আসমার ননদ লিপির ছেলেসন্তান নেই। লিপিকে আসমা নিজেই বলেন, এখন তো টাকা দিলেই ‘বাচ্চা’ মেলে। তার ছেলে হলে তাকে সে লিপির কাছে বিক্রি করে দিতে রাজি। শুধু মুখের কথা নয়, দরদামও হয়ে যায় বাচ্চা গর্ভে থাকতেই। আসমার টাকার বড় টানাটানি। শনিবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসমা সেই কাক্সিক্ষত ছেলেসন্তানটি প্রসব করেন। প্রসবের আগেই তিনি তার বোন সুমিকে জানিয়ে রাখেন, এ বাচ্চা যাবে লিপির কাছে। কত টাকায় বিক্রি করা হয়েছে শিশুটি এ বিষয়ে সুমি তখনও কিছু জানেন না। বাচ্চা হওয়ার পর দুই বোন নবজাতককে লিপির কাছে পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুই বোন ২১২ নম্বর ওয়ার্ডে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে থাকেন। একপর্যায়ে সুমি এ কাজের বিনিময়ে তার বোনের কাছে কিছু টাকা দাবি করেন। আসমা টাকা দিতে রাজিও হন। এরপর রাত নামলে শিশুটিকে নিয়ে বেরিয়ে যান সুমি। রাত সোয়া ১২টার দিকে ১০৬ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত গেলে সুমিকে আটক করেন আনসারের নারী সদস্য নাদিরা আক্তার। এরপরই শুরু হয় তোলপাড়। পুলিশ, আনসার ও ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এবং দুই বোনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
শাহবাগ থানা পুলিশ জানিয়েছে, আসমার বোন সুমিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর পুলিশ হেফাজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আসমা ও তার নবজাতক শিশু। পুলিশ বলছে, শিশু বিক্রির কোনো বিধান নেই। তা ছাড়া গ্রেফতার হওয়ার পর সুমির কথায়ও গরমিল ধরা পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি এর আগেও একই ধরনের অপরাধ করেছেন। তাই তাকে দিয়েই এ কাজ করিয়েছেন আসমা। পরিবারটি নেশাগ্রস্ত বলেও মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাম্প ইনচার্জ পরিদর্শক মোজাম্মেল হক জানান, নবজাতকের মা আসমার স্বামীর নাম জহির হোসেন। তিনি গাজীপুরের টঙ্গী থানার বউবাজার পূর্ব আরিজপুর গ্রামে থাকেন। জহিরও নেশাগ্রস্ত। জানা গেছে, জহিরকে বিয়ে করার আগে আসমার আরও একটি বিয়ে হয়। ওই স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান। পারিবারিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় আসমা তার চার বছরের ছেলে সাহাদতকে নানা আউয়ালের কাছে রেখে আসেন। আরও জানা গেছে, আউয়াল টঙ্গী এলাকার ভিক্ষুকদের নেতা। নিজে ভিক্ষাবৃত্তির পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের ভিক্ষুক রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে কমিশন নিয়ে থাকেন।
সুমি আক্তার স্বীকার করেছেন, বোনের সঙ্গে পরামর্শের পর তিনি বাচ্চাটি নিয়ে ওয়ার্ড থেকে বের হন। এর কিছুক্ষণ পরই আনসারের একজন নারী সদস্য তাকে ধরে ফেলেন। আনসার সদস্য নাদিরা আক্তার জানান, বাচ্চা বিক্রি নিয়ে কানাঘুষা তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তারপর থেকেই দুই বোনের ওপর তিনি নজর রাখেন। একপর্যায়ে সুমি বাচ্চাটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দ্রুত তাকে আটকে দেন।
সুমি আক্তার স্বীকার করেন, আসমার ননদের কোনো ছেলেসন্তান নেই। তাই তার কাছে শিশুটি বিক্রির জন্য আসমা নিজেই কথা বলেন। বিষয়টি তিনি পরে জেনেছেন। শনিবার রাতে শিশুটিকে লিপির কাছে পৌঁছে দিতে তিনি ৫ হাজার টাকায় রাজি হন। বাচ্চাটির বিনিময়ে ৩০ হাজার টাকা দেয়ার কথা থাকলেও অস্ত্রোপচারের আগে লিপি আসমার হাতে ৫ হাজার টাকা তুলে দেন। সুমি স্বীকার করেন, নবজাতককে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি লিপির সঙ্গেও কথা বলেন। লিপি আরিজপুরেই থাকেন।
সুমি ও আসমার বাবা আউয়াল জানান, তিনি নবজাতক বিক্রির বিষয়ে আগে জানতেন না। পরে জেনেছেন লিপি একটি বাচ্চা চেয়েছিল, তাই তাকে দেয়ার জন্য সুমি হাসপাতাল থেকে বের হতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
আসমা জানান, বাচ্চাটি তিনি লিপিকেই দিতেন। তবে কত টাকার বিনিময়ে তাকে দেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে তিনি অসংলগ্ন তথ্য দেন। কখনও ১৫ হাজার, কখনও ৩০ হাজার টাকার কথা বলেন। তবে আসমা নিজেই জানিয়েছেন, বাচ্চা গর্ভে থাকা অবস্থায় বিক্রির কথা হয়েছে। তিনি জানান, সংসারে অভাব-অনটন থাকায় বাচ্চা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, লিপি আক্তারকেও এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারা সিন্ডিকেটের সদস্য কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেলে ফের নবজাতক কেলেংকারির বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার পরপরই নবজাতকের মা ও খালাকে প্রথমে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। পরে অসুস্থতার কারণে শিশুটির মা আসমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ব্যাপারে থানায় মামলা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেলে নবজাতক চুরি বা আপসে বিক্রি করার মতো ঘটনা পুরনো। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিককেন্দ্রিক শিশুচোর সিন্ডিকেট এ কাজে সক্রিয় থাকে। এ চক্রের সদস্যরা বাচ্চা প্রসব হওয়ার আগেই খবর রাখে। গত আগস্টে ঢাকা মেডিকেলে গৃহবধূ রুনা আক্তারের যমজ বাচ্চার একটি চুরি হয়ে যায়। ওই ঘটনায় র্যাব জীবিত অবস্থায় বাচ্চাটিকে গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সেই বাচ্চাটিও বিক্রি হয়েছিল, তবে চুরির পর।
গত আগস্টেই ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে নবজাতক বিক্রির ঘটনা ঘটেছিল রাজধানীর ওয়ারী এলাকায়। নীলা হোসেন ও নূর হোসেন দম্পতি অভাবের তাড়নায় নিঃসন্তান পলি বেগমের কাছে তাদের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়। ওই ঘটনায় শিশুটির বাবা-মা ও ক্রেতাকে গ্রেফতার করে ওয়ারী থানা পুলিশ।
বাংলাদেশ সময়: ০:৪১:৩৩ ৩৮৯ বার পঠিত