সুখ-কাটা–আল রিআন

Home Page » সাহিত্য » সুখ-কাটা–আল রিআন
মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৪



suk-katajpg.png

নবম পর্ব শুরু…………..আজ শুক্রবার। সকাল থেকেই হাটের মধ্যে মানুষের হই চৈ। আজ ধান বিক্রির দোকান ছাড়া অন্য দোকোনের সংখ্যা এতই কম যে কৃষকদের ভীড়ে তাদের খুঁজে বের করা অনেক কষ্ট কর। ধানগুলো বস্তা থেকে ঢেলে স্তুব দিয়ে হাটের মধ্যে রাস্তার দুই পাশে রেখে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে। ক্রেতারা রাস্তার মধ্যে দিয়ে হেটে হেটে এক এক জনার ধান দেখে দর দাম করে। যার সাথে দর দামে বুনে যায় ক্রেতারা তার ধান ক্রয় করে। তবে ধানের দাম আজ ক্রেতারা এতই কম বলিতেছে যে দশ সের ধান বিক্রি করিলে এক সের ধানের খাঁটি দাম পাওয়া যাবে না। এর কারণ আজকে হাটে প্রচুর ধান উঠিয়াছে। এর জন্যই হয়তো ধানের দাম পানির দরে চলিতেছে। ক্রেতারা বুঝেছে হাটে যখন এত ধান উঠেছে তাহলে কৃষকদের বাম্পার ফলন ফলেছে। কৃষকরা অনেক কষ্ট করিয়া গ্রাম-গঞ্জ হতে বস্তায় বস্তায় ধান এনেছে নিশ্চই বাড়ীতে ফেরত নেবার জন্য না। সে সুযোগটি ধরেছে ক্রেতারা। এত কষ্টের ফসল পানির দামে কার ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো এই সোনার ফসল ধান। সারা মাস এতো খেটে সার পানি দিয়ে ভাল ফসল ফলানো কি তাদের পাপ হয়েছে। ন্যায্য দামে কারো ধান এক পাল্লাও বিক্রি হয়নি। ক্রেতাদের অন্যায় আবদার কৃষকেরা না মানলেও র্অধ বেলা পার হয়ে গেলেই মানতে বাধ্য হবে অনেক কৃষক। এত ধান বাড়ী ফেরত নেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব হবেনা। অভাব অনটনের এক সংসারের গুন টানতে হয় কৃষকদের। কারো হাতে কোন জমানো পুজিঁও নাই। সব কাজই তাদের ধান বিক্রির টাকায় করতে হবে। এতই অভাব অনটনের সংসার যে একটি দিনও তাদের টাকা ছাড়া চলবেনা। নতুন ইরি ধানের চাষ করতে হলেও অনেক অর্থের প্রয়োজন। জমিতে আবারো সার গোবর দিয়ে মাটিকে পাকা পোক্ত করে তুলতে হবে। সময় মত সার পানি না দিলে ধান গাছ ঠিকই বড় হবে কিন্তু সব চিটা হয়ে যাবে। অনেক কথা বিবেচনা করে লোকসান দিয়েই ধান বিক্রি করবে অনেক কৃষক। আবার অনেকে বলে “এ্যাতো লোসখান দিয়া ধান ব্যাচমু না। লাগলে কেরাসিন দিয়া জালাইয়া দিমু। হারা বছর গাধার খাটুনি খাটছি কি এত লোকসান দেওয়ার জন্নি।”

বাজারের দর দামের কারণে কৃষকদের মন খুবই খারাপ। মানিক বাবুলকে বলল “মেয়াবাই, এত লস ক্যামনে পোসামু। লও সব ধান বাড়ী নিয়া যাই। সামনের শুক্কুর বার দাম বাড়তেও পারে। গতবার এ্যমন অইছিল না, শ্যাস হাডে ধান কোম থাকোনে ম্যালা দামে ধান বেচছি।”
“যদি ধানের দাম না বাড়ে, আরো দাম নাইম্মা যায় তহন কি করমু। আর পকেট এক্কেবারে খালি, একটা ফুটা পয়সাও নাই। ঘরে বাজার নাই। তোর ভাবীর পরইন্না কাপুড়ও নাই। কি করমু বুঝদাছিনা। দ্যাখ যা পারো ব্যাচ। হাডের সোমায়ও তো শ্যাষ।”
ধানের বাজার এত খারাপ যে কৃষকদের মাখায় হাত চোখে জল।
পশ্চিমাকাশের সূর্যটা গাঢ় লাল হয়ে উঠছে অর্থাৎ হাটের সময় শেষ হয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। যে যা বিক্রি করেছে তা দিয়েই প্রয়োজনের চেয়েও কম বাজার করে বাড়ী ফিরেছে অনেকে। এই প্রয়োজনের বাজারের মধ্যে বেশির ভাগ লোকের হাতে রসের হাড়ি ছিল। কেবল ধানের বাজার মন্দা হবার কারণে অন্যান্য ছোট ছোট পন্যের বাজারও মন্দা হয়েছে। ধান বেচা বিক্রি কম চলেছে বলে কৃষকরা অন্নান্য নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার কম কিনেছে। এক কথায় সবারই বেচা বিক্রি কম হয়েছে। এ গ্রামের কেহ বাজার করতে ব্যাগ ব্যবহার করে না, সবাই সাজীতে বাজার নিয়ে মাথায় চাপিয়ে নিয়ে আসে। পাশের গ্রামের আলি হোসেন আজ বহু দিন পরে সাজী ভরে বাজার করেছেন। একটা বড় মোরক, একটা তাজা ইলিশ মাছ, গরুর দুধ, খেজুর মিঠাই ও শাপলা তরকারি। তার এই বাজার দেখে সবাই হতভম্ভ। যে আলি হোসেন সকালে হাটে গেলে সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ী ফিরত দুই এক আঁটি শাক নিয়ে না হয় খালি হাতেই। সাজী ভরে বাজার আনতে আনতে রাস্তায় তাকে হাজার মানুষের কাছে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে “আইজ আমার মাইয়া জামাই আইবো।”
নতুন জামাই, আদর আপ্যায়ন কম করলে কি করে হবে। তাই অভাব অনটনের মধ্যেও সাজী ভরে বাজার করেছে আলি হোসেন। বাড়ীতে আজ রান্নার ধুম পরে গেছে। মেয়ে জামাই হলেও জলমিয়াকে তার শ্বশুড় বাড়ীর কেহ নিজের চোখে দেখে নি। আলি হোসেনের আর্থিক অবস্থাও তেমন উন্নত নয়। বাঁশের বেড়া খড়ের চাল দিয়ে তৈরী তাহার ঘর। গ্রামের আট দশ জনার মত সেও একজন কৃষক। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে কোন মতে টিকে আছে। মাত্র ছয় কন্যা ও এক পুত্রের জনক আলি হোসেন। বড় কন্যা নার্গিসের গায়ের রং একটু ময়লা বলে ঘরে আইব্র” হয়ে আছে। নার্গিসের বাকী ছোট বোনগুলোর নিকাহ প্রায় শেষ। মেঝ বোন ফাতেমা দেখতে মাসআল্লাহ বলে অতি তারাতারি বুড়ো মকবুলের সাথে নিকাহ হয়ে গেছে। বড় বোন নার্গিসকে দেখতে পাত্র পক্ষ আসলে তার ছোট বোনদের পছন্দ করে নিকাহ করে নিয়ে যায়। এভাবেই আলি হোসেনের মেয়েগুলোর নিকাহ্ হয়েছে। অতি দরিদ্রের ঘরে অনেক সন্তান হলে যা হয় আর কি। কোন রকম পাত্র পেলেই আর হাত ছাড়া করেন নি, একে একে ধরে তার কন্যাদের নিকাহ্ দিয়েছেন। আলি হোসেনের মেয়ে জামাইদের মধ্যে কেহ মাঝি, কেহ রাখাল আবার কেহ এতই বুড়ো যে শ্বশুড়ের বয়সকে হার মানায়। আলি হোসেন ও তার স্ত্রী মাস খানেক আগে জানতে পেরেছেন তার কন্যা বুড়ো মকবুলের সংসার থেকে জলমিয়ার সংসারে এসেছেন। জলমিয়াই আলি হোসেনের সেই আমন্ত্রিত অতিথী। হাট থেকে বেলা বেলি ফিরে এসে বিকাল হতেই বাড়ীর সামনে পাইচারি করতে করতে দূরের দিকে উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। জুলেখা বেগম রান্নার ফাঁকে ফাঁকে এসে তার স্বামীকে বলে “কি গো মাইয়া জামাইর কোন খোঁজ পাইছো ?”
“না। তয় আইয়া পরবো। তুমি যাও রান্দা বাড়া ঠিক ঠাক মত কর।”
“তা নিয়া তোমার ভাবোন লাগবো না। ওগো তুমি একটু সামনে যাইয়া দ্যাহ। নয়া জামাই পথ ঘাট ঠিক মত চিইন্না আইতে পারবনা।”
“আরে পারবো পারবো। আমাগো ফাতু লগে আছে না।”
জীবনের প্রথম কোন শ্বশুড় বাড়ী থেকে দাওয়াত পেল জলমিয়া। সে শেষ কালে ফাতেমাকে নিকাহ্ করে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করে। ফাতেমা কম করে হলেও লাখ টাকার সম্পত্তি নিয়ে এসেছে তার জীবনে। জমা জমি তার এখন কম নেই। ফাতেমার নামে পাওয়া নানার জমিতে চাষাবাদ করে তাদের টোনা টুনির বেশ জমিদারের হালেই জীবন কাটছে। জলমিয়া এখন আর আগের মত নাই। তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আজ বিবাহের প্রায় এক মাস পরে শ্বশুড় বাড়ী যাবে, একটু ফিট ফাট না হলে কি করে হয়। জলমিয়ার পুরানো একটা পাঞ্জাবি অনেক আগে ট্রাঙ্কে তোলা ছিল, সেটা আজ পড়বে কিন্তু, তার কোন পাজামা নাই। পাঞ্জাবির সাথে পাজামা না পড়লে কিরকম বেমানান লাগবে এই ভেবে পুরোগ্রাম চুসে বেরিয়েছে একটা পাজামা হাওলাত চেয়ে। কারো বাড়ীতেই একটা পুরানো পাজামাও পেলনা। অবশেষে তার পড়নের পুরানো লুঙ্গিটাকে সেলাই করে পরে নিল। লুঙ্গির উপরে পাঞ্জাবি পরিধান করার পর জলমিয়াকে কিন্তু মানিয়েছে বেশ। তার স্ত্রী ফাতেমা তাকে বলল
“তোমারে কিন্তু রাজপুত্তুরের মত লাগতাছে ।”
“হাছা কইতাছো। হ, আমার দাদার দাদা নাকি মাইড্ডা রাজা আছিল।”
“মাইড্ডা রাজা! এমন নামতো কোনদিন হুনিনাই। এই রাজারা কি মানষের বাড়িতে মাডি কাটার কাম করতো।”
“বাদ দেও তো ওসব কতা। তা বউ, তোমাগো বাড়ীতে গেলে কি আমারে নামায় বইতে দিবা, নাকি চকিতে বইতে দিবা।”
“ক্যান, এমন কতা কইলা ক্যান ?”
“না নামায় বইতে গেলে যদি সেলাই করা লংডা টান লাইগা ফাইড়া যায়, তহন শরম পামু না’কও দেখি। নয়া কুটুম বাড়ী যাইতাছি।”
“আমি তোমারে চকিতেই বইতে দিমু। অসুবিধা নাই।”
“আচ্ছা, বউ ভালা কতা মোনে অইছে ।”
“কি কতা আবার ?”
“জীবনের পহেলা বউর বাপের বাড়ী যামু, রসোগোল্লা না নিয়া কেমনে যাই। শালা শালিরা কইবো ফকিরা দুলবাই আইছে।”
“কি আর নিবা ? তোমার কাছে ট্যাকা পয়সাও তো তেমন নাই। বেশি শরম লাগলে এক ছড়ি পোক্ত বিছি ক্যালা ন্যাও।”
” আসলেই তো ভালা বুদ্ধি।”
এরপর দুজনে সন্ধ্যার আগে আগে রওহনা দিল। জলমিয়া এক হাতে একটি ট্রা্কং আর অন্য হাতে কলার ছড়ি নিয়ে বউয়ের আগে আগে হাটা ধরল। এদিকে জলমিয়ার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন চিন্তায় অস্থির। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল কিন্তু মেয়ে জামাই এখনও এলনা। ফাতেমা আর জলমিয়া হেটে আসতে আসতে অনেক হাপিয়ে গেছে যার কারণে এত দেরি হল। কিছুক্ষণের মধ্যে জামাই কন্যা সহ হাজির হল ফাতেমাদের বাড়ীতে। জলমিয়ার হাত থেকে তার ছোট শ্যালক শ্যালিকারা কলার ছড়ি আর টেরাংক হাতে নিয়ে বাড়ীর ভিতরে ঢুকল। জলমিয়ার জন্য যে সব খাবারের আয়োজন করা হয়েছে এসব খাবার গ্রামের মানুষ কখনও নিজেরা রেধে খায়না। বছরে দুই এক বার বিশেষ কোন মেহমানের জন্য রান্না করে হয়তো। জলমিয়ার শ্যালক শ্যালিকারা খুবই ছোট অনেক দিন পরে মুরগির মাংস ইলিশ মাছের তরকারি ও দুধ মিঠাই দিয়ে ভাত খাবে, কত আনন্দ তাদের মনে। বিকাল থেকেই বাচ্চারা বাড়ীর আসে পাশে ঘুরিতেছে, কখন দুলাভাই খাবার খেতে বসবে। বাচ্চাগুলো অবুঝ হলেও জানে মেহমানের আগে তাদের কোন অবস্থাতে খেতে দেওয়া হবেনা তাই দুলাভাইয়ের খাবার শেষ হবার অপেক্ষায় আছে। তারা একে অন্যকে বলা বলি করছিল “আইজ আমরা পাল্লা দিয়া মুরগার সালুন দিয়া আর ইলশা মাছ দিয়া ভাত খামু।”
জলমিয়া খুবই দরিদ্র, অশিক্ষিত ও অভদ্র মানুষ। সমাজ রক্ষার জন্য সামান্য ভদ্রতাটুকো জানেনা সে। মুরগির মাংস, ইলিশ মাছ ও শাপলা তরকারি পেয়ে সে ইচ্ছে মত ভাত খাওয়া আরম্ভ করল। এমনিতেই তার প্রতি বেলা এক সের চালের ভাত লাগে অর্থাৎ এক দিনে সে তিন থেকে সারে তিন সের চালের ভাত খেতে পারে তাও কাঁচা মরিচ দিয়ে। আজকে তো কোন কথাই নাই, দুইআড়াই মাইল পথ হেটে এসে এত ভাল খাবার পেয়ে তিন বেলার খাবার এক বেলাতেই শেষ করে দিয়েছে। জলমিয়ার শ্বাশুড়ি পিতলের ভোল ভরিয়া ভাত আনে আর শেষ। মুখের মধ্যে ভাত চাপিয়ে তার শ্বাশুড়িকে বলে “আম্মা এত সাদের সালুন দিয়া আমি জিবনেও ভাত গিলিনায়।”
“কি যে কও বাবা জি, আমি তো এত ভাল রানতে পারিনা। তোমার শ্বশুড় আমার হাতের রান্দাতো খাইতেই পারেনা।”
“কি যে কন আম্মা, এই খাওন খারাপ অইছে কোন হালায় কইবো।”
তখন জলমিয়ার শ্বশুড় তার পাশে বসা ছিল। জলমিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বসা থেকে উঠে চলে গেল বাহিরে। সে ব্যাপারে জলমিয়ার কোন খবর নাই। সে খাবার তালে মহাব্যস্ত। আর জলমিয়ার শ্বাশুড়ি তার মেয়ে জামাইর প্রশংসায় পঞ্চমূখ হয়ে বলে “জামাই, হাপলা সালুন দিয়া খাইয়া কয়ডা দুধ মিডাইদা ভাত লইও।”
“কিযে কন আম্মা, খামুইতো চাইডা দুত মিডাইদ্দা। ভাত দেখি নাই। কয়ডা ভাত আনেন। আমি আবার ভাত-টাত বেশি খাইতে পারি না। হের লই¹া দ্যহেন না আম্মা, দিন দিন ক্যামন হুগাইয়া গেছি।”
জলমিয়র শ্বাশুড়ী জুলেখা ভাত আনতে গিয়ে দেখে হাড়িতে আর কোন ভাত নেই। সে লজ্জায় জলমিয়ার কাছে না এসে দূরে সরে গেল। জলমিয়ার শ্যালক শ্যালিকেরা বাড়ীর চার পাশে ঘুর ঘুর করছে। ফাতেমা অনেক দিন পর বাবার বাড়ী এসে তার সইদের বাড়ীতে গিয়ে আলাপ জমিয়ে দিছে। ফাতেমা এসব ব্যাপারে কিছুই জানেনা। জলমিয়া খালি থালা নিয়ে ওমন ভাবেই বসে আছে। কারো কোন সারা শব্দ নাই। কিছুক্ষণ পরে সে বিরক্ত হয়ে শব্দ হীন ভাষায় বলল “ব্যাপার কি শ্বাশুড়ি ভাত আনতে গিয়া যে আর আইলো না। তায়লে আমি কি আইজ ভাত একটু বেশি খাইছি।”
তারপরে সে চোখ মুখ এক করে বলল “দুর খাইলে খাইছি।”
ফাতেমার মা ফাতেমাকে পাশের বাড়ী থেকে ডেকে এন বলল “জামাইর দারে আমি আইজ অপমান অইলাম রে ফাতু।”
“কি অইছে মা ?”
“জামাই একটু ভাত বেশি খায় তা আমারে আগে কইবি না। আমি তো আড়াই সের চাইলের ভাত রানছি। জামাই এহন ভাতের লাই¹া বইয়া রইছে। তুই গিয়া এক সের চাইলের ভাত বওহাইয়া দে, আমি শেফালিগো ঘর থাইক্কা এক বাডি ভাত হাওলাত আনি। জামাই দুত মিঠাইদা খাইবে।”
“না মা লাগবোনা। আমি বাড়ী যাইতাছি। মানষে কইবো কি? জামাই আইছে ভাত না রাইন্দা পরের বাড়ী থাইক্কা হাওলাত করে ।”
“থাউক! জামাইতো খাইবো। মানষে কইলে কি অইবো।”
ফাতেমা বাড়ীতে ফিরে সব হাড়ির ডাকনা সরিয়ে দেখল কোন হাড়িতে কিছুনাই। মাছ মাংস তরকারি কিছুই নাই। ফাতেমা বুঝতে পেরেছে তার ছোট ভাই বোনদের জন্য একটুও ভাল তরকারি নাই। আজও তাদের প্রতিদিনের মত দুটো পোড়া মরিচ অথবা আলু সিদ্ধ করে রাতের ভাত খেতে হবে। ফাতেমা একটু রাগ করে ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখে তার স্বামী এখনও ভাতের অপেক্ষায় বসে আছে। জলমিয়া তার স্ত্রীকে ডেকে বলল “কি অইছে বউ ? আম্মায় ভাত আনতে গিয়া আর আইলোনা যে। যাও যাও তুমি কয়ডা ভাত লইয়া আও।”
“তুমি কি গো ? মানষে, নয়া শ্বশুর বাড়ী আইয়া এত্ত গুলা ভাত গিলে। মায় ভাত আনতে গিয়া দ্যাখে পাতিলে ভাত সালুন কিছুই নাই। এহন পরের বাড়ীতে ভাত হাওলাত করতে গেছে।”
“হেতে কি অইছে ! আইজ মুরগার সালুন আর ইলশ্ ামাছের সালুনডা খুব মজা অইছে। কয় বছর পরে এই মুরগার সালুনার ইলশ্ ামাছের সালুন দিয়া ভাত গিললাম, তুমি জানো।”
“ওগো তোমার পায়ে ধরি, এহন আর খাই খাই কইরো না। কাইল তোমারে আমি দুত মিডাইদা খাওয়ামু।”
“ঠিকতো। মানষে নাকি শ্বশুড় বাড়ী বইয়া কয়ডা ভালা মোন্দ গিলে। তোমারা তো আামরে কিছুই গিলাই লানা ।”
এরপর জলমিয়া থালার মধ্যে হাত ধুয়ে বউয়ের কাপড়ের আঁচলে হাতটি মুছে ঘরের বাহিরে তাকিয়ে দেখল, তার শ্বাশুড়ি আবার ভাত তরকারি রান্না করার জন্য চুলায় হাড়ি চাপিয়েছে। জলমিয়া বোকা হলেও এতটুকো বুঝবার ক্ষমতা আল্লা তাকে দিয়েছে। ছোট শালা শালিদের অবুঝ মুখগুলো দেখে জলমিয়া বুঝতে আর বাকী নাই, তারা ক্ষুদার্থ। জলমিয়া তখন কি মনে করে যেন চোখ থেকে দু এক ফোটা জল ছেড়ে দিল।
জলমিয়া বোকা হলেও তার মধ্যে লজ্জা শরমের কিছু আকার ছিল। কিন্তু তার পরানের দোস্ত চান্দু হুজুরের সেই আকার টুকোও ছিল কিনা তা সন্দেহের ব্যাপার। চান্দু হুজুর গোটা হুজুর জাতির কলঙ্ক। কেবা জানে তাকে মাদ্রাসার মত এত ভাল একটা লাইনে পড়িয়ে হুজুর তৈরী করেছিল। সহজ কথায় তার মধ্যে হুজুরের কোন আকার লক্ষ্য করা যায় না। সে ইব্রাহিমকে পরামর্শ দিয়ে কইতুরির সাথে নিকাহ পাকা করাইয়া রেখেছে। টাকা পয়সা দিয়ে ইব্রাহিমকে নিকা করানোর পিছনে অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে তাহার। ব্যাপারটি এমন, বই কিনল ইব্রাহিম কিন্তু পুরো বই পড়ে মুখস্ত করল চান্দু হুজুর। আজ সন্ধ্যায় জিলানী হুজুর এসে ইব্রাহিম-কইতুরির দুই হাত এক করিয়া দিবে। অর্থাৎ কইতুরি আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। বিয়ে ইব্রাহিমের কিন্তু মনে মনে খুশী চান্দু হুজুর। এতই খুশী যেন চান্দু হুজুরের নয়া নিকাহ্ হবে তার মনের মানুষের সাথে। ইব্রাহিম সহজ সরল মানুষ, সে চান্দুর কোন চালাকি বুঝে উঠতে পারলোনা। সব কথা বিশ্বাস করে তাকে বলে দেয়। কইতুরির বিবাহে তেমন কোন ভীড় নেই। হলুদ ভাটা মেহেদী ভাটা নেই, নাচ গানের কোন উৎসব নেই। দলু অনেক দরিদ্র বলে তার মেয়ের বিবাহে এ গাঁয়ের কেহ উৎসব করতে আসে নাই। দলু টাকা পয়সা ধার কার্য করে দুটা মোরক কিনে রেখেছে জবাই করার জন্য। কইতুরির বিবাহে বরযাত্রী আসবে। তাদের অন্তত একটু ভাল মন্দ খাওয়াতেতো হবেই। এই ভেবে দলু মোরক পোলাউয়ের আয়োজন করেছে। ইব্রাহিম খালি পায়ে চলাফেরা করে সব সময়। সে ভাবিয়া দেখিল পাঞ্জাবি পাজামা পরিধান করার পর খালি পায়ে তাকে মোটেও জামাই জামাই লাগে না। এক জোড়া পঞ্চ খুবই প্রয়োজন। ইব্রাহিম তার ঘরের সব কিছু খুঁজেও একটি ফুটো পয়সা বের করতে পারলোনা। কিন্তু এক জোড়া পঞ্চ খুব প্রয়োজন। বিবাহ কি মানুষের জীবনে বার বার আসে ? অর্থ হয়তো একদিন ঠিকই কামাই করা যাইবে তবে বিয়ের জন্য সাজ সজ্জা আর করা যাইবেনা। অনেক ভাবিয়া ইব্রাহিম চান্দুর কাছে গিয়ে বলল
“চান্দু বাই, আমার এক খান আবদার রাখবা। অনেক করছো আমার নিকার জন্নি।”
“কি আবদার আগে কও দেহি ?”
“ত্যমন কিছু না, কয়ডা ট্যাকা দিবা। ধার নিমু, পরে শোধ কইরা দিমু।”
“রাখতে পারি, যদি তুমিও আমার একটা আবদার রাখো।”
“তোমার আবার কি আবদার?”
“তোমার কইতুরিরে আমার লগে নিকা দিতে হইবো।”
চোখ পাকিয়ে ইব্রাহিম বলল “কি কইলা চান্দু বাই ? তুমি আমার কইতুরিরে নিকা করবা।”
ইব্রাহিমের কথায় সে সামান্য ভয় পেয়ে উত্তর দিল “দূর পাগোল, আমি বিয়াত না! আমি তো তোর লগে মসকরা করছি ! তুমি তো জানোনা, বন্ধুর বউ নিয়া মসকরা করা জায়েজ আছে। যাউক গা, কত ট্যাকা লাগবো কও ?”
“গোটা বিশে ট্যাকা হইলে হইবো।”
“কি করবি বিশ ট্যাকা দিয়ে ? কাইল না তুই কইতুরীর জন্নি আলতা, স্নো, পাউডার কিনলি। আইজ আবার ট্যাকা দিয়া কি করবি ?”
“নিজের কিছু কেনন লাগবো।”
চান্দু তার পরনের লুঙ্গির খোঁচার মধ্যে থেকে দশ টাকার দুটো নোট বের করে বলল “এই নে বিশ ট্যাকা। তয় কবের মদ্যি ফেরত দিবি ?”
“হপ্তা খানিকের মদ্যি ফেরত দিমু।”
“দেহিশ এবরা, আমি তোগো বাই বেরাদার হইলেও কিন্তু হুজুর। আমার লগে আউল ফাউল যা খুশী করবার পারোস কিন্তু কতা দিয়া হের বরখেলাপ করিস না, তাইলে আল্লা তোর জিবলা কাইট্টা নিলে তহন আমারে কিছু কইতে পারবিনা।”
“ঠিক আছে।”
এরপর ইব্রাহিম পঞ্চ কিনে তার বাড়িতে গিয়ে গোসল করে বিয়ের জন্য তৈরী হচ্ছে। ইব্রাহিমের বাড়ীর পরিবেশটা একটু অন্য রকম। ছোট একটি টিনের ঘরে থাকত সে। তারই ঘরের পাশেই ছিল একটা মাটি দিয়ে তৈরী কুটির। যে কুটিরে সে হাঁস মুরগী পালত। ইব্রাহিম আবার একটু গেরস্ত প্রেমিক ছিল। মেয়েদের মত রান্না বান্না করা, ঘর লেপা ও কাপড় চোপড় ধোওয়া সব সেই করত। না করেই বা কি করবে এসব কাজ করার জন্য তার আপন কেহ ছিলনা। আজ সন্ধ্যায় তার বিয়ে। কয়েক দিন সে বাড়ী ফিরতে পারবেনা, জেনে পাশের বাড়ীর খালা পরীর মাকে তার প্রিয় হাঁস মুরগীগুলো কিছুদিনের জন্য পালতে দেয়। এবং আসার সময় আমেনা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে দোয়া নিয়ে আসে। নয়া পাঞ্জাবি পাজামা ও মাথায় নামাজের টুপি পরিধান করে ইব্রাহিম চান্দু হুজুরের সাথে পায়ে হেটে রওহনা দিল। গরিবের নিকা বলে লোকজনের সমাগমও খুব কম। চান্দু হুজুর ছাড়া ইব্রাহিমের আর কোন অভিভাবক নেই। দু জনে হাটতে হাটতে কইতুরিদের বাড়ীর সামনে আসা মাত্র চান্দু ইব্রাহিমের উদ্দেশ্যে বলল “এবরা নাকে রুমাল ধর। ঐ যে কইতুরিদের বাড়ী দেখা যায়।”
কইতুরি সাধারণ লাল শাড়ী পরে ঘড়ের মধ্যে চৌকির উপর বসিয়া আছে দু’এক জন বান্ধবীর সঙ্গে। কইতুরীদের ঘরের সামনে ল¤া^া একটা বারান্দা আছে। সে বারন্দায় একটা পাটি বিছিয়ে রাখা ছিল। চান্দু আর ইব্রাহিম যাবার আগেই দলু হাওলাদার আর জিলানী হুজুর ঐ পাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল। ইব্রাহিম চান্দুর সাথে নাকে রুমাল চেপে কইতুরিদের ঘরে উঠে দলুকে সালাম দিয়ে জিলানী হুজুরের পাশে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর কইতুরীর সই জেসমিন ট্র্যাংকটি ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। অন্য আর এক বান্ধবী মেহমানদের জন্য প্রথমে সেমাইও শরবত নিয়ে তাদের সামনে দিল। জিলানী হুজুরও মিষ্টি মুখ করিয়া বিসমিল্লাহ বলে বিবাহের কাজ শুরু করেন। জিলনী হুজুর কইতুরীও ইব্রাহিমকে একে একে তিন বার কবুল বলতে বলে। কইতুরী একটু দেরি করলেও তিনবার কবুল বলেছে আর ইব্রাহিম দেরি না করে তারাতারি করে তিন কবুল পাঠ করল।

মোনাজাত শেষ হতে না হতেই নূপুর গোস্ত পোলাউ নিয়ে হাজির হলেন বরের সামনে। দলুর খাদিম দারিতে সবাই কম বেশি খেলেন কিন্তু হতভাগী কইতুরী ও তার বাবার ভাগ্যে কিছুই জুটলনা। দুটো দেশি মোরকে আর কতটুকো ইবা মাংস হয়। মেহমানরা পেট পুড়ে খেতে খেতেই শেষ। অনেক রাত্র হয়েছে এখন আর রান্না করিবারও সময় নাই। কি আর করা যাবে, দুই বাপ বেটি বিয়ের রাতে না খেয়ে সারা রাত্র উপোস করলো সবার অগোচরে। রাতে খালি এক গ্লাস পানি পান করেও দলু হাওলাদার অনেক খুশী। সে বলে “এ্যক ব্যালা না খাইয়া কষ্ট করলেও আমার কইতুরীর মুখে আমি হাসি দেখছি। এতেই আমার সুখ। এতেই আমার সুখ।”

বাংলাদেশ সময়: ২৩:১৮:২৮   ৬৬৪ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ