বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ ‘আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন, ধমৃ সৃষ্টি করেন নি। ধর্ম সৃষ্টি করেছেন মানুষ। মানুষের প্রয়োজনে ধর্ম এসেছে, ধর্মের প্রয়োজনে ধর্ম আসেনি। কিন্তু ধর্মের নামে, জাত-পাতের নামে যুগের পর যুগ ধরে মানুষ মানুষকে শোষণ করেছে। ধর্মকে ব্যবহার করেছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের স্বার্থে। আর এখানেই ধর্মের দুর্বলতা।
লালন ধর্মের এই দুর্বলতা টের পেয়েছিলেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন ধর্মতান্ত্রিকদের হাতে। তাই লালন তার জীবন দর্শনে সব ধর্মকে এক জায়গায় এনে মিলিয়েছেন। প্রথাগত ধর্মীয় কুসংস্কারকে ভেঙে মানুষকে আত্মপরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সহজ-সাবলীল জীবন দর্শনের সঙ্গে।
লালন মানুষেরই আত্মপরিচয়, তিনি মানুষের আত্মপরিচয়কে জাগিয়ে তুলেছেন। আজ ধর্মীয় উগ্রবাদিতা, জঙ্গিবাদ এবং সব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লালনের জীবন দর্শনকে জাগিয়ে তুলতে হবে।’
শুক্রবার সন্ধ্যায় লালন স্মরোণোৎসবের দ্বিতীয় দিনের আলোচনা সভায় আলোচকরা এসব কথা বলেন।
আলোচকরা আরও বলেন, ‘লালন ছিলেন মানবতাবাদী। তার কাছে মানুষ পরিচয়ই ছিলেন সবচেয়ে বড়। এই মানব ধর্মের পরিচয়ই তিনি তার জীবন-কর্মে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।’
মুখ্য আলোচক হিসেবে লালনের জীবন-কর্ম, দর্শনের ওপর আলোচনা করেন, রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
আলোচনায় রবিনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘মরমীয়া বাদের তিনটি শাখা সুফি, বৈষ্ণব, বাউল। বাউল বিশেষ কোনো ধর্ম নয়। এটি সব ধমের্র একটি সমন্বিত রূপ। লালনের মানবতাবোধের আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছেন। লালন চিন্তা, দর্শন আরো বিকশিত হয়ে সেই বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক আন্তর্জাতিকতাবোধের প্রসার ঘটুক।’
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি সৈয়দ বেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন, লালন একাডেমির নির্বাচিত সদস্য মাহমুদুর রহমান আল কাদেরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, লালন একাডেমির প্রকৌশলী সেলিম উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. ইফতেখার মাহমুদ।
লালন স্মরণোৎসবের দ্বিতীয় দিনে ভোর ছয়টায় যযথারীতি বাল্যসেবা ও পরে গোষ্ঠগান দিয়ে শেষ হয় উৎসবের প্রথমার্ধ। ভোর ছয়টা থেকে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলে বাল্যসেবা। কলা পাতায় পায়েশ, মুড়ির বাল্যসেবা গ্রহণ করেন বাউল, সাধু, সন্যাসী, অক্ত, অনুরাগীরা। এরপর শুরু হয় গোষ্ঠ গান। অসংখ্য আসরে ধূপ, আগরবাতি জ্বালিয়ে খোল-কর্তাল, মন্দিরা, একতারা-দোতারার সুরে-তালে চলে এ গান।
দুপুরে কালীগঙ্গায় স্নান-গোসল সেরে লালন অনুসারীরা পূর্ণসেবা (দুপুরের খাবার) গ্রহণ করেন। লালন একাডেমি প্রাঙ্গণের একপাশে বড় বড় কড়াই, হাড়িতে রান্না করা হয় মাছ, ঘন্ট, ডাল, ভাত ইত্যাদি। পূর্ণসেবায় দইও ছিল। মূলত এই পূর্ণসেবার মধ্যদিয়ে শেষ হয় লালন উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
এর পরপরই বাউল, সাধকরা যে যার গন্তেব্যে রওয়ানা হন। তবে বেশিরভাগ ভক্ত, অনুসারীরাই রয়ে গেছেন লালন ধাম ছেঁউড়িয়াতে।
লালর স্মরনোৎসব উপলক্ষ্যে লালন আখড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বসেছে মেলা। প্রতি বছরের মতো এবারও লালনের আধ্যাত্মিক দর্শনলাভের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছে।
মুড়ি-মুড়কি, মিষ্টান্নের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। আছে তৈজস পত্র, প্রশাধনী, পোশাক দোকান। আখড়াবাড়ির বিশাল মাঠের এক প্রান্তে বসেছে মেলা। আছে সার্কস প্যান্ডেল, নাগরদোলা।
একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে গত দু’দিন ধরে মুখরিত লালনভূমি ছেঁউড়িয়া। লালন শাহ তার জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমায় আখড়া বাড়িতে ভক্ত-অনুসারীদের নিয়ে সারা রাত গান-বাজনা ও নানা তত্ত্বকথা আলোচনা করতেন। তার দেহত্যাগের পরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
‘ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে’, ‘বদ হাওয়া লেগেছে পাখির গায়’, ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’, ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কূল হারাবি’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘সত্য বল সুপথে চল’, ‘এলাহি আলামিন গো আল্লা বাদশা আলমপনা তুমি’, লালনের এ রকম অসংখ্য গান লালন একাডেমির শিল্পী ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাউলরা পরিবেশন করে চলেছেন।
এছাড়া লালন মাজারের আশপাশে ও কালীগঙ্গা নদীর তীর ধরে বাউলরা আসন পেতে লালনকে স্মরণ করছেন তার পদ-বাণী পরিবেশনের মাধ্যমে।
পূর্ণসেবার পর আখড়াবাড়ী থেকে অনেক ভক্ত, অনুসারী, বাউলরা চেল গেলেও দ্বিতীয় দিনে দুপুরের পর ছেঁউড়িয়ার পথে পথে মানুষের ঢল নামে। সন্ধ্যার আগেই জনারণ্যে পরিণত হয় ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি।
লালন উৎসবের মূল মঞ্চের বিশাল প্যান্ডেলের নিচে যে যার মতো আসন পেতে বসেছেন লালন ভক্তরা। সন্ধ্যায় মঞ্চে আলোচনা সভা শুরুর আগেই বিশাল মাঠ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। আলোচনা সভার পর মূল মঞ্চে শুরু হয় লালনের গান পরিবেশন। ক্লোজা-আপ তারকা রিংকু, বিউটি ছাড়াও লালন একাডেমির শিল্পীরা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাউল, শিল্পীরা লালনের গান পরিবেশন করেন।
স্মরণোৎসবের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুরু হয় আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. গওহন রিজভী। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন, কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম, জেলা পরিষদ প্রশাসক জাহিদ হোসেন জাফর প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩৩:২৪ ৩৭৭ বার পঠিত