রাতুল, বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ ওয়ার্ডেন অ্যাভিনিউ থেকে ড্যানফোর্থে ঢুকে কিছু দূর এগোলেই লাল ইটের একটা সাদামাটা ঘর। ইংরেজি ও বাংলায় ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ’ লেখা না থাকলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি মসজিদ। বাইরে থেকে দেখা কলকাতার পাতালরেলের স্টেশনের মতো বৈশিষ্ট্যহীন একটা বড় বাক্সের মতো ঘর। কেবল জানালার মতো নকশাগুলোর ধনুকাকৃতি দেখে ইসলামি স্থাপত্যের চিহ্ন পাওয়া যায়। আসরের নামাজের সময় কখনো ওদিক দিয়ে গেলে দেখা যায় সাদা জোব্বা পরা দু-একজন কিশোর দরজা খুলে ঢুকে পড়ছে মসজিদের ভেতর। তার পাশেই ওয়ানস্টিড ইউনাইটেড চার্চ। বায়তুল মোকাররম মসজিদ ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে গেলে আধা কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে সেন্ট ডানস্টান ক্যাথলিক গির্জা। তার পরই বায়তুল আমান মসজিদ এবং সান্ধ্য ও সাপ্তাহিক ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র। এটি পেরিয়ে গেলে বাংলা টাউন। ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউর একপাশ জুড়ে পর পর প্রায় সবগুলো বাংলাদেশিদের দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, ব্যবসায়িক অফিস। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা সাইনবোর্ড এবং চারপাশে বাংলাদেশি চেহারার মানুষজন দেখে বিদেশ বলে মনে হয় না।
আজকাল পত্রিকা অফিসের ঠিক উল্টোপাশে ‘কফি টাইম’ নামের ফাস্ট ফুডের দোকান, ‘টিম হর্টনস’-এর মতো জাঁদরেল চেইন-এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাঁড়ানো। ভেতরে ঢুকলে মনে হয় ঢাকার কোনো কফি শপ, সব টেবিলে বাংলাদেশি চেহারা। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টিভেজা সন্ধে, ভেতরে এক কাপ কফি নিয়ে গল্প করছে সবাই। বাংলাদেশের কোনো রেস্তোরাঁর দেয়ালে যেমন লেখা থাকে ‘রাজনৈতিক আলোচনা নিষেধ’, এটির দেয়ালেও একটা বোর্ডে নোটিশ লেখা যে ৩০ মিনিটের বেশি যাতে কেউ টেবিল দখল করে না রাখে। অন্যান্য পিক আওয়ারে এই নির্দেশ পালিত হলেও বিকেলের এই অলস সময়ে বোধকরি তার বাধ্যবাধকতা নেই।
কবি-সাংবাদিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল প্রায় সাত বছর ধরে কানাডায় বসবাসরত। কানাডা যাবেন কেন যাবেন বইটির জন্য ওকে অনেকেই কানাডায় অভিবাসন-বিশেষজ্ঞ বলে মনে করেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ হয়তো কোনো বাংলাদেশি তরুণ এসে ওকে থামিয়ে বলছেন, একটু কথা বলা যাবে? উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেও ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বলছে, জি বলেন। কথায় কথায় জানা যায়, ভাগ্যান্বেষী তরুণ টরন্টোয় এসেছেন কিছু করার আশায়। দুলাল অভিজ্ঞ উকিলের মতো জেরা করছে, কখন এসেছেন, কী ভিসায় এলেন, দেশে থাকতে কী করতেন, অন্য কোনো শহরে চেষ্টা করেছেন কি না ইত্যাদি। বিভ্রান্ত সেই তরুণ হয়তো শুনেছেন কানাডায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অঘোষিত উপদেষ্টা দুলালের কথা, কিংবা ওর বইটির নাম-অধ্যায়টা পড়েছেন। দুলালের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ, বিব্রতবোধে বিপন্ন, কারণ ভাগ্যান্বেষী এই যুবককে টরন্টোর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বললে হয়তো ওকে ভুল বুঝবেন। আবার কানাডায় অভিবাসন কিংবা কাজের সুযোগ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিতে অনিচ্ছুক দুলাল। কানাডার সোনার হরিণের পেছনে ছুটে দেশে সবকিছু ছেড়ে এখানে চলে আসার বিষয়ে মানুষকে নিবৃত্ত করতে চেয়ে বহু মানুষের ভুল-বোঝাবুঝির শিকার হতে হয়েছে ওকে। ভুল বোঝা মানুষের ধারণা, ও যেহেতু এত বছর ধরে রয়ে গেছে, এখানে নিশ্চয়ই কাজের অবাধ সুযোগ, অথচ নতুন আসা মানুষকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছে ও। তাই আজকাল মানুষকে আর বাস্তব ধারণা দিতে আগ্রহী নয় ও, আবার মিথ্যে আশ্বাসও দেয় না, তাই কর্মপ্রত্যাশী সেই যুবককে একটা অস্পষ্ট গা ছাড়া জবাব দিয়ে কাজ সারে ও।
অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষ দীর্ঘদিনের অভিবাসীদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে অক্ষম। দেশের অনেক কিছু ছেড়ে আসা মানুষ ভাবে, টরন্টোতে কোনোভাবে গিয়ে পৌঁছাতে পারলেই যেকোনো ধরনের কাজ জুটে যাবে। অথচ বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা এখানে কাজে লাগে না। দেশ থেকে ডাক্তারি পাস করে আসা কেউ ট্যাক্সি চালাচ্ছেন, কেউ গ্রোসারি শপে মাংস কাটছেন, আবার কেউ কেউ নার্সিংয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় ডিপ্লোমা।
দেশের সহায়-সম্বল বিক্রি করে বাংলাদেশের যেসব মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ক্রমাগত ছুটছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, তাদের অনেকেরই মোহভঙ্গ হয় বিদেশের বৈরী পরিবেশে পা ফেলার পর, শুরু হয় মানবেতর জীবনযাপন। আবার অসৎ আদম ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে দেশে ফিরে আসা সর্বস্বান্ত মানুষের কান্নায় প্রায়ই ভারী হতে দেখা যায় ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অথচ তবু বহু মানুষ দেশান্তরি হওয়ার জন্য জীবন বাজি রাখতেও প্রস্তুত। বিমানের চাকার খোলে বসে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চেয়ে ঊর্ধ্বাকাশে আত্মাহুতি দেওয়ার মতো ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও কখনো ঘটেছিল কি না আমাদের জানা নেই। হতভাগ্য সেই যুবকের ব্যর্থ চেষ্টাই যেন আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের বিদেশে ভাগ্যান্বেষণের প্রাণের আকুতি।
কানাডায় পাড়ি দেওয়া মানুষের মধ্যে সচ্ছল এবং সফল একটা অংশ কানাডায় জীবনযাপন ও অবস্থানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ইতিবাচক ও পরিতৃপ্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা চাকরিতে খুব ভালো অবস্থানে থাকা অনেকেই আছেন, যাঁরা অভিজাত এলাকায় বাড়ি কিনে, সন্তানদের জন্য বেবি সিটারের ব্যবস্থা করে পরিপূর্ণ স্থিতিশীল জীবনযাপন করছেন। বলা বাহুল্য, দীর্ঘদিন আগে কানাডায় পাড়ি দেওয়া এই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে এই স্থিতিশীল অবস্থা যেকোনো সময় নড়ে যেতে পারে আচমকা কর্মচ্যুত হলে। দ্বিতীয় দলের অধিকাংশই, যাঁরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডা এসেছেন, তাঁরা শিগগিরই উপলব্ধি করতে পারেন যে কানাডার জীবন তাঁদের জন্য নয়, অথচ দেশ ছেড়ে চলে আসার পর সেই মোহমুক্তির প্রমাণ দিতেও কুণ্ঠিত তাঁরা। আইবিএ থেকে এমবিএ করা একটি বেসরকারি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদার একজন ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কানাডা, কিন্তু বছর না ঘুরতেই তিনি আত্মহত্যা করেন কোনো অজ্ঞাত কারণে। পরিচিতদের ধারণা, মোহভঙ্গ ও হতাশাই ছিল এই অকাল স্বেচ্ছামৃত্যুর মূল কারণ। গত কয়েক বছরের মধ্যে এ রকম আত্মাহুতি দেওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা কমপক্ষে তিনজন, এঁদের সবাই উচ্চশিক্ষিত।
আবার ছেলেমেয়ের পড়াশোনা এবং দেশের নানান অব্যবস্থা, রাজনৈতিক হানাহানি, নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা ও অনিয়মের কারণে দেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধার জন্যই অনেকে উভয়সংকটে পড়েন। ফলে এই শ্রেণীর অভিবাসীরা ঝুলে থাকেন এক ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। এই দলের সবারই অভিজ্ঞতা অনুযায়ী যে ধরনের সুযোগ-সুবিধার হাতছানি দিয়ে কানাডায় অভিবাসী হতে ইচ্ছুক বিদেশিদের আসতে দেওয়া হয়, বাস্তবে তেমনটি পাওয়া যায় না, ফলে শিগগিরই মোহমুক্তি ঘটে সবার। বাংলাদেশি অধ্যুষিত ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকার বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বসবাসকারী একজন অভিবাসীর ফ্ল্যাটে মাত্র দেড় ঘণ্টার অনুপস্থিতিতে দরজা ভেঙে চুরি হয়ে গেলেও পুলিশ কোনো সুরাহা করতে পারেনি বটে, তবে তদন্ত শেষে এই দুঃসাহসিক চুরির শিকার পরিবারটিকে চিঠি পাঠিয়ে ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র সুরক্ষার ব্যাপারে নসিহত করা হয়েছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। কিন্তু তবু দেশে ফিরে যাওয়ার মতো প্রত্যাবর্তনের লজ্জায় পড়তে চান না বলে অনেকেই অনিচ্ছায় কাটিয়ে যাচ্ছেন যন্ত্রণাময় দিন। সমীক্ষায় দেখা যায়, কানাডায় অভিবাসী হতে আসা ৫ শতাংশ ফিরে যায়, নাগরিকত্ব লাভের প্রক্রিয়ায় আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে ৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ পেশাগত চাকরি পায়, আর ৮০ শতাংশই নিউ ইমিগ্র্যান্ট ফাঁদে পড়ে (সূত্র: কানাডা যাবেন কেন যাবেন)।
সন্তানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠিত অনেক বাবা-মা দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলেও খোদ সন্তানদের অনিচ্ছার কারণে সেটি সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই অন্তত পক্ষে কন্যাসন্তানদের কিছুটা ধর্মীয় বোধ জাগানোর জন্য অনেক মা-বাবা মেয়েদের মাথায় হিজাব বাঁধার শিক্ষা দিয়েছেন, তাই স্কুলগুলোতে দেখা যায় বহু কিশোরীর মাথায় হিজাব বাঁধা থাকলেও অন্যান্য পোশাক কোনো অর্থেই রক্ষণশীল মুসলমানদের পর্দামাফিক নয়।
অভিবাসী নারীদের একটা বহুল উচ্চারিত অভিযোগ স্বামীদের বিরুদ্ধে যে তাঁরা ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করতে অনাগ্রহী, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অদক্ষ, যা সহজাত এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল। ফলে দেশে থাকতে যাঁরা গৃহপরিচারিকার সহায়তায় অনায়াসে দিন কাটিয়েছেন, তাঁদের এখানে এসে বাচ্চা সামলানো থেকে ঘরের বেশির ভাগ কাজই করতে হয়। অথচ দুলালের ভাষায় কানাডা ‘হিউম্যান রাইটস’-এর দেশ নয়, বরং বলা যায় ‘উওম্যান রাইটস’-এর দেশ। কারণ, এ দেশে নারীদের স্বার্থ সত্যিকার অর্থেই সুরক্ষিত। তবে বাংলাদেশি অভিবাসী নারীরা সেই অধিকার ভোগ করতে বা প্রয়োগ করতে অক্ষম কিংবা যথেষ্ট সাহসী নন। বিদেশের মাটিতে এত বৈরী পরিবেশের মধ্যেও কানাডার ইমিগ্রেশন বিভাগে বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে, যেখানে এক বাংলাদেশি অন্য স্বদেশির বিরুদ্ধে চিঠি লিখে তাঁর অভিবাসন-প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা করেছেন।
তবু অভিবাসী হতে চাওয়া মানুষের একটি জীবন কেটে যাবে স্বদেশ-বিদেশের দোলাচলে, তার পরও এই দুই বিকল্পের কোনটি শ্রেয়তর, সেটি বুঝে ওঠার জন্য হয়তো কেউ কেউ একবার ভাগ্যান্বেষণের চেষ্টা করে দেখবেন টরন্টো, ভ্যাঙ্কুবার, মন্ট্রিয়ল কিংবা অটোয়ায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০০:৫৬ ৫২৬ বার পঠিত