসব শিশুর ছোট বেলায় দুধ ও দুধজাত খাবারের প্রতি অ্যালার্জি ছিল তাদের ৬০-৯০ শতাংশ শিশুই ৪ বছর বয়সে এসব খাবারে ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে পড়েছে।
ওষুধ অ্যালার্জি
সাধারণত ১-৩ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রায় সব ওষুধেই অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ওষুধজনিত অ্যালার্জি কখনোই উপেক্ষা করা যাবে না। দেখা গেছে, এ ধরনের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে প্রতি দশ হাজারে একজনের মৃত্যু হয়। আমেরিকার বোস্টন কোলাবোরেটিভ ড্রাগ সারভিলেন্সের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পেনিসিলিন ও তার সমগোত্রীয় ওষুধগুলো, সালফোনামাইডস, এনএসএআইডি এবং অ্যাসপিরিনজাতীয় ওষুধে সবচেয়ে বেশি অ্যালার্জি দেখা দেয়। ব্যক্তিবিশেষে অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে। যেমন একজন বয়স্ক পুরুষের প্রতিক্রিয়ার হার কম। মহিলাদের প্রতিক্রিয়ার হার তুলনামূলক বেশি। আবার H2 ADR ও জেনেটিক টাইপে উল্লিখিত ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ার হার অপেক্ষাকৃত বেশি। অসুস্থ অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া বেশি হয়।
অ্যালার্জিজনিত সর্দিকাশি
অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়ার কারণে অনেকের সর্দি-কাশি হতে পারে। সর্দি-কাশির সাথে ঘন ঘন হাঁচি। নাক-চোখ চুলকানো, চোখ দিয়ে পানি পড়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বংশগত কারণে এটা হতে পারে। সাধারণত মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে এ ধরনের অ্যালার্জির প্রবণতা বেশি থাকে। শীতকালে এর প্রকোপ বেড়ে যায়। অ্যালার্জির সাথে অনেক সময় হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। সাধারণত বাতাসে ভেসে আসা ধূলিকণা কিংবা পরাগরেণু গ্রহণে এ ধরনের প্রকৃতিগত অ্যালার্জি হয়ে থাকে। জন্মের দু’বছর পর থেকে এ ধরনের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
ত্বকের অ্যালার্জি
অ্যালার্জেন বা উত্তেজক রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে এ ধরনের অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এসব রোগীর চার-পঞ্চমাংশই প্রাথমিক এবং সহজাত উত্তেজক পদার্থ যেসব জৈব দ্রাবক, ধৌতকারক সাবান, ডিটারজেন্ট বা এ ধরনের সামগ্রীর কারণে অ্যালার্জির শিকার হন। যেসব লোক চামড়া, প্রসাধন সামগ্রী কিংবা ধাতববস্তু তৈরির কারখানায় কাজ করেন তারাও এ ধরনের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হতে পারেন।
অ্যাটোপিক অ্যালার্জি
এটা হলো জন্মগত অ্যালার্জি। যেসব শিশু এ ধরনের অ্যালার্জি নিয়ে জন্ম নেয় দেখা গেছে, পরে তারা অ্যালার্জিজনিত সর্দি ও হাঁপানিতে ভোগে। সাধারণত ২-৮ শতাংশ শিশু জন্মের পর ২-৩ মাসেই অ্যাটোপিক অ্যালার্জির শিকার হয় এবং শৈশবের ৩-৫ বছর পর্যন্ত তাদের এ অবস্থায় কাটে এরপর তারা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। উপসর্গ হিসেবে তাদের পুরো শরীরে চুলকানি দেখা যায়। বালিশ বা বিছানায় চাদরের ঘর্ষণে মুখে, গালে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে লালচে দাগ ও আঠালো ক্ষত দেখা যায়। অ্যালার্জিজনিত খাবার গ্রহণ করলে কিংবা সাবান বা শ্যাম্পু ব্যবহারে এ ধরনের অ্যালার্জি আবার দেখা দেয় ও সেটা প্রকট আকার ধারণ করে।
পোকামাকড়জনিত অ্যালার্জি
অনেকেরই মশা, পিঁপড়া প্রভৃতির কামড়ে ত্বকের নির্দিষ্ট অংশে অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু এ ছাড়া কিছু কিছু পিঁপড়াগোত্রীয় প্রাণী, মৌমাছি, ভোমরা প্রভৃতির কারণে প্রাণঘাতী অ্যালার্জিজনিত অ্যানাফাইলেকটিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। পোকামাকড়জনিত অ্যালার্জির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জায়গা ফুলে যাওয়া, সর্দি, চোখের কনজাংটিভা প্রদাহ, এমনকি হাঁপানি দেখা দিতে পারে।
পরিবেশগত অ্যালার্জি
বিভিন্ন ফুলের পরাগরেণু অ্যালার্জির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। রঙ বৈচিত্র্যহীন ফুলগুলোর পরাগরেণু হালকা থাকে। এগুলো সাধারণত বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটায়। বৈচিত্র্যপূর্ণ রঙিন ফুলগুলো পোকামাকড় ও পাখির মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটায় এবং এদের পরাগরেণু অপেক্ষাকৃত ভারী ও আঠালো ধরনের। এজন্য বাতাসজনিত পরাগরেণুগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিঃশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে অ্যালার্জির সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। আমেরিকায় এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেখানে রেগ উইড নামক এক ধরনের গুল্ম বর্ষার সময় অ্যালার্জির প্রকোপ ঘটায়। আমাদের দেশে সরিষা ফুলের ভারী পরাগরেণু পোকামাকড়ের মাধ্যমে এ ধরনের সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। এ ছাড়া পোকামাকড়ের মল, লোমশ প্রাণী যেমন কুকুর, বেড়ালের শরীরের ধুলো প্রভৃতি অ্যালার্জির পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখে।
পেশাগত অ্যালার্জি
পেশাগত কারণে এ পর্যন্ত প্রায় ২শ’টি বিভিন্ন প্রাকৃতিক অ্যালার্জিক বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে প্লাটিনামের এক ধরনের জটিল লবণ আইসো সায়ানাইটিস, অ্যাপোক্সি রেসিন, কলোফনির ধোঁয়া, প্রোটিনধ্বংসী এনজাইম, রসায়নাগারের জন্তুর মলমূত্র, শস্যের ধুলো, প্রাকৃতিক আটা প্রভৃতি। এ ধরনের অ্যালার্জিক পদার্থ কর্মক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ ঘটায়। যেসব কুলি-মজুর জাহাজের মাল খালাস করেন তারা সাধারণত পেডিকিউলয়েডস ভেন্ট্রিকোসাস নামক এক ধরনের উঁকুনের শিকার হন যা থেকে ত্বকের অ্যালার্জি দেখা দেয়।
অ্যালার্জি প্রতিরোধের উপায়
অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এন্টি হিস্টাসিনজাতীয় ওষুধ ও স্টেরয়েড ব্যবহারে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে অ্যালার্জি প্রতিহত করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে যা করণীয় তা হলো
১.সর্বদা সুতির পোশাক পরিধান করা
২. উল ও ফানেলের পোশাক পরিধান করলে তা থেকে অ্যালার্জি সৃষ্টি হয় কি না সেদিকে খেয়াল রাখা
৩. আসবাবপত্র যেমন তুলো বা ছাবড়াযুক্ত আসবাবপত্র, উদ্ভিদ বা প্রাণী সজ্জিত খেলনা, কম্বল, পশমি কাপড়, ভেনেসমীয় খড়খড়ি, কার্পেট, জাজিম, পাপোস এগুলোকে সাবধানে ও যত্ন সহকারে ধুলোমুক্ত রাখা এবং সম্ভব হলে বর্জন করা
৪. অ্যালার্জিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ধুলোবালি থেকে সরিয়ে রাখা
৫. যেসব স্থানে ধুলো জমতে পারে সেসব স্থান বন্ধ করে দেয়া
৬. যদি ভ্যাকুয়াম কিনারের মতো পরিষ্কারক যন্ত্র থাকে তবে নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলোর ফিল্টার পরিবর্তন করা
৭.অ্যালার্জি সৃষ্টি করে এমন ওষুধ পরিহার করা
৮. যেসব খাবারে অ্যালার্জি হয় তা শনাক্ত করা ও বর্জন করা
৯. যখন তখন যেকোনো ফুলের ঘ্রাণ না নেয়া বা তার সংস্পর্শে না যাওয়া
১০. শিশুদের ও অ্যালার্জিগ্রস্ত ব্যক্তিদের লোমশ প্রাণী থেকে দূরে থাকা
১১. বাইরে বেরোনোর সময় সর্বদা মাস্ক বা মুখোশ ব্যবহার
বাংলাদেশ সময়: ১২:২৩:৫৭ ৩৫২ বার পঠিত