সম্প্রতি বিশ্বের কয়েকটি সংগঠন ধর্ষণে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। সংগঠনগুলোর মধ্যে আছে, ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিক্স, ন্যাশনার ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন সার্ভার, কমিউনিটি অব ইনফরমেশন, এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্টস ব্যুরো, জাস্টিস ইন্সটিটিউট অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া। তারা তাদের গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের যে মাত্রা সেটি তুলে ধরেছেন। এখানে ধর্ষণে শীর্ষ থাকা ১০টি দেশের তালিকা তুলে ধরা হলো:
যুক্তরাষ্ট্র
ধর্ষণের দিক দিয়েও বিশ্বের সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র প্রথম। এখানে ৯৯ ভাগ ধর্ষকই পুরুষ। যারা শিকার তাদের মধ্যে ৯১ ভাগ নারী এবং ৯ ভাগ পুরুষ। ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিক্স এর তথ্য এগুলো। ন্যাশনাল ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন সার্ভের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন আমেরিকান নারী এবং প্রতি ৩৩ জনের মধ্যে ১ জন পুরুষ সারাজীবনে একবার অন্তত ধর্ষণের প্রচেষ্টা বা সম্পূর্ণ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কলেজে যাওয়ার বয়সী মেয়েদের এক চতুর্থাংশের বেশি তাদের ১৪ বছর বয়সের পর থেকে এই প্রচেষ্টা বা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মাত্র ১৬ শতাংশ কেস দাখিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ঘরের বাইরের তুলনায় ঘরের ভেতরে ধর্ষণের ঘটনা বেশি হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা
২০১২ সালে ৬৫,০০০ ধর্ষণ এবং আরো অনেক যৌন হয়রানির অভিযোগ দাখিল করা হয়। দেশটিকে পৃথিবীর ‘ধর্ষণের রাজধানী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কমিউনিটি অব ইনফরমেশন, এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি থেকে ৪০০০ নারীকে প্রশ্ন করা হয়। প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জন উত্তর দেয় যে এর আগের বছর সে ধর্ষিত হয়েছে। মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের এক জরিপে দেখা গেছে যে ২৫ ভাগের বেশি সাউথ আফ্রিকান পুরুষ ধর্ষণ করেছে, এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বলেছে যে তারা একের অধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে। যারা স্বীকার করেছে তাদের প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জনই বলেছে যে তাদের টিনএজ বয়সে তারা এই আক্রমণ করেছে। শিশু ধর্ষণে অন্যতম সাউথ আফ্রিকা। ধর্ষণের অপরাধে সাজা হয় মাত্র ২ বছর।
সুইডেন
ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ রিপোর্ট করা হয় সুইডেনে। এখানে প্রতি ৪ জন নারীর ১ জন ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১০ সালের মধ্যে সুইডিশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৬৩ ভাগ এর শিকার হয়। ২০০৯ সালে ১৫,৭০০ রেপ কেস রিপোর্ট করা হয় যা ২০০৮ সালের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৫,৯৪০টি ছিল ধর্ষণ এবং ৭,৫৯০টি যৌন হয়রানির যার ভেতরে গোপন চিত্র প্রকাশ করে দেয়া অন্তর্ভুক্ত। ২০০৯ সালে দেখা যায় যৌন অপরাধ এর আগের ১০ বছরের চাইতে ৫৮ শতাংশ বেড়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী রিপোর্ট করা হয়েছে এমন ধর্ষণের ঘটনা পুরো ইউরোপের মধ্যে সুইডেনে সবচাইতে বেশি।
ভারত
ভারতে যৌন হয়রানি ক্রমশ বাড়ছে। নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধের মধ্যে ধর্ষণ সেখানে অন্যতম। ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্টস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে ২৪,৯২৩টি রেপ কেস রিপোর্ট করা হয়, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে অলিখিত কেসগুলো মিলিয়ে হিসাব করলে এই সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। এর মধ্যে ২৪,৮৭০টি ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে অভিভাবক/পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী ও পরিচিত মানুষ দ্বারা, ৯৮ ভাগ ধর্ষকই ছিল ধর্ষিতার পরিচিত। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রতি ২২ মিনিটে ভারতে একটি করে নতুন রেপ কেস রিপোর্ট করা হয়।
যুক্তরাজ্য
অনেকেই একটি উন্নত দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে থাকতে চায়, অন্তত বেড়ানোর জন্য হলেও যেতে চায়। কিন্তু তারা হয়ত অবগত না যে ধর্ষণের মতো অপরাধে সাংঘাতিকভাবে ডুবে আছে এই দেশ। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দেশটির মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস, অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স এবং হোম অফিস যুক্তরাজ্য ও ওয়েলসে সংঘটিত যৌন সহিংসতার ওপর একটি বুলেটিন একসঙ্গে প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়- প্রতি বছর গড়ে ৮৫,০০০ নারী ধর্ষিত হয়। ৪ লাখের ওপরে নারী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়। প্রতি ৫ জন (১৬-৬৫ বছর বয়সী) নারীর মধ্যে একজন কোনো না কোনো যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন জীবনে।
জার্মানি
এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার নারী ও শিশু ধর্ষণের ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে জার্মানিতে। এ বছর জার্মানিতে রিপোর্ট করা হয়েছে ৬৫ লাখ ৭ হাজার ৩শ ৯৪টি রেপ কেস যা একটা বিরাট সংখ্যা। জার্মান ক্যাথলিক সরকার ধর্ষিতাদেরকে মর্নিং আফটার পিল খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। প্রযুক্তিতে ক্রমবর্ধমান এই দেশটি আসলে মানবিকতায় পিছিয়ে যাচ্ছে।
ফ্রান্স
১৯৮০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে ধর্ষণ কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো না। নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়ন খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। মাত্র ১৯৮০ সালে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আইন পাশ হয়। এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর মোরাল কোড অনুযায়ী ডিক্রী জারি করা হতো। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটি আইন অনুমোদন পায় ১৯৯২ সালে এবং নৈতিক হয়রানির বিরুদ্ধে আরেকটি পায় ২০০২ সালে। নারীর ওপর সহিংসতা প্রতিরোধে শেষ বিলটি পাশ হয় গতবছর। সরকারি হিসাবে প্রতি বছর দেশটিতে ৭৫,০০০ ধর্ষণ সংঘটিত হয়। মাত্র ১০ ভাগ নির্যাতিতা অভিযোগ দাখিল করেছে। ৩৭ লাখ ৭১ হাজার ৮শ ৫০টি দাখিলকৃত ধর্ষণের হিসাব নিয়ে ফ্রান্স এ তালিকায় সপ্তম।
কানাডা
অষ্টম অবস্থানে আছে কানাডা। এটি এমন একটি দেশ যেখানে শাস্তি প্রদান করা হয়। এ দেশে রিপোর্টেড কেসের সংখ্যা ২৫ লাখ ১৬ হাজার ৯শ ১৮ এবং মোট রেপ কেসের তা মাত্র ৬ ভাগ। প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে ১ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয় কিন্তু মাত্র ৬ শতাংশ পুলিশে রিপোর্ট করা হয়। জাস্টিস ইন্সটিটিউট অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার মতে প্রতি ১৭ জন নারীর ১ জন ধর্ষিত হয়েছে, ৬২ শতাংশ ধর্ষিতা শারীরিকভাবে আহত হয়েছে এবং ৯ শতাংশ ধর্ষিতা মার খেয়েছে ও তাদেরকে বিকৃত করে দেয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজনদের ধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি অভিযোগ এসেছে যে সিভিল ওয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার ৪ বছর পরেও শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী অত্যাচার ও ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। পুরুষ ও সহিংসতা বিষয়ে জাতিসংঘের একটি মাল্টি কান্ট্রি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে শ্রীলঙ্কার ১৪.৫ শতাংশ পুরুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ধর্ষণ করেছে। ৪.৯ শতাংশ পুরুষ গতবছর ধর্ষণ করেছে। ২.৭ শতাংশ পুরুষ অন্য পুরুষকে ধর্ষণ করেছে। ১.৬ শতাংশ পুরুষ কোনো গণধর্ষণে অংশ নিয়েছে। ধর্ষণকারীদের মধ্যে ৯৬.৫ শতাংশ পুরুষ কোনো আইনি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি। ৬৫.৮ শতাংশ ধর্ষক কোনোরকম উদ্বেগ বোধ করেনি বা অপরাধবোধে ভোগেনি। ৬৪.৯ শতাংশ একবারের বেশি ধর্ষণ করেছে এবং ১১.১ শতাংশ ধর্ষক ৪ বা তার অধিক শিশু ও নারী ধর্ষণ করেছে।
ইথিওপিয়া
এ তালিকার দশম অবস্থানে আছে ইথিওপিয়া। নারীর প্রতি সহিংসতায় অন্যতম এই দেশটি। জাতিসংঘের একটি জরিপে উঠে এসেছে যে এ দেশের প্রায় ৬০ ভাগ নারী যৌন সহিংসতার শিকার। ধর্ষণ খুবই গুরুতর একটি সমস্যার আকার নিয়েছে সেখানে। অপহরণ করে বিয়ে করার কারণে ইথিওপিয়া কুখ্যাত এবং এই ব্যাপারটি সেদেশেই সবচাইতে বেশি হয়। সেখানে অনেক জায়গায়ই পুরুষরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে কোনো মেয়ে বা মহিলাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং তারা ঘোড়া ব্যবহার করাতে পালাতে সুবিধা হয়। ইথিওপিয়ায় এটা খুব সাধারণ ঘটনা। অপহরণকারী এরপর তার কনেকে ধর্ষণ করে চলে যতদিন না সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। ১১ বছরের কন্যাশিশুও ছাড়া পায় না তাদের হাত থেকে। এছাড়া ইথিওপিয়ার মিলিটারিরাও এই অপরাধে অভিযুক্ত।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:৩২:২৯ ৪৭৩ বার পঠিত