সুখকাঁটা-আল রিআন
Home Page » সাহিত্য » সুখকাঁটা-আল রিআনএকাদশ পর্ব শুরু………..আজ অনেক দিন পরে জলমিয়া তার শ্বশুড় বাড়ী হতে নিজের বাড়ী ফিরবেন। জলমিয়ার অস্বাবাভিক কথাবার্তা ও আচার আচরণে তার শ্বশুড় শ্বাশুড়ী অসন্তুষ্ট না হলে, সে আরো কিছু দিন ওখানে থাকত। শ্বশুড় বাড়ীর প্রথম দিনের মত আদর কদর তার জন্য এখন হারাম হয়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম জলমিয়া শ্বশুড় বাড়ীতে কোন কিছু চাইবার আগেই পেয়ে যেত কিন্তু এখন চাইলেও তা পাওয়া যায়না। আলি হোসেনের চার মাসের খোড়াকি জলমিয়া সপ্তা খানেকের মধ্যে শেষ করে দিয়েছে, এটাই হয়তো আলি হোসেনের পরিবারের রাগের কারণ। শত হলেও জামাই বলে কথা, এই প্রথম শ্বশুড় বাড়ী এসেছে কিছু একটা দিয়ে বিদায় দিতে হয়। অবশেষে জলমিয়াকে একটা লাল জামা দিয়ে বিদায় হতে বলে। আজ সন্ধ্যায় শেষ আহার করে ফাতেমাকে নিয়ে নিজের গ্রামে রওহনা দিবে জলমিয়া। ফাতেমা তার স্বামীকে বলে “ওগো তুমি আইজ বাজানের দেওয়া লাল পিরানটা গায়ে দাও, তোমারে নায়কের মতন লাগবো।”
“ঠিক আছে বউ, তুমি যহন কইলা তহন গায় না দিয়া কি আর পারি ?”
জলমিয়া লাল জামাটি গায়ে পরে ট্রাংকটি হাতে নিয়ে নিজ গ্রামে আসার আগে শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি করে বলল
“আব্বা আমি যাই, এখন তো পথ ঘাট সব যাইন্না গেলাম, এরপরে আমি নিজে নিজেও আসতে পারমু। ফাতু লও, আকাশের অবস্তা ভাল না, দেওই নামতে পারে।”
“জামাই হুন, ঘন ঘন শ্বশুড় বাড়ী আইলে মানষে মোন্দ কইবো। দুই তিন বছর বাদে আমি মরলে, চল্লিাশা খাইতে আইও। এহন বাড়ী যাও, ডাওর (বৃষ্টি) নামতে পারে।”
মেয়ে ও জামাইকে এগিয়ে দেবার জন্য বাড়ির সবাই উঠানে নেমে এসেছে। বিদায়ের ক্ষণে কেহ না কাদলেও মেয়ে ফাতেমা ও তার মা কিন্তু কেদেছে। ফাতেমার মা ফাতেমাকে সময় সুযোগ করতে পারলে আবার জামাইকে নিয়ে বেড়াতে আসতে বলেছে। এরপর জলমিয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে মাটির পথ ধরে হাটতে আরাম্ভ করল। আজ সকাল থেকেই কয়েক বার বৃষ্টি হয়েছে। চারিদিকের ছোট খাটো ডোবা নালাগুলো পানিতে ভরে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যাঙ ডাকছে। কাদা রাস্তার মধ্যে কিছু দূর হাটতে হাটতে জলমিয়া তার স্ত্রীকে বলে “বউ ঐ দ্যাহো, রাস্তার মদ্যে কি যেন জ্বলতেছে।”
“কি জ্বলে হাত দিয়া ধইরা দ্যাখো।”
“আরে না হাত দিয়া ধরোন যাইবো না। আমি বুঝবার পারছি ঐটা কি ?”
“কি বুঝবার পাছো, কওনা একটু।”
“এইটা হইলো সোনা ব্যাঙের সোনা। ছোট কালে দাদা দাদির কাছে সোনা ব্যাঙের কিছছা হুনছি। এইডা অইলো গিয়া ঐ সোন ব্যাঙের সোনা। দ্যহনা ঐ যে একটা ব্যাঙ ডাকতাছে। নিশ্চই ব্যাঙডা তার মুখের সোনা রাইখা কিছু খাইতে গেছিল।”
“ওগো এই সোনা দিয়া আমারে একটা গলার চেইন বানাইয়া দিবা। এই সোনার দামতো ম্যালা ট্যাকা হইবো,তাই না গো।”
“আরে চেইন বানাইবা পরে, আগে আমরা এই সোনা বেইচ্চা দালান দিমু। খ্যাড়ের ঘড়ে আর ভালা লাগেনা।”
“এই সোনা বেইচ্চা কতগুন ট্যাকা পাইবা।”
“বেচমু পরে আগে সোনা তো লই। বউ হুনো এই সোনার কতা তুমি কেউরে কইবানা। মানষে জানলে ট্যাকা টোকা হাওলাত চাইবো।”
“ঠিক আছে আমি কেউরে কমুনা। এই সোনা নিবা কেমনে ? ব্যাঙে যদি কামোড় টামোড় দ্যায়।”
“বুদ্ধি একটা আছে।”
“কি বুদ্ধি ?”
“আমার গায়ের পিরনডা খুইলা এই সোনার উফরে ফালাইয়া দূরে গিয়া খাড়াইয়া থাকমু। ব্যাঙ সোনা না পাইয়া মইরা গেলে আমরা সোনা তুইলা নিমু। কিচ্ছা খতম।”
“তুমি নয়া পিরানডা রোডের মাঝে ফালাইয়া যাইবা, মানষে পাইয়া যদি লইয়া যায়। এ্যত্ত দামি পিরান, আর তুমি কিনতে পারবা।”
“আরে বউ সোনা পাইলে কত পিরান কিনতে পারমু।”
“তুমি পিরান বাদে আর কিছু দ্যও।”
“পিরান বাদে আছে আমার লুঙ্গি। তুমি কি আমারে লুঙ্গি খুইলা দিতে কও ! তোমার মতলব ডা কি কও দেহি।”
জলমিয়া সোনা ব্যাঙের মূল্যবান সোনা পাবার জন্য নিজের গায়ের জামাটি খুলে জ্বল জ্বল করা সোনার উপরে চেপে দিয়ে ফাতেমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কিছু দূরে। ফাতেমা তার বাবার দেওয়া জামাটি নিয়ে বেশ চিন্তিত, এত দামি জামা কেহ যদি নিয়ে যায়। জলমিয়া মনে মনে অনেক উত্তেজিত হয়ে আছে। এর মধ্যেই ফাতেমা জলমিয়াকে বলে “ওগো তোমার পিরানে দেহি আগুন জলতাছে। লও দেহি।”
দু জনে দৌড় দিয়ে জামার কাছে গিয়ে দেখল, জামাটি আগুনে পুড়ে শেষ। এই দৃশ্য দেখে জলমিয়া অধিক শোকে বাক শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফাতেমা ফু দিয়ে আগুন নিভাইবার যতই চেষ্টা করিতেছে নির্লজ্জ আগুন ততই বাড়িয়া যাইতেছে। ফাতেমার চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কোন মানুষের প্রাণ বাহির হয়ে যাচ্ছে। ফাতেমা পা দ্বারা আগুন চাপিয়া ধরিলে আগুন তারাতারি নিভবে যদিও কিন্তু স্বামীর জামা পা দিয়ে চেপে ধরলে যে পাপ হবে তা আর কোন দিনই নিভবেনা। এইজন্য ফাতেমা জ্বলন্ত জামাটিতে হাত দিয়ে চেপে ধরে নিভালো, এতে ফাতেমার হাত পুরে অনেক ক্ষত হয়েছে বটে। জামাটি হাতে তুলে ফাতেমা জিব্বায় কামড় দিয়ে বলে “কি কামডা করলেন আফনে, নয়া পিরান ডারে শ্যাষ কইরা দিলেন। একটা দিন ভালা কইরা গায় দিলেও মোনে কোন দুঃখ থাকতোনা। বাজানে নগদ একশো ট্যাকাইদা নাল পিরানডা কিনছিল। আহারে আমার পোড়া কফাল।”
দীর্ঘ একটা কষ্টের নিস্বাঃস ছেড়ে জলমিয়া ফাতেমার হাত থেকে জামাটি নিয়ে বলল “এরেই কয় লোভে পাপ পাপে শ্যাষ।”
ফাতেমা স্বামীকে বলে “আমি কইলাম না এয়া সোনা ব্যাঙের সোনা না। কেউ মোনে অয় বিড়ি খাইয়া বিড়ির পাছা ফালাইয়া গ্যাছে। আন্দার রাইতে তুমি বিড়ির আগুন দেইখা সোনা মোনে করছ।”
“তুমি কহন কইলা এইডা বিড়ির আগুন।”
“কইছি কইছি, তোমার মোনে নাই।”
“হ, তুমি এহন মিছা কতা কইতাছো। থাউক বাদ দেও, আমার কতা কইতে মোন চাইতেছে না এহন। মোনে মোনে আশা করছিলাম, নাল পিরানডা গায় দিয়া মকবুল নানারে ঘুইরা ঘুইরা দেহামু। হেয়া আর অইলোনা।”
জলমিয়া খালি গায়েই তার বউর সাথে কথা বলিতে বলিতে অন্ধকার রাস্তায় হেটে হেটে তার বাড়ীর দিকে ফিরলো।
পরের দিন সকালের কথা
জলমিয়া পড়নের লুঙ্গিটাকে কোমড়ের সঙ্গে গুজে হাঁটু পর্যন্ত তুলে নিয়ে বিশ্ব রোড দিয়ে হেটে যাচ্ছে, এমন সময় তাকে এক ভদ্রলোক পিছন থেকে ডেকে বলে “এই যে ভদ্র লোক, একটু শুনবেন।”
জলমিয়া পিছন দিকে ফিরে বলল “যে আমার কিছু কইতাছেন।”
“হ্যা ভাই, একটু কাছে আসবেন।”
জলমিয়া তাহার কাছে যাওয়া মাত্র ভদ্রলোকটি জলমিয়াকে সালাম দিয়ে বলল “ভাই আপনি কি এই গ্রামের কোন স্থায়ী বাসিন্দা।?”
“ক্যান? কন তো।”
“না মানে, আমার এই গ্রামের কোন একজন স্থানীয় মানুষ দরকার।”
“হ, আমি এই গেরামের ই পোলা। তয় আফনে কেডা। এই রকম কোর্তা কার্তি পড়া লোক তো আমাগো গেরামে কোন দিন দেহিনাই।
“হ্যা। ভাই আমি শুভ আহমেদ। একজন ইঞ্জিনিয়ার-এই বলে শুভ জলমিয়র দিকে হাত বারিয়ে দিল মুসাফা করার জন্য।
“জলমিয় হাত না বাড়িয়ে দিয়ে উল্ট বলল “বাই আফনে কি পাগোল ?”
“কেন ? আমি পাগল হব কেন ?”
“না মানে। আমারে সালাম তো দূরে কতা, আমি না খাইয়া থাকলেও কেউ জিগায় না। আর আফনে আমার লগে মুসাফা করতে চান। এই জন্নি। বাই, আমি আফনার কতা কিছুই বুঝি নাই। আফনে কেডা,কি চান ? একটু খারান আমি এক জনারে বোলাই আমাগো মানিক বাই, হে সব বুঝব।”
জলমিয়া রাস্তায় মানিককে দেখতে পেয়ে তার নাম ধরে ডেকে বলে “মানিক বাই ও মানিক বাই,এদিক হুইনা যাও। ঢাকার শহর থেইকা এক অতিথ আইছে।”
মানিক লাঙ্গল কাঁদে নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিল। তখন জলমিয়ার ডাক শুনে তার কাছে এগিয়ে গেলে জলমিয়া বলে “মানিক বাই এই ব্যাডা কি জানি কয়। আমি হেয়া বুঝি না। তুমি হুনো।”
“ওনি কেডা জলমিয়া ?”
“জ্বি ভাই আমি শুভ আহমেদ। এক জন ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি অফিসার। আপনাদের গ্রামে ধান সিঁড়ী নদীতে একটা ব্রিজ করতে এসেছি। তা এই গ্রামে মেম্বর চেয়ারম্যানের বাড়ী কোথায় আমাকে একটু বলবেন কী ?”
“ক্যান হেরা ও কি আফনার লগে ব্রিজ বানাইবো ?”
“না। আমি থাকার জন্য তাদের বাড়ী খুঁজছি। এ গ্রামে তো থাকার জন্য কোন কামরা হোটেলের ব্যবস্থা নাই। এই জন্য তাদের খোঁজা।”
জলমিয়া হাসিয়া বলল “এই গেরামে আবার মেম্বার চেয়ারম্যান। জন্মের পর দ্যাখলাম একজন মেম্বার। মেম্বার আইলেই তো গম চুরি কইরা নিজেগো খোরাকী জোগাইব। হের লাইগা এই গেরামে মেম্বারিতে খারাইলে ও কেউ ভোট দ্যায়না।”
মানিক বলল “তুমি থাম। ছার ও একটা পাগোল মানু ওর কতা বাদ দেন। এই গেরামে মেম্বার চেয়ারম্যান কিচ্ছু নাই। যারা আমাগো ভোটে মেম্বার চেয়ারমেন অইছে, তারা এই গেরামে থাহেনা। গঞ্জের শহরে থাহে। ভোটের সোমায় অইলে ভোট চাইতে আইবো।”
আমাদের পাগলামি এমন মাত্রায় বাড়িয়া গিয়াছে যে কেহ সুস্থ স্বাবাভিক আচরণ করলে তাকেই আমাদের সবচেয়ে বড় পাগল মনে হয়। যার কারণে জলমিয়ার হালাল কথাগুলো শুনিয়া মানিক তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলেন। তা যাই হোক না কেন ?
শুভ মানিক কে বলল “ভাই আমাকে একটা রুম ভাড়া করে দিতে পারবেন। টাকা পয়সা নিয়ে ভাববেন না।”
জলমিয়া বলে “ছার, কত ট্যাকা দিবেন ?”
“আপনি কত চান ?”
“আমি চাইনা, ট্যাকা পয়সাতো আমারো আছে। আমি ট্যাকা চামু ক্যান।”
মানিক বলল “জলমিয়া তুই থামতো, শহরের এই অতিথরে কোতায় থাকতে দি ? বড় চিন্তায় পরলাম। গেরামে কোন ভাল ঘর নাই, তারচেয়েও বড় সমেস্যা আমাগো গেরামে একটাও পাকা পায়খানা নাই। বড় লোক মানু আমাগো গেরামে আইছে ! তার কোন সমেস্য অইলে তো আমাগো গেরামের ই বদনাম অইবো।”
“মানিক বাই, আমার মাতায় একটা বুদ্ধি আইছে। কদম কাক্কুর বাড়ী না একটা বৈঠক ঘর আছে। বৈদেশী মেহমান ইচ্ছা করলে ঐ খানে থাকতে পারবো।”
“তুই কতাটা মন্দ কওনায়।”
“আমাগো গেরামে কদম আলী নামে এক মাতবর আছে। তিন তিন বার মেম্বারিতে খাড়াই ছিল, তয় একবার ও অইতে পারে নায়। আফনে এখন তাগো বাড়ী থাকবেন।”
“আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। মানিক ভাই আপনার এ উপকারের কথা আমার মনে থাকবে। তা এখন আমাকে একটু ঐ মাতবরের বাড়ীতে নিয়ে চলুন।”
মানিক বলে “জলমিয়া তুমি একটু তার ব্যাগ পত্র নিয়া তারে কদম চাচার বাড়ী অবদি পৌছাইয়া দিয়া আসো। আমি ক্ষ্যাতের কাম সাইরা দ্যাখা দিয়া আসমুনে।”
জলমিয়া শুভ আহম্মেদের ব্যাগ পত্র গুলো একটা মাথায় একটা হাতে নিয়ে বলল “চলেন ছাড়, ধান ক্ষ্যাতের মদ্যি দিয়াই যাইতে হইবো।”
“ঠিক আছে, আমার তাতে কোন সমস্যা নাই। আমি গ্রামকে ভালবাসি।”
“ছার গেরামরে আবার মানষে ভালবাসে ক্যামনে, এইটা কি ঘরের বউ যে ধইরা একটা চুমা দিবেন।”
“আপনি এসব কি বলছেন ? কেন আপনি কি গ্রাম কে ভালবাসেন না? গ্রামের এই মুগ্ধ করা সবুজ পরিবেশকে আপনি ভালবাসেন না।”
“ছার,আমি ও সব বুঝিনা।”
এভাবেই কথা বলতে বলতে জলমিয়া শুভকে নিয়ে কদম আলীর বাড়ী হাজির হলেন। পরীর মা জলমিয়ার সাথে শহরের এক বাবুকে উঠানের মাঝে দাঁড়ানো দেখে, রান্ন্া ঘর থেকে উঠানে এসে বলল
“জলমিয়া কার বাড়ীর অতিথ আবার আমার বাড়ীতে আনছো।”
“নাগো চাচী, ইনি ঢাকার শহর অইতে আইছে। আমাগো গেরামের ধান সিঁড়ি গাঙ্গের উপড় এ্যকটা ব্রিজ বানাইবো। মানিক বাই সব কইতে পারবো হে কদম কাক্কুর দারে গ্যাছে। আমি এহন যাই চাচী ”
আমেনা বেগম তার ঘর থেকে একটা মোড়া এনে শুভকে বসতে দিয়ে বলল “এই টুলে বসেন। বাড়ীতে কোন ব্যাটা পোলাপান নাই। পরীর বাজানে আইলে ঘরে গিয়া বইসেন।”
“ধন্যবাদ খালা।”
“আফনে কি করেন বাবা জি ?”
“আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার।”
“ইঞ্জিয়ার কি করে ? মাস খানেক আগে হুনছি গেরামে ইঞ্জিয়ার আইবো। তাইলে তুমিই সেই ইঞ্জিয়ার। ও আল্লাগো তুমি দেহি আমাগো মত মানু। আমরা তো বুঝছিলাম ইঞ্জিয়ার কোন মেশিন পত্র। যা দিয়া বিরিজ বানাইবো।”
“ইঞ্জিনিয়ারের কাজ হল সৃষ্টি করা। যেমন আমি আপনাদের ধান সিঁড়ির উপড়ে একটা ব্রিজ তৈরী করব। ব্রিজটা কোন ডিজাইনের হবে তা আমি নির্ধারন করব।”
“ও আইচ্ছা। তয় বিরিজ (ব্রিজ) কি আফনের ট্যাকা দিয়া বানাইবেন।”
“না খালা, আমি সরকারি অফিসার। এই ব্রিজ বানানোর সব টাকা সরকার দিবে।”
ইতিমধ্যে মানিক ক্ষেতের কাজ সেরে পরীদের বাড়ীতে এসে পরীর মাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল “চাচি ইনি ঢাকার শহর থাইক্কা আইছে। বিরাট বড় লোক। কয়েকটা দিন আফনাগো বাড়ীতে থাকবো। তয় চিন্তার কিছু নাই হেয় কইছে যে কয়দিন থাকবো তার খরচা দিবো।
“ঠিক আছে তাইলে থাউক।”
মানিক আমেনা বেগমের সাথে কথা বলার সময় সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, তখন আমেনা বেগম বলল “তুমি কি খুঁজতাছো মানিক।”
“না মানে পরী কি বাড়ীত নাই।”
“ক্যান, তুমি জানোনা আইজ মর্জিনার গায় হলুদ। পরী তো ব্যান বেলা অইতে মর্জিনাগো বাড়ীতে।”
মানিক এরপর মর্জিনাদের বাড়ীর দিকে রওহনা হল। তখন আমেনা বেগম মানিককে ডেকে বলে “এই মানিক যাও কই ? তুমি অতিথরে ঘরে তুইল্লা দিয়া যাওনা।”
“হ চাচি দিতাছি।
মানিক শুভ আহমেদকে উঠান থেকে কদম আলীর বৈঠক ঘরে নিয়ে বলে “আহেন, এই হইলো আফনার ঘর। আমরা গরিব মানু অত ভালা জায়গা আমাগো নাই। আফনের কয়টা দিন কষ্ট কইরা থাকতে অইবো।”
“না আমার তেমন কোন কষ্ট হবেনা। তবে আজ থেকে আপনি আমার বন্ধু হয়ে গেলেন মানিক ভাই। আপনি থাকেন কোথায়?”
“আমি এই উডানের কোনার ঘরটায় থাহি।”
“ও তাহলে তো খুব কাছে থাকেন, মাঝে মধ্যে গল্প করা যাবে।”
“ও। তা ঠিক। আমি যাই। আমার আবার ম্যালা কাম আছে।”
“ঠিক আছে মাঝে মধ্যে আসবেন কিন্তু।”
মানিক শুভর সাথে কথা বলে মর্জিনাদের বাড়ী গেল। মর্জিনাদের বাড়ীতে অনেক মানুষের ঢল। এই জন্য মানিক বাড়ীর মধ্যে না গিয়ে উঠান থেকে হাত ইশারা করে নিজের দিকে ডেকে এনে বলল
“পরের গায় হলুদ দিলে চলব। নিজের গায় দিবানা।”
“দিতে তো চাই, কিন্তু কেউ যদি বর সাজতে না চায় তয় আমি কি করমু চাষী।”
“এই তো আর কিছু দিন বাদে জইষ্ঠ্য মাসের পহেলা হপ্তায় আমি তোমারে নিকা করমুই করমু। ইনশোআল্লা।”
“কতা দিলা তো।”
“হ, কতা দিলাম। আমার জীবনে কিছুই পাই নাই। বাপ পাই নাই। জায়গা জমি পাই নাই। হের লাইগা নিজেরে বড় অভাগা মোনে হয়। আমি আল্লার লগে রাগ কইরা কোন দিন কিছু চাই নাই, কয়দিন আগে আমি আল্লার দারে তোমারেই চাইছি। আল্লা আমারে কিছুতেই ফিরাইবনা। হেই ভরসায় কইছি আমি তোমারে সামনের জইষ্ঠ্য মাসে বউ কইরা ঘড়ে তুলমু। তোমারে ছাড়া আল্লার দারে আমার আর কিছু চাওনের নাই।”
“চাষী আমিও তোমারে ভালবাইসা এত্ত স্বপ্ন দ্যাখছি, যা তুমি ছাড়া আর কেউ বুঝবনা। তুমি যা করনের জোলদি করো, বাপমায় আমার লইগা পোলা খুঁজতাছে। তোমারে ছাড়া আর কার লগে আমার নিকা অইলে আমার বিষ খাওন ছাড়া আর কোন পথ থাকবনা। যারে মন দিছি তারে রাইখা পর মানষের লগে সংসার করতে আমি পারমুনা। আমার জীবন মরণ সবই তোমার হাতে, তুমি যা খুশী করবার পারো। তুমি জানোনা চাষী, মর্জিনারে দেইখা আমার না খুব বউ সাজদে ইচ্ছা করতাছে।”
“পরী, তোমারে মর্জিনা ডাকতাছে।”
“তুমি বিয়ান ব্যালা বাঁশ বাগানে আইও চাষী। তোমার লগে ম্যালা কতা আছে।”
“আইচ্ছা আমুনে। আমি যাই।”
মানিক তার জীবনে পরীর মত একজন মমতাময়ী নারীর সহানুভুতি পেতে চায়। মানিকের জীবনে বড় কোন চাওয়া পাওয়া নেই। সে পরীকে নিকাহ করে সুন্দর একটা সংসার করবে এমন স্বপ্নই দেখে।
মানিকের মত প্রত্যেকের চিন্তা এক রকম নয়। কিছু কিছু মানুষের অনেক বড় হবার স্বপ্ন রয়েছে। তার মধ্যে ইব্রাহিম একজন। ইব্রাহিমের এই দূর্বলতা টা কাজে লাগিয়ে চান্দু হুজুর তাকে কুপরামর্শ দিয়ে দিন কে দিন সরল হতে গরলে পরিনত করছে। চান্দু হুজুর ইদানিং ঘন ঘন কইতুরীদের বাড়ীতে নানা অযুহাতে আসা যাওয়া করছে, সেটা কখনও ইব্রাহিমকে খুঁজতে আবার কখনও সমস্যা সমাধানের বুদ্ধি দেবার জন্য। সকল কিছুর মূল উদ্দেশ্য হল কইতুরীর সাথে দু চারটা কথা বলার জন্য। কইতুরীর দুই দু বার নিকাহ হবার পরও কইতুরীকে কাছে পাবার স্বাদ্ চান্দুর মনে রহিয়াছে। চান্দু হুজুর উঠতে বসতে ইব্রাহিমের কানে বিষ ঢেলে বলে “দ্যাখ এবরা তোরে কইতুরীর বাজানে ঠকাইছে। নিকার পর হে তোরে কিছু দিছে। দলু ইচ্ছা করলে তোর নামে সব জমা জমি লেইখা দিতে পারেনা। এমনিতেই তোর আগের পাওনা ট্যাকা শোধ দেয়নায়।”
“থাউক না চান্দু বাই। হে বুড়া মানু আইজ বাদে কাইল মইরা গ্যালে সবতো আমিই পামু।”
“ও আমি এহন পর হইয়া গ্যালাম। আমে দুতে মিলাইয়া দিলাম আটি এহন বাটির পাশে গড়া গড়ি খাইতাছে। আমি চান্দু না থাকলে এই নিকা কোন দিন হইতো না। পক্কির ছাওর মত একটা সুন্দার বউ পাইয়া আমারে ভুইলা গেলি। আমি কেউরে আন্দ-মোন্দ বুদ্ধি দি না। ও সব ভন্ডো অভ্যাস মোর মধ্যে নাই।”
“দ্যাহো চান্দু বাই আমি কি তোমারে কইছি তুমি আমারে মোন্দ বুদ্ধি দেও। ক্ষ্যাতে কাম করতাছি, রৌদে এমনিতেই মাতা গরম অইতেছে। মানিক বাইর কাম, ফাঁক মারলে রোজ দিবোনা। তুমি এহন যাও আমি বিয়ান ব্যালা দ্যাহা করমুনে।”
“হুন এবরা যাবার আগে একখান কতা কইয়া যাই। সারাডা জীবন এই রকমের মানষের বাড়ী কাম করোন লাগবো। দুখ, আমাগো মতন ব্যাটা ছাওয়াল হইতে পারলিনা মাই¹া রইয়া গেলি। বাড়িত গিয়া মাইয়া মানষের চুড়ি পইরা বইয়া থাক।”
ইব্রাহিম চান্দুর কথায় কিছুই মনে করেনি। সে জানে চান্দুর কথা মত তার শ্বশুরের সাথে ঝগড়া করা একেবারেই বৃথা। কড়া সুদে টাকা এনে কন্যার নিকাহ্ দিল এবং বাকী টাকা দিয়ে ধানের চারা কিনেছে। তার কাছে আর জমানো অর্থ কোথায় ? তার মধ্যে দুই দুই বার কন্যার নিকাহ্ দিয়ে ধার দেনায় ডুবে আছে। ইব্রাহিম কয়েক মাস যাবৎ শ্বশুর বাড়ীতেই ঘর জামাই হিসাবে থাকে। একই আয়ে চলছে পুরো পরিবার। দলু বহু কষ্টে প্রতিদিন ভাল মন্দ খাবারের ব্যবস্থা করে চলেছে। সে প্রতিদিন ভাবে জামাই মেয়েকে নিয়ে আজ বাদে কাল নিজের বাড়ী যাবে। এমন ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল কয়েক মাস। কিন্তু দলুর মেয়ে জামাই ইব্রাহিম শ্বশুড় বাড়ীতে কম পরিশ্রমে দু বেলা খেতে পারে বলে নিজের বাড়ীতে যায় না। আজ লজ্জা ভুলে মেয়ে জামাইকে দলু বলে “দ্যাহো জামাই আমি আর পারতেছিনা, তুমি এহন কইতুরীরে তুইল্লা ন্যাও। আমি বুড়া মানু, নূনে ফ্যানে আমার দিন ঠিকই কাইটা যাইবো।”
“আমিও তো নিতে চাই। কইতুরীরে আমার হাতে তুইলা দেন। আমি আইজ যামু নিজের বাড়ী।”
“কি রহম তুইল্লা দিমু। তুমিতো সবই জানো, আমার নূন আনতে পানতা ফুড়ায়।”
“দ্যাখেন আব্বা, আমার অতো কিছু জানার দরকার নাই। আমারে নগদ কিছু ক্যাশ দেন।”
“আমি সুদের ট্যাকা দিয়া তোমাগো নিকার খরচা দিছি। আমার দারে ক্যাশ থাকলে কি আমি তোমারে দিতাম না। তুমি তো আমার মাইয়া জামাই।”
জামাই শ্বশুড়ের মধ্যে কথা কাটা-কাটি হতে হতে এক সময় ধরাধরির পর্যায়ে চলে গেল। কইতুরী কাকে কি বলবে একদিকে স্বামী অন্য দিকে জন্মদাতা পিতা। অবশেষে বাবার পক্ষ নিয়ে স্বামীকে বলল “তুমি ক্যামন মানু। কোন মানু কি হউরের গায় হাত দ্যায়। সব খোঁজ খবর নিয়াই তো আমারে নিকা করছ। ওহন ক্যান তুমি যৌতুক চাও। তুমি জানোনা আমাগো অবস্থা। জীবনে হুনছো বিয়ার রাইতে কোন মাইয়া না খাইয়া ঘুমাইতে। এই কইতুরী তার বাজানরে লইয়া না খাইয়া ঘুমাইছে। তুমি এমন এক ফকিন্নির ঘড়ে আত্বিয়তা করছো যার বাপে তোমারে কিছুই দিতে পারবোনা। মোনে চাইলে আমারে নিয়া সংসার করতে পারো না হইলে তালাকও দিবার পারো।
দলু কাদিতে কাদিতে তার মেয়ের মুখ চাপিয়া ধরে বলল “চুপ যা, মা তুই চুপ যা। ভাতারের লগে বউ এমন কতা কয়না।”
ইব্রাহিম রাগ করিয়া বাড়ীর উঠান হতে চলিয়া গেল আর বাপ বেটি মিলে গলা জড়াইয়া কাদিতেছে ।
চান্দু হুজুর একটি চায়ের দোকারে বসে চা খাইতেছে এমন সময় ইব্রাহিম রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময়, চান্দু তাকে ডেকে বলল
“কিরে এবরা গোস্সা কইরা কই যাও? এদিক আয় এক কাপ চা গিল্লা যা। গরম গরম চা গিললে গোস্সা কইমা যাইব রে।”
ইব্রাহিম চান্দুর কথামত চায়ের দোকানে বসে বলল “না আমি চা গিলমুনা। মনডা ভালা নাই।”
“ক্যান কি অইছে ?”
“কইতুরীর বাজানে আমারে তার বাড়ী থাইক্কা নাইম্মা যাইতে কয়।”
এই সুযোগে চান্দু মিথ্যা বাক্য মিশ্রিত করে বলল “ও আমি যা হুনছি তাইলে ঘটনা হাছা। প্রেত্থম পেত্থথম আমি বিশ্বাস যাই নাই।”
“কি হুনছ এবরা বাই?”
“কেমনে যে কই, তুই আমার বন্ধু মানু। দলু হাওলাদার আবার নাকি নিকা করতে চায়। এই জন্নি তোগোরে নাইম্মা যাইতে কইছে। আরে কি কমুরে বাই তোর হউরের (শ্বশুরের) ম্যালা ট্যাকা ক্যাশ হইছে।”
“তুমি হাছা কইতাছো তো চান্দু বাই।”
“একশোবার। আমি কমু মিছা কতা! তয় দোস্ত যহন তোরে ডাকছি আমি তোরে একটা ভালা বুদ্ধি দিতে পারি।”
” কি বুদ্ধি, ক।”
“ওই বুড়া হালারে এক্কেবারে শ্যাষ কইরা দে। কিচ্ছা খতম। আম ছালা সবি তোর”
“শ্যাষ করমু মানে, খতম কইরা দিমু।”
“হ। বুড়া দামড়া হালায় বহুত ঝামেলা করবো। দলু দামড়া শ্যাষ মানে তুই হের সব সম্পত্তির মালিক। তোর কোন অংশিদার থাকবোনা।”
“কি কও আমি কইতুরীর বাজানরে খুন করমু ? না,না, আমি এ কাম করতে পারমুনা।”
“দূর পাগোল, তুই ক্যান মার্ডার করবি। তুই ভালা বংশের পোলা না, মার্ডার করবো তো ডাকাইতে।”
“ডাকাইতে খুন করবো ক্যান। ডাকাইতের কি ঠ্যাক।”
“আরে পাগোল ডাকাইতরে ট্যাকা দিবি। ডাকাইত তোর বাড়ীতে গিয়া দামড়া দলুরে মার্ডার কইরা আইবো। বুদ্ধিডা কেমন ক !”
“আমি এসব পারমুনা। আমার দারে এহন একটা কানা কড়িও নাই।
“তুই ট্যাকা পয়সা নিয়া চিন্তা করোস ক্যান। তোর দারে ট্যাকা না আছে আমার দারে আছে। তুই খালি অনুমতি দে। আমি সব ব্যবস্থা লইতাছি।”
“হ কর। তয় দোস্ত আমার কিন্তু ঢড় লাগতাছে।”
“আরে ঢড়ের কিছু নাই। আইজ রাইতেই কাম অইয়া যাইবো। তুই বাড়ীতে গিয়া খালি দলুর হাত পাও ধইরা একটু কান্দা কাডি করার ভান করবি।”
চান্দুর কুপরার্মশে ইব্রাহিমের মধ্যে সম্পত্তির লোভ জাগ্রত হয়ে উঠিয়াছে। সে চান্দুর শিখানো কথা মত তার শ্বশুড়ের পা জড়িয়ে ধরে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে দুপুরের ঘটানার জন্য ক্ষমা চেয়ে কাদতে আরম্ভ করল। ইব্রাহিমের কান্নার শব্দে আশে পাশের লোকজন না এসে আর পারিলোনা। ইব্রাহিমের কান্না দেখে কেহ বুঝবেনা সে আসলে মিথ্যা মিথ্যা কাদছে। তার কান্নার শব্দে দলুর বাড়ীতে আশে পাশের অনেক লোক ইব্রাহিমের ক্ষমা চাইবার দৃশ্য দেখতে এসেছে। তখন দলু তার মেয়ে জামাইকে বলছে “জামাই পাও ছাড়ো।”
“না আব্বা আমারে মাপ না করলে আমি আফনার পাও ছাড়মুনা।”
“আমি তোমারে মাফ কইরা দিছি। এবার আমার পাও ছাড়ো।”
ইব্রাহিম কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়ে প্রতিবেশীদের দেখিয়ে দিল তার মধ্যে শ্বশুড়ের বিরুদ্ধে কোন রাগ বাদ কিছু নাই।
রাত হতেই ইব্রাহিমের চেহারা ছবি পরিবর্তন হয়ে এসেছে। আজ রাতেই দলুর জীবন পাখি খাঁচা ভেঙে উড়াল দিবে এক অজানা বনে। ইব্রাহিম-কইতুরী দু জনে সামনের বারান্দায় ছোট একটা চৌকিতে আর দলু ঘরের ভেতরে মাটির মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমায়। মধ্য রাত্র, সবাই গভীর ঘুমে ব্যস্ত কিন্তু ইব্রাহিমের চোখে ঘুম নাই। সে বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করতে করতে বাড়ীতে ডাকাত ঢুকে গেল। ইব্রাহিমই প্রথম ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করে তার স্ত্রীকে নিয়ে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিল। ডাকাতের কথা শুনে প্রতিবেশীরা ভাবল ব্যাপার কি ? ডাকাত ডাকাতি করবে দলুর ঘরে। কি এমন ধন সম্পত্তি আছে দলুর ঘরে। ডাকাত যদি একজন দিন ভিক্ষারীর ঘরেও ডাকাতি করত তবে এর চেয়ে বেশি কিছু পাইত। কতগুলো কালো কাপড় পড়া ডাকাত হাতে বড় বড় ধাড়াঁলো অস্ত্র নিয়ে সরাসরি দলুর ঘরে ঢুকে দলুকে প্রথমে রামদা দিয়ে কুপিয়ে বেশ আহত করে, পরে চিৎকার চেচামেচি বেশি হবার কারণে রামদা দিয়ে এক কোপে দলুর দেহ থেকে মাথাটিকে আলাদা করে খুব দ্রুত জঙ্গল পথে পালিয়ে গেল। পালিয়ে যাবার সময় জঙ্গলের মধ্য হতে ডাকাত বাহিনীকে ইব্রাহিম আর কইতুরী দেখিতে পাইল। রাত পোহাতে আর বেশি বাকী নাই। শেষ রাত্রি চলিতেছে এখন। কিন্তু শেষ রাতের আরামের ঘুমটুকো সবারই হারাম হয়ে গেল। আসে পাশের মানুষ জন বেজায় চিন্তিত। বহু দিন পরে আবার এই গ্রামে ডাকাত আসতে আরম্ভ করেছে। এ গ্রামের উন্নতি তো আর হবেই না বরং মানুষের প্রাণও হুমকির মুখে। এই রকমের নানা চিন্তায় বাকী মধুর রাতটুাকো পার করলেন গ্রামবাসীরা। ভোরের আলো ফুটিয়া উঠা মাত্র সবাই দৌড়ে গেল দলুর ঘরের সামনে। ইব্রাহিম-কইতুরীকে না পেয়ে ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখল দলুর রক্ত মাখা দেহটি পরে আছে মাটির মেঝের উপড়। আর দেহ হতে আলাদা মুন্ডটি ছিটকে পরে আছে ঘরের দরজার সামনে। লাল রক্তে ভিজে গেল ভিটার মাটি। নানা রকম গুঞ্জনের মধ্যে দিয়ে সবাই দলুর মেয়ে ও জামাইকে না পেয়ে নিজেরাই ধরাধরি করে লাশটিকে উঠানে নামিয়ে রেখেছে। ইতিমধ্যে ইব্রাহিম ও কইতুরী জঙ্গলের ভিতর থেকে বের হয়ে ঘটনা স্থলে উপস্থিত হয়েছে। কইতুরী তার পিতার দি-খন্ডিত লাশটি দেখে চিৎকার করে কেদে উঠল। কইতুরীর কান্নার আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়াছে। গ্রামের মানুষ দলুর লাশটি উঠানের চারিদিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কইতুরীর কান্না দেখছে। বিভিন্ন পাড়া হতে মানুষ এসেছে কইতুরীর বাবাকে শেষবারের মত একনজর দেখতে। সকালের আলো যখন একটু গাঢ় হয়ে উঠল তখন অনেক মানুষের সামনে কদম আলী বলল “এবরা,লাশ কি করবা ? ডাকাইতের হাতে খুন অইছে কার নামে মামলা মোর্কদমা করবা- তার চাইতে দাফন কাফন দিয়া ফালাও।”
ইব্রাহিম কদম আলীর কথায় একমত প্রকাশ করে বলে “আফনে ঠিকই কইছেন কাক্কু। মরা মানু নিয়া টানা টানি না করনই ভালা। লন আমরা সবাই মিল্লা দাফন কাফনের একটা ব্যবস্থা করি।”
মানিক ইব্রাহিমের কথায় প্রতিবাদ করে বলে “না। এই লাশ এমনিতেই দাফন করা যাইবেনা। মাদবর কাক্কু আফনেই কন কইতুরীর মতন একটা ভালা মাইয়া এতিন হওনের বিচার কি এই গেরামে অইবো না। দলুরে খুন অওনের পিছনে কোন না কোন রহস্য আছে। সহজ কতায় আমরা তো বুঝি দলুরে খুন কইরা ডাকাইতে কি পাইছে। দলুর না আছে জায়গা জমি না আছে ট্যাকা পয়সা। আর দেখছেন কিভাবে কোপাইয়া মারছে দলু কাক্কুরে। যেই হউক দলু কাক্কুরে খুন করাইছে। *
ইব্রাহিমের চেহারা এমনিতেই অনেকটা ভয়ে টেনে ধরেছে, তারপর আবার মানিকের প্রতিবাদী কথা তার বাক শক্তিকে থামিয়ে দিচ্ছে। তারপরও ইব্রাহিম মুখে একটা আলতো হাসি দিয়ে বলল “মানিক বাই যে কি কয়, ডাকাইতে কি এত চিন্তা ভাবনা কইরা খুন করে। যা হওনের হইয়া গ্যাছে। মদ্যিখান দিয়া আমি ফেরেস্তার মত একটা মানু হারাইলাম। কষ্টে আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতেছে। আমারে শাষোণ করার মত আর কেই রইলোনা। আমি আর আমার হউড় আব্বার কষ্ট অইতে দিমু না, অক্ষণ আমি তারে কব্বর দিমু।”
কইতুরী কান্না থামিয়ে বলে “মানিক বাই যা কইছে তাই অইবো। আমার বাজানরে যে কেউ খুন করাইছে। আমি তাগো নামে মামলা করমু। আমি আমার বাজানের খুনের বদলা নিমু মানিক বাই। আমার বাজান রে যারা খুন করছে তাগো আমি ছাড়মুনা।”
ইব্রাহিম একা হয়ে পরেছে। সে তার শ্বশুর বিয়োগের কান্না কাটির মাঝে মনে মনে চান্দু হুজুরকে খুঁজছে। সেই এই বিপদের ক্ষণে হাদিস কোরান দিয়ে সুন্দর করে মানুষকে বুঝিয়ে দলুর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে পারত।
আর এদিকে চান্দু হুজুর ভাবিয়া দেখিল কইতুরীকে পাবার জন্য সে ইব্রাহিমের পিছনে অনেক টাকা খরচ করেছে। এখন যদি ইব্রাহিমকে পুলিশ দিয়ে ধরানো যায় তবেই হবে মহা খেলা। ইব্রাহিমের খুনের দায়ে ফাঁসি হবে। কইতুরী একা। এখন ফাঁকা মাঠে আমি একাই খেলোয়ার, একটার পর একটা গোল দিব। যেভাবে খুশী সেই ভাবে খেলব। যতক্ষণ খুশী ততক্ষণ। কেহ লাল কার্ড দেখানোর নাই। কইতুরীকে নিকাহ্ করি বা নাই করি তাকে কাছে পাবার এমন সুযোগ আর কোন দিন আসবেনা। আর গাঁয়ের মানুষও আমাকে কোন কলঙ্ক দিতে পারবেনা। এতিম একটা মেয়েকে সব সময় দেখা শুনা করে রাখতেছি ইহা কি কম সোয়াবের কাজ। দলু খুন হবার খবর তার কাছে পৌছা মাত্র চান্দুর মনের মধ্যে নতুন একটা স্বপ্ন বাসা বেধেছে, কইতুরীর তিন নাম্বার বর হিসাবে সে ছাড়া আর কেহ নাই। সেই অপেক্ষায় চান্দু হুজুর কখন কইতুরী তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলবে আমি তোমাকে ভালবাসি চান্দু।
কইতুরীর পাশে নওশা সেজে বসার সবুর তার মধ্যে আর সইতেছে না। তাই চান্দু গঞ্জের থানা থেকে দারোগা বাবুকে ডেকে তার সঙ্গে দলুর বাড়ীতে নিয়ে এসেছে। ইব্রাহিম পুলিশ দেখে আল্লা খোদার নাম জপতে আরাম্ভ করল।
চান্দু দারোগাকে বলে “ছার, এই দ্যাহেন আমাগো দলু কাক্কুর লাশ। ফেরেস্তার মত একটা ভালা মানু আছিল। বিপদে আপদে আমরা তার কাছে আইলে সায় সাহায্য পাইতাম। কাইল দুফারে এই এবরার লগে দলুর ঝগড়া কাইঝা অয়। আর দ্যাহেন ছার (স্যার) রাইতেই দলুকে ডাকাইতে খুন করে। আমার মোনে কইতাছে এই কাম এবরাই করাইছে। আমরা আফনার দারে এর ন্যয্য বিচার চাই।”
দারোগা দলু লাশটিকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে বলল “এর আত্বীয় স্বজনেরা কই ?”
“এই হের মাইয়া জামাই আর ওই মাইয়া কইতুরী।”
দারোগা ইব্রাহিমকে কাছে ডেকে বলল “আপনি দলুর জামাতা ?”
“জে।”
“আপনার নাম কি ?”
“এবরা।
“ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন ?”
“আমি ঘড় জামাই। ঘটনার সময় আমি সামনের বারিন্দায় কইতুরীরে নিয়া ঘুমাইতে ছিলাম।”
“ডাকাত যদি আপনার শ্বশুড়কে খুন না করতেই আসবে তবে তো আগে আপনাদের খুন করার কথা। ডাকাতের সামনে থেকে পালিয়ে গেলেন আর দলু পিছনের ঘর থেকেও পালাতে পারলোনা। আমারও মনে হচ্ছে আপনি এ খুনের বিষয় আগে থাকতেই জানতেন।”
চান্দু জোড় গলায় বলে উঠল “হ ছার আফনের অনুমান মিথ্যা না। কাইল দুফারেইতো ঝগড়ার সোমায় দলুরে হে মারতে গ্যাছে আমি ধইরা ফিরাই ছি। ম্যালা বুঝাইছি।”
এরপর দারোগা বাবু ইব্রাহিমকে কোমড়ে রশি বেধে নিয়ে গেল থানা হাজতে। স্বামীকে পুলিশ ধরেছে বলে কইতুরী কোন প্রতিবাদ করেনি। গাঁয়ের মানুষ সবাই মিলে দলুর লাশটি দাফন করে তার আত্বার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করল। কইতুরীর চোখের অশ্র” এখনও শুকায়নি। দলুর অবর্তমানে কে হবে কইতুরীর অভিভাবক। চার কূলে অভাগি কইতুরীর আর কেহই যে রইলোনা। গাঁয়ে কি বাজে মানুষের অভাব আছে। বাবুল তার স্ত্রীকে বলল “বউ মাইয়াটার এহন কি অইবো। কই যাইবো। এমুনি পোড়া কফাল নিয়া জন্মাইছে, হাত দিয়া এহনও নিকার মেন্দির রং যায়নায় এর মদ্যে আবার ভাতাররে জেলে লইয়া গেল। কইতুরীরে কয়দিন আমাগো ঘড়ে রাইখা দ্যাও। এতে তোমাগো কামেও একটু আচান পাইবা।
“ঠিক আছে রাহো তাতে সমেস্যা কি। কইতুরীর দু চার সপ্তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হইল।
দলুর দাফন শেষ হবার পরও পুরো গ্রাম জুড়ে বিরাজ করছে এক ভয়ানক আতংক। একজন জিবন্ত মানুষকে কুপিয়ে হত্যা ! কত না ছটফট করতে করতে দেহের মধ্য থেকে প্রাণটি বের হয়। কিযে যন্ত্রনা, যার প্রাণ বের হয় সেই ভাল জানে।
মরণ যন্ত্রনা মানুষকে আরো একবার পেতে হয়। যখন মনের মানুষ তাকে ছেড়ে অন্য একজনের সাথে চলে যায়। যাবার আগে দেহের মধ্যে থেকে কলিজাটাকে টানিয়া ছিড়িয়া নিয়া যায়। যে নারী পুরুষ এমন স্বার্থপরের মত মনের মানুষকে ঠকাতে পারে তারা আজরাইলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। মানুষ সব যন্ত্রনারই আঘাত এক সময় ভুলে যেতে পারে কিন্তু মনের মানুষকে হারানোর যন্ত্রনা তাকে বয়ে বেড়াতে হয় সারাটি জীবন। এ যন্ত্রনা কোনদিন ভুলে যাবার নয়।
বাংলাদেশ সময়: ০:৩৩:০০ ৯৯৭ বার পঠিত
পাঠকের মন্তব্য
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)সাহিত্য’র আরও খবর
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’
-
সালাম, আমান, রিজভী, খোকন, শিমুল ও এ্যানিসহ গ্রেফতার শতাধিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
ভারতকে হারিয়ে টাইগারদের সিরিজ জয় নিশ্চিত
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ,নিহত ১
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত ওসমানীনগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিক
বুধবার ● ৭ ডিসেম্বর ২০২২ -
বিয়েবর্হিভূত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ: প্রতিবাদে বিক্ষােভ ইন্দোনেশিয়ায়
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২ -
আড়াইহাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ● ৬ ডিসেম্বর ২০২২
আর্কাইভ
Head of Program: Dr. Bongoshia
News Room: +8801996534724, Email: [email protected] , [email protected]