তমালঃবঙ্গ-নিউজ:আজ ২২ অক্টোবর, রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ৬০তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বরিশালে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।এদিকে রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সরকারি আদেশের এক যুগ পরও পুনরুদ্ধার করা হয়নি। নগরীর বগুড়া সড়কের মুন্সীর গ্যারেজ হয়ে শীতলাখোলার দিকে রওয়ানা হলেই চোখে পড়ে ‘ধানসিড়ি’ নামের এ বাড়ি। বাড়ির ভেতর অনেক আগের সেই শাল, শিরিশ, আম, জাম, কেওড়া-ঝাড় গাছগুলোর দেখা এখন আর মেলে না। কবির পূর্ব পুরুষদের স্মৃতিবাহী মঠগুলোর অস্তিত্বও নেই।
জীবনানন্দ দাশের সাধের গোলাপ বাগানও কালের ¯্রােতে শেষ হয়ে গেছে। প্রায় ছয় বিঘা জমির ওপর বাড়িটি তিন ভাগে বিভক্ত। সিটি কর্পোরেশনের পাম্প হাউজ ও জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গুদাম ঘর আটকে রেখেছে কবির বাসভবনটি। বাকি জমিতে বংশানুক্রমে বসবাস করছেন আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তির ছেলে ও নাতিরা। পানির পাম্পের একটি অংশে মাত্র কয়েক বছর আগে জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি পাঠাগার নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি জমি বেদখল রয়ে গেছে।
জীবনানন্দ দাসের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বাড়িটি পুনরুদ্ধার বা সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়া হলেও কবির মৃত্যুর ৫৭ বছর পর তার নামে ২০১০ সালে একটি পাঠাগার নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই পাঠাগার এখন বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের জন্য কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ভাড়া দিচ্ছে জেলা পরিষদ।
অযত্ন আর অবহেলায় থাকা বাড়িতে কবির মৃত্যুর ৫০ বছর পর ২০০৮ সালে জীবনানন্দ দাশের নামফলক উদ্বোধন করা হয়। কবির পৈত্রিক বাড়ির সামনে ওই বছর তার মৃত্যু বার্ষিকীর দিনে নামফলক উদ্বোধন শেষে সে সময়ের বরিশাল সিটি করপোরশনের মেয়র বগুড়া রোড সড়কটি কবির নামে ‘জীবনান্দদ দাশ সড়ক’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
এরপর কবির পৈত্রিক বাড়িতে জেলা পরিষদের মাধ্যমে অডিটোরিয়াম ও পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এলজিইডি মন্ত্রণালয়।
২০১০ সালের ফেব্র”য়ারি মাসে নির্মাণ করা হয়েছে পাঠাগার ও মিলনায়তন। আলমারিভর্তি বই রয়েছে পাঠাগারে। বিকেল হলে জেলা পরিষদের একজন লাইব্রেরিয়ান গিয়ে গাঠাগারের তালা খোলেন। থাকেন সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিন্ত পাঠকের দেখা মেলে না। বরং সেখানে প্রায় প্রতিদিনই বিয়ের ধুম লেগে থাকে।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম নগরীর একটি ভাড়া বাড়িতে। তার পিতা সর্বানান্দ দাশ গুপ্ত বরিশালের কালেক্টেরটের একজন কর্মচারী ছিলেন। তিনি ১৯০৭ সালে বগুড়া রোডে জমি কিনে এ বাড়ি নির্মাণ করেন। তখন বাড়ির নাম দেওয়া হয়েছিল সর্বানান্দ ভবন। তার পূর্ব পুরুষরা থাকতেন তৎকালীন ঢাকার বিক্রমপুরে। কিন্তু বিক্রমপুরের ওই বাড়ি পদ্মায় বিলিন হয়ে যাওয়ায় তা নিয়ে বেশি কিছু জানা যায় না।
বরিশালের এ বাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে কবির ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘বাড়ির ভেতর ঝোপের মধ্যে কোথায় আনারসের গায়ে হলুদ ঝোপ এসেছে, কাঁঠাল কত বড় হয়েছে, কত আম ধরেছে, সবকিছুই থাকত কবির নখদর্পণে। এসব দেখতে তিনি কখনো ভুল করতেন না।’
কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন বিএম কলেজের ইংরেজি শিক্ষক। ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে তিনি ভারতে চলে যান। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তিনি আর এ বাড়িতে ফিরে আসেননি। জন্মভূমি ও প্রিয় বাড়ি হারানোর কথা একাধিকবার কবিতায় প্রকাশ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তার পিসি স্নেহলতা দাশ বাড়িটি ছেড়ে কলকাতা চলে যান। বাড়ি সংরক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়ে আশ্রিতদের ওপরে। পরবর্তী সময়ে আইনজীবী পবিত্র কুমার ঘোষকে পাওয়ার অব এটর্নি প্রদান করা হয়। ১৯৫৫ সালের ৩০ মে ওই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এর আগেই কালেক্টেরটের কর্মচারী আব্দুর রাজ্জাক সেখানে বসবাস করতেন।
কবির পরিবারের সঙ্গে রাজ্জাকের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনিই ১৯৬০ সালের ১৭ জুন বাড়ির বেশ কিছু অংশ ক্রয় করেন। পরে বাড়িটির ৭০ ভাগ জমি সরকার হুকুম দখল করে। তারই অংশ বিশেষ ফিরিয়ে দিয়ে সরকার পাঠাগার নির্মাণ করেছিল। কিন্ত বাড়ির বাকি অংশটুকু রয়েছে বেদখল হয়ে। সরকারি আদেশের এক যুগ পরও বাড়িটি পুনরুদ্ধার করা হয়নি।
জীবনানন্দ দাসের বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য বরিশালের ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জোট সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ ১৯৯৯ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে বাড়িটি সংরক্ষণের আশ্বাস দেন। সে অনুযায়ী সংস্কৃতি সচিব এখানে এসে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সুধী সমাবেশ করেন। তার উপস্থিতিতে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান ও বর্তমান সিটি মেয়র আহসান হাবীব কামাল পানির পাম্পটি সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। বাড়ির বর্তমান বাসিন্দারা সভায় উপস্থিত থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে তারা বাড়ি ছেড়ে দিতে রাজি আছেন বলে জানান। সংস্কৃতি সচিব সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বরিশাল ত্যাগ করেন। সেই আশ্বাস নিয়েই এক যুগেরও বেশি সময় কেটে গেছে।
এদিকে আজ ২২ অক্টোবর বুধবার রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের ৬০তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় কবিতা পরিষদের উদ্যোগে কবিতা পাঠ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় বরিশাল নগরীর জীবনানন্দ সড়কের (বগুড়া সড়ক) কবি জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি মিলনায়তন ও পাঠাগারে স্থাপিত কবির ম্যুরালে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে শুরু হবে কবিতা পাঠ ও আলোচনা সভা।
সন্ধ্যায় জেলা শিল্পকলা একাডেমীর আয়োজনে ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কবি স্মরণে কবিতা পাঠ ও আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যান জীবনানন্দ দাশ। প্রতি বছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে কবিতা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি পালন করলেও গত দুই বছর ধরে কোনো কর্মসূচী সেভাবে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ৮:১৭:৩৮ ৩৪৭ বার পঠিত