সুখ-কাটা–আল রিআন

Home Page » সাহিত্য » সুখ-কাটা–আল রিআন
বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০১৪



suk-katajpg.png

দশম পর্ব শুরু……………..গ্রামের যে কোন গাছের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যাইবে এখন পৌস মাস চলিতেছে। এই মাসে গাছের পাতাগুলো ঝড়ে একেবারে ন্যাড়া হয়ে যায়। দোয়েলের শীঁশ দেওয়া ভোরে সবুজ ঘাসের উপড় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো দেখলে পরান জুড়িয়ে আসে। সকাল বেলা গাঁয়ের ছোটছোট বাচ্চারা ধান গাছের শুকনো খড় সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে হাত পা ছ্যাকা দেয়। তাদের বাবা চাচারা ফেরিওয়ালাদের মত বাঁশের ছাচা কঞ্চির দু পাশে রশি বেধে রশের হাড়ি ঝুলিয়ে বাড়ীতে নিয়ে আসে। রসের হাড়ি জমে জমে ভরে উঠে বাড়ীর আঙ্গিনা। সে রস দিয়ে বাড়ীর মা চাচিরা সকালের নাস্তা হিসাবে তৈরী করে রসের চা আরো নানা রকমের পিঠা, এই পিঠার মধ্যে চিতই পিঠাই বেশি তৈরী করে তারা। চিতই পিঠা রসের মধ্যে সারা রাত্র ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে খেতে এতই সুস্বাদু যা আমার ভাষায় লিখতে পারবনা। আকাশ ফুড়ে একটু রোদ বের হলে গাঁয়ের বৃদ্ধরা অঙ্গে গরম চাঁদর জড়িয়ে উঠানে বসে নাতি নাতনিদের সাথে আগের দিনের রাজা রানীর গল্প শুনায়। সকাল বেলা সবাই একটু ঠান্ডা মেজাজে থাকতে পছন্দ করে। কারো বাড়ীতে ঝগড়া ফেসাদ শোনা যায়না কেবল মাত্র হামিদ শিকদারের বাড়ী ব্যতিত। সে বার মাস প্রতিদিন সকালে চেচামেচি করবেই তা যে কোন কারণেই হোক না কেন। উপযুক্ত কোন কারণ থাকলে তো কথাই নাই আর কোন কারণ না থাকলে সে কারণ তৈরী করে ঝগড়া ফেসাদ করবেই। এটা নাকি তার ছোট বেলার অভ্যাস তাই তার পরিবারের কেহ এই নিয়ে মাথা ঘামায়না। আজকের মত সুন্দর একটা সকালেও সে মানুষকে গালাগালি করতেছে। যদিও এই গালাগালির উপযুক্ত কারণ আছে। তার গালাগাল শুনে পাশের বাড়ীর নূরা চোখ মুছতে মুছতে বলল “কি গো কাক্কু কি হইছে? এ্যত চিললাও ক্যান ?”
“দ্যাখ নুরা। প্রেত্তেক দিন রাইতে আমার গাছের রস চুরি হয়। কোন হালার ফালায় যে আমার রস নেয়। একবার ধরতে পারলে দ্যাহাইয়া দিতাম। আমি হামেদ হিকদার।”
“কি কও কাক্কু ? রস চুরিতে তো পাপ নাই। চোরে জাইন্নাই চুরি করে। আর একটু আকটু রস খাইলে এমন কি হয় ? তোমার তো ম্যালাডি খেজুর গাছ।”
“কি কইলি ? আমারে হাদিস হুনাস। তোরে কইলাম রাইতে রাইতে আমার গাছগুলা পাহাড়া দে আমি তোরে নিকা করাইয়া দিমু।”
“নিকা করাইবা আর কবে। দ্যশে কি আর মাইয়া আছে। গেরামে আমার বয়সি আর কয়ডা পোলা আছে আবিয়াত্তা, কও দেহি। হাতে পায় হয়তো বড় হইনাই তাই বইল্লা বয়সতো আর কোম অয়নায়। উপযুক্ত বয়সে নিকা করলে আইজ আমার ডাঙ্গোর ডাঙ্গোর দুই একটা মাইয়া পোলা থাকত।”
“এ উপযুক্ত বয়সে নিকা করলে ওনার দুই এ্যকটা পোলাপান থাকতো। কতার কি ছিরি ! যে পোলার নাক টিপলে এহনও মণে মণে দুত বাইর হয় হে পোলায় করবো নিকা।”
“কাক্কু তুমি আমারে নিকা না করাইলে আমিও তোমার গাছ পাহাড়া দিতে পারমু না। প্রেত্তেক দিন রাইতে তোমার রস চুরি অইলে আমার কিছু করনের নাই।”
নূরার কথায় পাত্তা না দিয়ে বির বির করতে করতে হাটিয়া গেল হামিদ শিকদার। হামিদের পাশের ঘরেই থাকে নূরা। একজনার ঘরের বেড়ার সঙ্গে আর এক জনার বেড়া মিশানো। দু জনার রান্না ঘরের মধ্যে কলা গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া আছে। নূরা এতক্ষণ ঐ কলা গাছের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কথা বলছিল। নূরা তার সমবয়ষীদের সাথে মিশে রাতের বেলা পারাপরশীদের খেজুর গাছের রস ও নারকেল ইত্যাদি চুরি করে বনভোজনের আয়োজন করে। মাঝে মধ্যে তাদের আত্বীয় স্বজনদের বাড়ী থেকে হাঁস মুরগী চুরি করে রাতের বেলা মাংস খাবার আয়োজন করে। এসব কাজে মাঝে মধ্যে মানিকও তাদের সাথে শেয়ার থাকে। নূরা ও মানিক ছোট বেলার বন্ধু। সম বয়সী বন্ধুরা এক হয়ে রাতে এসব রান্না করার মধ্যে এক রকম সুখ খুঁজে পায় ওরা ! গত রাতে কন কনে ঘন শীতের মাঝে নূরা-হামিদ শিকদারের রস চুরি করে আর সুরে সুরে গায় “রস চুরিতে নাই পাপ, রস চোরেরে দিলে গালি যাইতে হবে কুমাড় বাড়ী” সারা রাতে এমন গীত গেয়ে যত রস চুরি করে তা নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ওরা সিন্নী রান্না করে কলা পাতায় গরম গরম সিন্নী খায়,এটাই ওদের কাছে অনেক মজার ব্যপার। সিন্নিতে রস দিতে দিতে মিষ্টির পরিমান এত বেশি হয়েছে যে মুখে নেওয়া যায়না। রস দিতে দিতে লবণ দেবার কথা ভুলেই গেছে। রান্নার পরে মানিক মুখে নিতেই বলে “কি করছোস নূরা ?”
“কি অইছে মিডা কোম অইছে। আর একটু রস ডালমু সিন্নির মদ্যি।”
“আরে হারামজাদা, এই নে খাইয়া দ্যখ। কি কোম অইছে।”
“মাইনকা, তুই আমারে হারামজাদা কইয়া গাইল দিলি মোনে অয় ?”
“না। গাইল দি নাইতো। রাজার বড় পোলাগো শাহাজাদা কয়না, তুই হইলি গিয়া হে রাজার ছোড পোলা হারামজাদা। আমি তোরে রাজার ছোড পোলা বানাইয়া দিছি।”
হাসি মসকরা ভুলে নূরা গরম গরম সিন্নি মুখে নিতেই জিহব্বায় কামর দিয়ে আফসোস প্রকাশ করে বলল “ও নূন একটু কোম অইছে।”
এভাবেই তারা বনভোজন করে, কোন দিন নূন হয়না তো কোন দিন তেল হয়না। তারপরও অনেক আনন্দে খায় তারা।
আজকে সকালের কথা, মানিক অনেক রাতে এসে ঘুমিয়েছে তাই শীতের সকালে একটু দেরি করেই উঠেছে। এর মধ্যে পরী এসে মানিকের মাকে বলল “কি করেন গো চাচি আম্মা ?”
“চাইল ভাজতাছি রে মা। ব্যানবেলা রসের চা খামু তা ঘরে কিছু নাই। চাউল ভাজা দিয়া রসের চা খাইতে ভালাই লাগে।”
“এই নেন চাচি আম্মা, কাইল রাইতে আমি নিজের হাতে চিতই পিঠা বানাইয়া রসে ভিজাই ছিলাম। আফনার জন্নি লইয়া আইছি।”
এরপর পরী এদিক ওদিক তাকাইয়া বলল “মানিক বাই বাড়ীত নাই ?”
“হ, আছে তয় ঘুমাইতাছে। জাগাইয়া দিমু।”
“না, থাক লাগবোনা। আমি যাইগো চাচি।”
“চা খাইয়া যা। বয় কতক্ষুণ।”
“না মায় খুঁজতে পারে। না কইয়া আইছি।”
“ঠিক আছে, তয়পরে আইস।”
কিছুক্ষণ পরে মানিক ঘুম থেকে জেগে উঠার পরে তার মা তাকে বলে “পরী তোর জন্নি চিতই পিঠা বানাইয়া নিয়া আইছে। নে বাপ পিঠা খা।”
“না মা আমি এহন কিছু খামুনা। মনডা ভালা নাই।”
এই বলে মানিক ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল কাজের উদ্দেশ্যে। সর্মেতবানু মানিককে নিয়ে অনেক চিন্তিত। সে ভাবে “দেখতে দেখতে পোলাডা আমার ম্যালা ডাঙ্গর অইছে। এহন তারে নিকা করাইয়া দেওন লাগে। মরার আগে যদি পুতের বউ দেইখা যাইতে পারতাম তয় মরেও শান্তি পাইতাম।”
সমের্তবানু তরিগরি করে ঘটক তোতা মিয়াকে খবর পাঠাইছে যত দ্রুত সম্ভব ভাল একটা পাত্রীর খোঁজ যেন নিয়ে আসে।

বেশ কিছু দিন পরের কথা
ফাল্গুন মাস আরম্ভ হতে না হতেই কৃষকেরা ইরি ধানে বীজ বপণ করেছে। ইরি ধান সাধারণত দু থেকে তিন হাত লম্বা হয়। এ ধান পাকিবার পূর্বেই ক্ষেতের মাঝে পানি উঠে বলে এ ধান নিয়ে কৃষকদের অনেক চিন্তা থাকে। তিন মাসের মধ্যে ধান পেকে যায় এই জন্য উপযুক্ত সময়ের একটু আগেই ইরি ধান বপন করতে হয়। জৈষ্ঠ্য মাসের যে করেই হোক ধান কাটতে হয়, তা নাহলে জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি ক্ষেতের মধ্যে যে পানি উঠে তাতে ধান গাছগুলো মাটিতে নুয়ে পরে। অনেক সময় কৃষকদের কাচা ধানও কাটতে হয় কারণ বৈশাখ মাসে ঝড় বৃষ্টি বাতাশ সহ কাল বৈশাখী ঝড়ও হয়। কাল বৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়লে তো কোন কথাই নাই সব ধান পানিতে ডুবে যাবে। কৃষকদের ভিক্ষা ছাড়া আর কোন গতি থাকেনা। ধান তো নষ্ট হয়ই তার শোক ভুলতে না ভুলতে পাওনা দাররা এসে ভিটা বাড়ী দখল করে নেয়। অনেক গরিব কৃষক আছে যারা ইরি ধান চাষ করতে কড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে ধানের বীজ, সার, কিনে। গ্রামে সুদ দেবার জন্য কদম আলীর মত অনেকই পাওয়া যাইবে। যাদের একটু টাকা পয়সা আছে তারাই সুদের ব্যবসা করে। গ্রাম-গঞ্জের নিচু এলাকাতে এই সুদের ব্যবসা এতই বেশি প্রচলিত যে গ্রামের মানুষ সুদ ছাড়া বিবাহও করতে পারেনা। মাদবর, মহাজনদের কাছ থেকে সবাই কিন্তু সুদ চাইলেই পায়না। সুদ পেতে হলে তার ধানের জমি কিংবা ভিটা বাড়ী থাকতে হয়। সুদের টাকা সময় মত পরিশোধ না করতে পারলে সুদ দাতারা পাওনা দারের বাড়ী, ক্ষেতের ধান সব দখল করে নেয়। তবে যারা সুদ দেয় তাদের কিন্তু একটা লাঠিয়াল বাহিনী থাকে। গত বছরে দলু হাওলাদার সুদের তিন হাজার টাকা দিতে না পারায় কদম আলী তার ভাগের সব ধানগুলো কেটে নিয়ে এসেছে। কদম আলীর এত জমা জমি তা কিন্তু তার পিতৃ সম্পত্তি কিংবা ক্রয় সূত্রে সে মালিক নয়, গ্রামের আট দশ জনার মতই তার বিঘা ছ’য়েক জমি ছিল। কিন্তু সুদের কারবার করতে করতে সে আজ এত জমির মালিক। তারপরও ইব্রাহিমের মত অনেক কৃষক কড়া সুদে টাকা এনে চড়া সুদে পরিশোধ করে। সুদ ছাড়া আর কোন যে পথ খোলা নাই। পরের জমিতে বর্গা চাষ করতে গেলে লাঙ্গল,জোয়াল,বলদ,সবই থাকতে হয় আর যাদের এসব নাই তারা সুদের টাকা দিয়ে ভাড়ায় এনে চাষাবাদ করে। সেই হিসাবে মানিকও একজন নিঃস্ব কৃষক। তার নিজের নামে জমা জমি লাঙ্গল, বলদ কিছুই নাই। তার সত্ ভাইদের কাজ করলে দু বেলা আহার জুটে না হয় উপোস করতে হয়। মানিক তার বড় ভাইদের জোগালী কাজ করে। মানিক জানে, তার ভাইদের বিরুদ্ধে কেস মামলা করলে হয়তো সেও পিতৃ সম্পত্তির ভাগ পাইবে কিন্তু এসব করে কি লাভ ? চোখে দেখে যারা অন্ধ হয়ে থাকতে চায় তাদের চোখে আলো ফিরিয়ে দিলেও তারা আধার খুঁজবে। মানিক আরো বলে “একজন মানষের জীবনে কত সম্পত্তি লাগে, দুই দিন বাদে যামু মইরা সব সম্পত্তি থাকবো পইরা। তার চেয়ে বাইগো কাম কইরা বেশ ভালাই আছি। আল্লার কাছে লাক লাক শুকুর।”
মানিকের সম্পত্তির উপড় কোন লোভ নেই। তার স্বপ্ন সকাল বিকাল দুটো কাঁচা মরিচ দিয়ে এক প্লেট ভাত খেতে পারলেই জীবনের সকল স্বাদ মিটে যাবে। তারপরেও যদি মনে মত জীবন সঙ্গী পাওয়া যায় তবে তাহার মত সুখী আর কে হবে। মানিকের মায়ের বয়স হয়েছে। তাহার মধ্যে নানা রকমের রোগ শোক এসে উপস্থিত হয়েছে। সে জানে তার দেহের মধ্যে কঠিন এক ব্যধি বাসা বেধেছে, যে কোন সময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারেন। বিদায় নেবার পূর্বে অন্তত এতিম, অসহায় মানিকের জন্য সুন্দরী দেখে একটা লাল টুকটুকে বউ রেখে যেতে পারলে তার মনে আর দুঃখ থাকতনা। তোতা মিয়া অনেক দিন বাদে মানিকের জন্য একটা সমন্ধ নিয়ে এলো। মানিক সে সময় বাড়ীতেই উপস্থিত ছিল। সর্মেতবানু ঘটককে বলল “দাদা, মাইয়া কিন্তু লাল টুক টুক অয়োন লাগবো, আমার মানিকের মত পোলা এই গেরামে পাওন মুশকিল।”
“আমি সব জানি বুবু, মাইয়া মাস আল্লাহ ডানা কাডা পরী। তোমার পোলার মত মাইয়াও লাকে এ্যকটা। বিরাট অবস্থা, সমন্ধ করলে ঠকবানা।”
“মাইয়ার কোন ছবি টবি আনছো।”
পকেট থেকে একটা ছবি বের করে দিয়ে বলল “এই নেন বুবু, মাইয়ার ফটো। অতি উচ্চ বংশের মাইয়া।”
সর্মেতবানু পাত্রীর ছবিটা অনেকক্ষণ নেড়ে চেড়ে দেখে বলল
“না,তুমি ঠিকই কইছ। মাইয়া হাছাই চান্দের নাহান। নাম কি ?”
সর্মেতবানুর দেওয়া পানের খিলি চিবাতে চিবাতে বলল “মাইয়ার নাম সাবিনা ইয়াসমিন মৌ। বাপের নাম নূরুল ইসলাম। গিরাস্ত পরিবার। দুই গেরাম পরেই বাগের হাটের খায়গো বাড়ী। মাইয়ার বাপেরে সবাই এক নামে চিনে।”
“দ্যাখ মানিক, তোর মোনে ধরে কিনা। তুই কইলেই আমি পাকা কতা দিমু।”
“মা আমি এই গেরামের মদ্যে নিকা করমু। ভিন গাঁয়ের লগে আমাগো মিলবনা।”
মানিকের কথার উত্তরে তার মা বলে “ঘটক বাই আফনে ওর কতায় কান দিয়েন না, পোলাপান মানু ও কি বুঝে।”
“ঠিকই কইছেন বুবু, পোলাপানের কতায় কান না দেওয়াই ভাল।”
“তা বাই ছাব, মাইয়ার আত্বীয় স্বজনের মদ্যে কোন কলঙ্ক নাই তো।”
“না তেমন কোন সমেস্যা নাই। মাইয়ার মদ্যে আর মাইয়ার বাপের মদ্যে একটু দোষ আছে,তয় তারা কইছে যৌতুক দিয়া পোসাইয়া দিবো।”
“কি সমেস্যা, চোর ডাকাইত না তো আবার।”
“আরে না বুবু, আমি কি মানিকের জন্নি এমন পাত্রী আনতে পারি। আফনেই কন ? মাইয়ার বাপের দুই নিকা আর মাইয়ার আগে এ্যকখান নিকা অইছিল। জামাই ফটকা, চরিত্র হীনা লম্পট তাই নিকার পরে মৌ মা তালাক লইয়া আইছে।”
“কি কন কাক্কু। একটা বিয়াইত্তা মাইয়ারে নিকা করমু আমি ?”
সর্মেবানু ঘটক তোতা মিয়াকে বলল “না আমরা এই সোমন্ধ করমুনা। একটা বিয়াইত্তা মাইয়া আমি ঘরে আনলে, নানান মানষে নানান কতা কইবো। তারচেয়ে ভালো তুমি অন্য জায়গায় দ্যহো।”
“আরে বুবু,আইজ কাইল এমন একটু আকটু হইয়া থাকে। এটা কোন ব্যপার না, বেশি বেশি যৌতুক নিতে পারবা। বুবু তোমাগো অবস্থাও তো তেমন ভাল না। ভাংগা বেড়া ভাংগা ঘর।”
“না কাক্কু, আমরা রাজি না।”
“ভাইব্বা দেহ। এমন সোমন্ধ আর কিন্তু পাইবানা।”
সর্মেত বানুও এ সমন্ধে রাজি নয়। সে তোতা ঘটকের কথায় চুপ করিয়া রইলো। তখন তোতা মিয়া সর্মেত বানুকে বলে “ঠিক আছে তোমরা যা ভাল মোনে কর। তয় মত ঠিক অইলে আমারে জানাইও।”
ঘটক তোতা মিয়া সাথে সাথে মানিক ও বেরিয়ে গেল ঘরের বাহিরে। দুপুর হতে চলেছে। মানিক মাঠ থেকে গরুগুলো নিয়ে গাঙ্গের দিকে গেল গোসল করানোর জন্য। মানুষের মত গরু মহিষকে প্রতিদিন গাঙ্গের মধ্যে নামিয়ে খড়ের ছোবা দিয়ে ঘসে ঘসে নাওয়াইতে হয়। মানিক এক পাল গরু মহিষ নিয়ে গাঙ্গের মধ্যে নাওয়াইতেছে, এমন সময় পরী কার বাড়ী হতে যেন আপন বাড়ীর দিকে ফিরিতেছে। মানিক তাকে দেখিয়া গাংঙ হইতে হাতের কোষ ভর্তি করে পানি নিয়ে তাহার গায় ছিটিয়ে দিয়ে বলে “কি গো পরী কই যাইতাছো এই খাড়া রইদের মদ্যে।”
“যামু আর কই? কেউ তো আর আমাকে নিকা কইরা তার ঘরে তুলেনা। তাই মনের দুঃখে নাইচ্চা নাইচ্চা বাপের বাড়ী দিলাম পাড়ি ?”
“নিমু নিমু, একটু সবুর করো, আমার ভাংগা ঘরে আমি কি আমার লক্ষীরে তুলতে পারি। তুমি নয়া ঘরে নয়া শাড়ী পইড়া আইবা।”
মানিক কড়া রোদে গাঙ্গের পানির মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় কথা বলছিল। গাঙ্গের পাশেই বড় একটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাতে একটি পাট গাছের কঞ্চি নিয়ে পরী মানিকের সাথে প্রেমালাপে মত্ত ছিল। নয়া প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম আলাপ আরম্ভ হয় কিন্তু শেষ হয় না। তারা এতই আবেগের সাগরে ডুবে থাকে কখন যে কি বলে তারা নিজেরাও জানেনা। মানিক পরী কথা বলতে বলতে এক সময় তারা একে অন্যের হাত ধরে মুখোমুখি কথা বলছে।
“জানো পরী আমার না খুব ডঢ় লাগে, তুমি এত সুন্দার ক্যা, কেউ যদি তোমারে পছন্দ করে।”
“পছন্দ করলেই কি অইবো। আমি তোমারে ছাড়া কেউরেই নিকা করমুনা। বাপ মায় জোড় করলে আমি তোমার ধারেই (কাছে) চইল্লা আমু। আমারে নিয়া তোমার চিন্তার কোন কারোণ নাই। আমার চিন্তা তোমারে নিয়া, হুন চাষি আমারে রাইখা অন্য কারে যদি নিকা করো আমি তোমারে দ্যাইখা নিমু পরে নিজে বিষ খাইয়া মইরা যামু।”
মানিক বসা থেকে নুয়ে ক্ষেতের কিছু শুকনো মাটি ডান হাতে মুষ্টি করে সোজা হয়ে পরীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল
“আমি এই তোমার সামনে পবিত্র মাডির কসম খাইয়া কইলাম-আমি যদি পরানে বাইচ্চা থাহি তোমারে ছাড়া আর কাউরে নিকা করমুনা। এবার তোমার বিস্বাশ অইছে।”
“হ।”
“সত্যিকারের পেমে নাকি কোনদিন মিল অয়না। বিরহ আর কষ্টই থাহে।”
“থাকতে পারে তয় আমারে মিল অইবোই অইবো।
“অইলেই ভাল। তয় সত্যিকারের পেমে ম্যালা সুক থাহে,বাচোনের স্বাদ থাহে।”
“তুমি ঠিকই কইছো চাষী, প্রেমে না পড়লে আমরা কোন দিনই জীবনে বাইচ্চা থাহোনের মদ্যে এত সুক পাইতাম না। প্রেমে করোনের পর আমার মোনে অইতাছে আমরা যদি হাজার যুগ বছর বাইচ্চা থাকতে পারতাম তাইলে কি যে মজা অইতো কও চাষী।”
কথা বলতে বলতে এতই কাছে এসেছে তাদের কাছ থেকে সকল ভাষা পালিয়ে গেল, তাদের পলক হীন চোখ কথা বলতে মানিক পরী হারিয়ে গেল অজানা এক ভুবনে।
চান্দু হুজুর আপন চোখে মানিক পরীর এই অবস্থা দেখে আর সইতে পারলোনা। হিংসায় ফেটে যাচ্ছে। সে যদি হুজুর না হত তবে কি যে মজা হত। সেও অবিবাহিত মেয়ে মানুষ নিয়ে মাঠে ঘাটে নাচতে গাইতে পারত, হাত ধরা ধরি করে গাঙ্গের পারে বসে খোলা হাওয়া খাইতে পারতো। চান্দু জানে সে মানিকের সাথে জোড়ে পারিবেনা। তাই সে দেরি না করে দুপুর বেলাই গেল পরীদের বাড়ী, পরীর মায়ের কাছে নালিশ জানাতে। পরীর মা উঠানের এক কোনে রান্না ঘরে রান্না করছে। চান্দু রাগরাগ চেহারায় নাক মুখ বাকা করে রান্না ঘরের দিকে যেতেই পরীর মা না দেখে রান্না বান্নার ময়লা পানি উঠানের দিকে ছুড়ে ফেলতে তা গিয়ে ছিটে পড়ল চান্দু হুজুরের গায়ে। চান্দুর সারা শরীর ময়লা পানিতে এমন ভাবেই ভিজে গেল দেখলে মনে হয় তাকে কেহ গাঙ্গের মধ্যে চুবিয়েছে। তার গায়ে তরকারির খোসাগুলো তখনও লাগিয়া ছিল।
চান্দু এরপরও রান্না ঘরে ঢুকে আমেনা বেগমকে বলল “চাচি একখান কতা আছিল। খুবই গোপন।”
আমেনা চুলার রান্না রেখে তার দিকে একবার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে “তোমার এই অবস্থা কেডায় করছে। নাকি তোমারে কেউ গাঙ্গের মদ্যে চুবাইছে বাবাজি।”
“আমারে চুবাইবো এমন ব্যাটা এ গেরামে কেডা আছে, কন দেহি চাচি।”
“তয় তোমার গা গতর অমন ভিজা ক্যান,আবার আনাজ তরকারির খোসা মোসাও গায় লাইগা আছে ?”
“আফনেই তো আনাজ ধোয়া পানি আমার গায় ছিটাইয়া দিলেন।”
“হাছাই, তয় তোমারে না দেইখা দিছি। মনে কিছু করনাই তো।”
“না মনে কিছু করিনাই। একখান কতা কইতে আইছিলাম।”
“কও, কও কি কতা কইবা।”
“পরীরে দ্যখলাম এই গেরামেরই একটা পোলার লগে নাচা নাচি করতে। আর দ্যখলাম যা তা কওন যাইবো না। আমাগো গেরামে পাপ বেশি হইতেছে, মাইয়া গো বেপর্দায় চলাচল করতে দেওয়া গুনার কাম।”
“কার লগে নাচা নাচি করতে দ্যখ ছো।”
“হের নাম কওন যাইবোনা, হে জানতে পারলে আমারে জিন্দা কব্বর দিবো। তয় আমি যাই চাচি। আমিযে এই খবর দিছি তা মোনের ভুলেও পরীরে কইয়েন না।”
আমেনা চান্দুর কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে মশগুল হলেন। চান্দু চলে যাবার পথেই পরী বাড়ীর দিকে ফিরলেন। আমেনা বেগম পরীকে রাগ স্বরে ডেকে বলে “পরী, এই খাড়া রউদের মদ্যে গেছিলি কই? কার লগে পাড়া বেড়াইয়া আইলি। আবার নয়া নাগোর জোগাইছ। আইজ তোর বাজানে বাড়ীত আইউক।”
“মা, তোমারে এই সব নালিশ করলো কেডা ? আমি তো মর্জিনাগো বাড়ীতে গেছিলাম। আইজ মর্জিনারে বিয়ান ব্যালা দ্যাখতে আইবো। পোলার গঞ্জের হাটে বিশাল কাপড়ের আড়ৎ আছে।”
আমেনা বেগম কোন কথার প্রতি উত্তর না করে পরীকে বলল
“কাপুড় চুপুর লইয়া পুকুড় ঘাট দিয়া নাইয়া আয় গিয়া। ব্যালা তো আর কোম হইলোনা।”
মর্জিনা পরীর খুব প্রিয় বান্ধবী। দু জন দু জননার মনের কথা সব জানে। পরীর সঙ্গে যে মানিকের একটা গভীর সম্পর্ক আছে তাও কিন্তু মর্জিনার অজানা নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯:০৬:০৪   ৯৩৭ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ