সুখ-কাটা–আল রিআন

Home Page » সাহিত্য » সুখ-কাটা–আল রিআন
রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০১৪



untvvvvvigfgtledthumbnailjpg.png

সপ্তম পর্ব শুরু………………পল্লীর মানুষগুলোকে সাধারণ দৃষ্টিতে বিচার করলে তারা সহজ সরল হিসাবে বিবেচিত হবে। তাদের সহজ সরলের মূল বিষয় গুলোর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল বোকামি। বাস্তব হতে তারা অনেক দূরে রয়েছে। পল্লীর শহর গুলোতে যে ভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া পড়েছে তা পল্লী অবধি এখনো পৌঁছায়নি। অতি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করে পল্লীর মানুষ জন। তেমন একজন মানুষ হল কুদ্দুস। পেশা ফকির মানে ভিক্ষুক। গ্রামে হেটে হেটে ভিক্ষা করে সে। শ’খানেক জোড়া তালি দেওয়া পাঞ্জাবির মত একটা র্কোতা পরে ভিক্ষা করে সে। হিন্দু পাড়ার পরে অন্য এক গ্রামে বাস করে। ছোট্ট একটা ভাংগা ঘরে থাকে। তার পরিবার বলতে আছে এক অন্ধ স্ত্রী গোলেআরা বানু। সকাল সন্ধ্যা ভিক্ষা করে দু থেকে তিন সেরের মত চাল পায় তাতেই তাদের দুজনা বেশ চলে যায়। মাঝে মধ্যে আবার কেহ কেহ মানতের মুরগি ডিম ও অনান্য কিছু দেয়। ইনকাম খারাপ নয় ভিক্ষায় ভালই রুজি হয়। কুদ্দুস ফকির হলেও বেশ দাপট নিয়ে চলে। অল্প কথাতেই তার মেজাজ চটে যায়। সারাদিন ভিক্ষা করে বাড়ি ফিরলে তার স্ত্রী ভয়ে তার সাথে কথা বলেনা। উল্টা পাল্টা কিছু বললে আর রেহাই নেই, গোলেআরা বানুর। হাতের কাছে যা পাবে তা দিয়েই কুদ্দুস ফকির মার শুরু করবে। বৌ মারা তার একটা নিত্য দিনের অভ্যাস। কোন দোস না থাকলেও সে দোস তৈরী করে বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে মারামারি আরম্ভ করবে। মারতে মারতে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় গালি দিয়ে বলবে “এই মাগি খালি আন্ডা ভাইজ্জা দিছো ক্যা। ঘরে আর কোনো সালুন নাই। তুই জানোনা আমি আনডা ভাজা খাইতে পারিনা গলায় আটকায়।”
“ঘরে আছিলোই এ্যকটা আন্ডা। মুরগায় কয়দিন ধইরা আন্ডা পারেনা। আমি না খাইয়া আফনেরে ভাইজ্জা দিছি।”
“আন্ড না ভাইজ্জা ঝোল রানবি। হারা দিন রৌদে রৌদে খয়রাত কইরা বাড়ী আইয়া এই হুগনা আন্ডা ভাজা দিয়া ভাত খাওন যায়! এই নে তোর আন্ডার সালুন তুই খা। জন্মের মতো খা, মাগি।”
কুদ্দুস ভাতের প্লেট ছুড়ে দিয়ে চলে যায় বাহিরে।
কুদ্দুস ফকিরের স্বভাবই এই রকম। যাদের বাড়িতে ভিক্ষা করিতে যায় তারা কোন কারণে ভিক্ষা না দিলেও সে গেরস্তদের সাথে রাগারাগি করে। সে রাগারাগি চিৎকার চেচামেচির মধ্যে গেরস্তকে বুঝিয়ে দেয় দান খয়রাত কিংবা ভিক্ষা না দিলে পাপ হয়। পল্লীর সব গেরস্তরাই কুদ্দুস ফকিরকে চিনে। তবুও অনেক গেরস্ত মাঝে মধ্যে বলে “মাফ করেন এহন ভিক্ষা দিতে পারমু না।”
তখন কুদ্দুস ফকিরও বলে “খয়রাত দিবেন না ক্যআ। ঘরে চাউল নাই। না থাকলে কন।”
“হ, ঘরে চাউল নাই অইছে। এবার যা।”
“চাউল নাই তয় কি অইছে। আফনেরা গেরস্ত মানু, একটা না থাকলে আর একটা দ্যন। তবুও দ্যান আল্লায় কইছে খয়রাতিরে খয়রাত না দিলে ঘরে ঠাডা পরবো। আমার ঘরে আবার কয়দিন ধইরা কউরার (সরিষার) ত্যাল নাই। রাইতে মাতায় একটু কউরার ত্যাল দিলে ঘুমডা ভালা অয়। একটা ভাংগা শিশিতে একটু কউরার ত্যাল দেন। আমি আবার গত শুক্কুর বার হাডে যাইতে পারি নাই।”
কুদ্দুস ফকিরের বকবকানি আর বেহায়য়াপনা দেখিয়া বাড়ির মানুষ যখন রাগ করে তারাতারি চলে যেতে বলে তখন কুদ্দুস ফকির চোখ গুলোকে বড় বড় পাকিয়ে বলে “শ্যাষ ম্যাষ খয়রাত দিবিনা। এতক্ষুণ কি খামাকা বুঝাইলাম ?
তখন হাতের ঝোলা রেখে দু হাত তুলে মোনাজাত ধরে বলে “ও আল্লাগো হেরা আমারে খয়রাত দ্যায় নাই। খালি আতে ফিরাইয়া দিছে। তুমি এগো মাফ কইরনা। তাগো ঘরে তুমি এত্ত বড় একটা ঠাডা ফালাও। হেরাও যেন আমার মতো খয়রাতি অইয়া রাস্তায় রাস্তায় খয়রাত করে। আমিন।”
তার অভিশাপের মত কথাগুলোতে বাড়ির মানুষ যখন ক্ষেপে উঠে কুদ্দুসকে মারতে আসে তখনও কুদ্দুস জোর গলায় বলে “এ মারতে আইছে। ঘরে চাউল নাই, ত্যাল নাই। (আরো জোরে)। এই মারলে ওষুধ কেনার ট্যাকা দিবি কোথাইদ্দা।”
সামান্য এক ফকিরের মুখে এত বড় কথা শুনে কোন গেরস্ত আর বসে থাকেনা কষে এক চড় বসিয়ে দেয় কুদ্দুসের গালে। চড় খেয়েও কুদ্দুস থামেনা। গেরস্তদের পাল্টা জবাব দেয় কথা দিয়ে। এক হাত দিয়ে গাল ঘসতে ঘসতে বলে “পারলে আর এ্যকটা থাপ্পর দে দেহি।”
মানুষ তাকে যতই মারবে সে ততই বলবে পারলে আর একটা দে দেখি। একদিন এমন করে মার খেতে খেতে বলল “পারলে আর এ্যকটা থাপ্পর দে দেহি।”
একটা করতে করতে আট দশটা থাপ্পর খেয়ে কুদ্দুসের আর সহ্য হচ্ছিলনা। সে তার হাতের ভাংগা ফুটো বহু পুরাতন ছাতা দিয়ে ছাতা দিয়ে ঐ ব্যাক্তি কে একটা মাথার উপড়ে আঘাত করলো। যদিও লোকটি ব্যথা পায়নি তবুও ও মা আমার মাতা ফাইট্টা গ্যাছে বলে আওয়াজ করলো।
ছাতা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। কুদুস ফকির ভাবল ছাতার আঘাতে বুঝি এই গেরস্ত আর বাঁচবেনা। তখন কুদ্দুস ফকির তার ভিক্ষা করা চালের ক্ষুতি ও দুটো মুরগির বাচ্চা ফেলে দিয়ে, দিল এক ভোঁ দৌড়। দৌড় তো দৌড় ডানে বামে কোন দিকই আর তাকালোনা। গোলেআরা বানু মাটিতে বসে বসে কাদা মাটি দিয়ে তার ঘরের পিড়া লিপছে। সে অন্ধ মানুষ কোন দিকে তার কোন খেয়াল নেই। এমনি সময় কুদ্দুস ফকির দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির সামনে এসে গোলেআরার পিঠের উপড় হুমরি খেয়ে পড়লে কাদা পানি গোলেআরার নাক মুখে ছিটে ভিজে গেল। গোলেআরা তখন ও বাবাগো বলে চিৎকার দিয়ে বলল “কোন হারামির বাচ্চায় আমার গায়ের উপার মরতে আইছে। তোগো কি ঝোলায়ও নেয় না। আমার বাড়ির সামনে সব মরণ তান্না আইয়া পরে। মরলে দূরে গিয়া মর।”
কুদ্দুস ফকির কাদার মধ্যে বসে পা দুখানা সামনের দিকে মেলে বড় বড় চোখ করে বৌয়ের গালি শুনছে।
এর মধ্যে গোলেআরা আবার কাদা নিয়ে তার স্বামীর মুখের উপড় লিপতে আরম্ভ করল আর গালা গাল দিতেই আছে। কুদ্দুস ফকির তখনও চুপচাপ। একটু পরে গোলেআরা হাতে পায়ে কাদা নিয়ে মাজায় এক হাত চাপিয়া ধরে উঠে বলল “মোনে অইলো এই দুফারে আমার মাতার উফরে একটা ঠাডা পরলো।”
গোলেআরা অন্ধ বলিয়া দেখিতে পেলনা কে তাহার গায়ের উপড় হুমড়ি খেয়ে পরলো। সে ধারনা করেছিল ছেলে মেয়েরা ছোটাছুটি খেলতে গিয়ে তার গায়ের উপড় পরেছে। কুদ্দুস এখনও মাটিতে ওমন করে বসে আছে। গোলেআরার গালি দেওয়া শেষ হলে সে বলে “কি থামলি ক্যআ। আরকোন ক্ষামার জানো না মাগি।”
গোলেআরা এতক্ষণ পর বুঝলো তার স্বামীই তার গায়ের উপড় এত জোড়ে পরেছে। তখন সে তার জিহব্বায় কামর কেটে বলল “আফনে আইছেন। আমি বুঝিনাই। এত তরাতরি আফনে তো কোন দিন আয়েন নাই। কি অইছে আফনার, হাপাই তেছেন ক্যআ। কেউ আফনারে মারছে।”
“চোপ মাগি, আমারে আবার মরবো কেডা। অত সাহস কার আছে। আমিই আইজ এক হালারে ইচ্ছা মত মারছি। আমার লগে বাহাদুরি। ভিক্ষা করি দেইখা কি পইচ্চা গেছি।”
“কারে মারছেন। হাছা কইতাছেন নাকি আমার লগে মসকরা করতাছেন। কোন দিন হুনিনাই আফনে কোন মানষেরে মারছেন।”
“কি কইলি আমি তোর লগে মসকরা করমু ক্যআ তুই কি আমার বেয়াইন লাগোছ। আমার লগে ফাইজলামি করছিল আর মেজাজ টাও গরম হইয়া গেছিল হাতের ছাতি দিয়া পিডাইয়া মাতা তিন ভাগ কইরা দিছি। বহুত বার আমার আত পায় ধরছিল আমি হুনিনাই। দ্যাহনা খয়রাত করা চাউল হেগো দিআই ছি।”
“কি কও তুমি ? হেরা বড়লোক মানু। যদি তোমার নামে মামলা করে। ও আল্লাগো তুমি হাজোত গেলে আমি দেহি না খাইয়া মরমু।”
বৌয়ের মুখে মামলার কথা শুনে কুদ্দুসের বড় বড় কথার অবসান ঘটল। প্রচন্ড ভয়ে কুদ্দুস তার বৌকে বলল “বৌ এহন কি অইবো। আমি তো রাগের মাতায় মারামারি করছি। যে জোরে মাতায় বাড়ি মারছি মরলেও মরতে পারে। হুনছি মাডার কেছে নাকি ফাঁসি অয়।”
“হ আমিও এমন হুনছি। তুমি পলাইয়া পলাইয়া থাহো কয়ডা দিন। দারোগা আইলে আমি কমু আমার ভাতারে কলেরায় মইরা গ্যাছে। তোমার ফাঁসি অইলে আমি দেহি এতিম অইয়া যামু।”
“থাম থাম কাইন্দ না।”
“হুন যে গেরামে মার্ডার করছো ঐ গেরামের আশে পাশেও যাবানা। ভিন গেরামে গিয়া খয়রাত করো। আর চোক কান সব খোলা রাখবা দারোগা পুলিশ দ্যখলে পলাইয়া থাকবা।”
“বউ আমি তোমার খালি খালি মারি, তুমি আসলেই ভালা।”
এখন অগ্রহায়ণ মাস চলিতেছে। কৃষকদের সবুজ মাঠের ধানগুলো আর সবুজ নাই। ধান পেকে সোনালী রং ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে অনেকে ধানকাটা আরম্ভ করেছে। আর যারা এখনও ধান কাটা আরম্ভ করেনি তারা দু চার দিনের মধ্যে আরম্ভ করবে। কারণ তাদের ধানগুলো পুরোপুরি পেকে আসেনি। কৃষকদের এবার ধানের ফলন খুব ভাল হয়েছে তাই তাদের মনটাও বেশ ভাল। আবুল বাবুল মানিক ট্যাপা ও লুইচ্চা সবাই এক হয়ে আজ ধান কাটছে। কাস্তে দিয়ে ধান কেটে এক জায়গায় জমা করে এবং আট দশটা ধান গাছ একত্র করে গিরু দিয়ে রশি তৈরী করে। সে রশি দিয়ে অনেকগুলো ধান গাছ একত্রে বেধে একটি আঁটি তৈরী করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধান কেটে আঁটি তৈরী করে আর সেই আঁিট আবার মাথায় করে বাড়িতে রেখে যায়। অগ্রহায়ণ মাসে বাড়ীর উঠান ধানের আঁটিতে ভরে উঠে। হাটিবার মত খালি জায়গা থাকেনা। এক বিঘার ধান বাড়ীতে আনতে বিশ থেকে পঁচিশ দিনের মত সময় লাগে। এই সময়গুলোতে কৃষকদের এক পর্যায়ে নিশ্বাঃস ফেলবার মত সময়ও থাকেনা। যতক্ষণে নিশ্বাঃস নিবে ততক্ষণে এক আঁটি ধান কেটে ঘরে তুলবে। পাকা ধান নিয়ে যত চিন্তা কৃষকদের। পাকা ধান চোরে নেবার ভয় বেশি থাকে। এইজন্য অনেক কৃষক রাতের বেলাতে ক্ষেতের মধ্যে ছোট কুড়ো ঘর তুলে পাহাড়া দেয়। ধান পেকে আসলে কৃষকদের রাত দিন দুই ব্যস্ত থাকতে হয়। কৃষকদের বউদের বেলাতেও একই অবস্থা। অগ্রহায়ণ মাস আসিবার আগেই বাড়ীর বউরা বাড়ীর উঠানটি ঘষে মেঝে গোবর দিয়ে লেপে একদম সমান করে রাখে। প্রত্যেক বাড়ির উঠান তৈরী করতে বাড়ীর ঝি বউদের রাতেও কাজ করতে হয়। উঁচু নিচু আঁকা বাঁকা উঠানটিকে প্রথমে তাল গাছের কড়াতের মত ধাঁড়ালো ডগা এক ফুটের মাপে কেটে উঠানটিকে ভাল ভাবে আশ্রিয়ে সমান করে মুগুড় দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে আরো সমান করে দু তিন বার গোবর মাটি দিয়ে লেপে পাকা মেঝের মত একটি উঠান তৈরী করে। উঠানে ধান শুকাবে বলেই এত আয়োজন। উঠান না তৈরী হওয়া পর্যন্ত কারো কোন ছুটি নাই। পরী ও তার মা দুজনে মিলে বাড়ীর উঠান তৈরী করছে। তবে এসব ব্যপারে পরীর হাত খুব চালু। ছোট বেলা হতে গেরস্তদের কাজ করে করে পাকা হয়ে উঠেছে সে। গ্রাম-গঞ্জে ধান ভাংগার জন্য কোন কলের মেশিন নাই। আঁটিতে বাধা ধানগুলো পুরো উঠান জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে তার উপড় কয়েকটা বলদ গরুকে অনেক বার হাঁটাতে থাকে। গরুর পায়ের আঘাতে ধান গাছ থেকে ধানগুলো আলাদা হয়ে মাটিতে পরে থাকে। এবং ধান গাছগুলো আলাদা করে রাখে শুকানোর জন্য। ক্ষেতের ধান কাটা শেষ হলেই মলাই আরম্ভ করবে। মানিক কাজ করতে করতে যখন খুব ক্লান্ত হয়ে পরে তখন তার ভাবিকে বলে “ভাবি জোলদি জল নিয়া আও, তৃষœায় গলা আমার ফাইট্টা যাইতাছে।”
মানিক তার ভাইদের বাড়ীতে কাজের লোকের মত কাজ করে। তার বড় দু ভাইয়ের তুলনায় সে অনেক বেশি কাজ করে। বেশি কাজ না করলে যে ভাগে কম পাবে। ধান চালের ভাগ একটু বেশি পাবার আশায় লুইচ্চা ট্যাপার মত খাটুনি খাটতে হয় মানিকের। মানিকের মত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাটতে খাটতে হালের গরুগুলো যখন ধানের উপড় আর হাটতে চায়না তখন গোয়ালে বেধে রেখে রাতের বেলা বাড়ীর লোকজন ঝি বউয়েরা একত্রে নামে কাজ করার জন্য। দু হাত দিয়ে কতগুলো ধানগাছ নিয়ে এক স্থানে রেখে হাতে একটা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ধান গাছগুলোর উপরে দাঁড়িয়ে দু পা দিয়ে মলিতে থাকে। ধান গাছগুলোকে অনেক শক্তি দিয়া মলিতে হয়, না হলে গাছ হতে ধান ঝড়িয়া পরেনা। এক কথায় বলা চলে গরুর কাজগুলো অবশেষে বাড়ীর গেরস্তদের করতে হয়। পা দিয়ে ধান মলতে গেলে, ধান গাছের ধাঁড়ালো পাতার ঘর্ষণে পায়ের পাতায় ক্ষত অনেক দাগ হয়।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষকেরাও সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এমন এক সময় আসে যখন কৃষকদের ধানগুলো সব মলা হয়ে যায়। গ্রামের অনেক মহিলারা ঐ সময়টা ধানের বিনিময়ে মুড়ি বিক্রি করে। নতুন ধানের সুস্বদু মুড়ি ভাজা হয় মাটির হাড়িতে। কৃষকদের ছেলেমেয়েরা এক পুরা ধান দিয়ে এক পুরা মুড়ি কিনে আনে। গাছ থেকে ধানগুলো আলাদা করে সব জমা রাখা হয় উঠনে, সেখান থেকে সাজী হিসাব করে মেপে গোলায় ভরে কৃষকরা। তবে গোলায় ভরার আগে অনেক ধান চুরি হয়ে যায়। তবে সে চোর বাহিরের কেহ নয়। কাজের লোক থেকে শুরু করে বাড়ীর বউ পর্যন্ত ধান চুরি করে। ধান মাপিয়া গোলায় রাখিবার আগে অনেক বাড়ীর বউরা তা চুরি করে অন্য গেরস্তদের বাড়ীতে অল্প দামে বিক্রি করে। নিজের ধান চুরি করে অল্প দামে বিক্রি করে যা টাকা পায় তাদিয়ে তার লেইস ফিতা চুড়ি টিপ ইত্যাদি সাজ সজ্জার সামগ্রী কিনে থাকে। এসব ছোট খাটো বিষয়ে আবার বাড়ীর কর্তারা খেয়াল রাখেনা। বাড়ীর কাজের লোকেরা সুযোগ পেলে মালিকের ধান চুরি করে। এই চুরি টুকোই তাদের লাভ।
ট্যাপা তার সহযোগি লুইচ্চাকে বলল “লুইচ্চা এক কাম করি।”
“কাম তো করতাছি। আবার কি কাম করমু।”
“বাড়ীতে কেউ নাই। আমরা এই সুযোগে দুই জনে কয়েক সাজী ধান চুরি করি। ব্যন হইতে তো ম্যালা কাম করলাম। এবার একটু আকাম করি ।”
“কি কও, কেউ দ্যখলে ?”
“আরে কেডা দেখবো, মানিক কাক্কু বাবুল কাক্কু সবাই সবার কামে ব্যস্তো।”
“হাছাই করবি? কয় চুইন্না (সাজি) ধান সরাবি কতো ?”
“বিশ বাইশ চুইন্নার মতো। কয়দিন বাদে তো আমরা নিজেগো বাড়ীতে ফিরমু। কাম শ্যাসে আর কয় ট্যাকাই আমাগো দিবো। নিজের ছোড বাইরেই দেয় না ঠিক মতোন। মানিক কাক্কু কি কো কাম করে, হের পরো তারে ভাগে কম দিবো। আমরা চুরি কইরা যা পামু তা দিয়া আমি আমার বউর জন্নি একটা রাঙা পাইরের কাপুড় কিনমু। বিয়া করার পর বউরে কিছুই কিইন্না দিতে পারি নাই।”
“কি কও বাইশ চুইন্না ধান মাইনে এক মোন ধান চুরি করবি।”
“ডঢ়ের কিচ্ছু নাই। তুই খালি আমার লগে থাক।”
ট্যাপা আর লুইচ্চার মত অনেক বাড়ীতে কাজের লোকেরা মালিকের ধান চুরি করে। অভাব অনটনের কারণেই মানুষ এমন নিচু কাজ করতেও দ্বিধা বোধ করে না। ধান মেপে গোলা ভরা না পর্যন্ত কৃষকদের কোন শান্তি নেই। সকল ধান মাপা হলে কৃষকেরা বুঝতে পারবে তাদের বাকী মাস গুলো কেমন সচ্ছলতায় কাটবে। কৃষকেরা যত ধান চাষ করবে তার মধ্যে আসল হল আমন ধানের চাষ। এই ধানের ফলনের উপর নির্ভর করবে একটি কৃষক পরিবার। সারা বছরের খাবার, সংসার খরচ এই ধান বিক্রির টাকাতেই করতে হবে। বাড়ীতে যারা ঠিকাদার কাজ করেছে তাদেরকেও মণ তিন চার ধান ও নগদ কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করতে হবে। আবার কিছু ধান রেখে বাকী সব ধান সিদ্ধ করে চাল ভাঙ্গিয়ে রাখবে সারা বছরে খাবার জন্য। অর্থাৎ একজন কৃষককে আমন ধান বিক্রির টাকা দিয়ে পুরো এক বছর চলতে হয়। পুরো বছর বলতে বছরে দু’টো বড় বড় ঈদ, ডাক্তারি খরচ, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, পরিবারের সদ্যসদ্যের জামা কাপড় সহ অন্নান্য খরচ, ধার দেনা পরিশোধ করা, বছরের একটি মেলা পহেলা বৈশাখ ও কুটুম এলে আপ্যায়ণ। ধান বিক্রির প্রথম চার পাঁচ মাস বেশ সচ্ছলতার মধ্যেই কাটে কিন্তু এর পরের মাসগুলোতে শুরু হয় অভাব অনটন। কৃষকদের মনে এখন অনেক স্বপ্ন। কিছুদিনের মধ্যে ধান বিক্রি করবে নগদ কিছু টাকাও পাবে হাতে। এরপর আসবে রসের মাস। ধান বিক্রি করে গোলায় জমা করে যখন তাদের একটু কাজের চাপ কমবে তখনি খেজুর গাছ কাটার জন্য দাঁয়ে সাণ তুলে প্রস্তুত থাকবে। পৌস মাস হলে গাছে রস আসতে আরম্ভ করবে। খেজুর গাছ কাটার জন্য তাদের আলাদা সরঞ্জাম থাকে। যার ভাগে যে কয়টা খেজুর গাছ আছে সে সেই কয়টা গাছের রস পাবে। মানিকের ভাগে পরেছে ছ’টা গাছ। সে আগে থাকতেই তার গাছ গুলো কেটে রস পাবার উপযোগী করে রেখেছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে খেজুর গাছগুলোর মাথা কেটে ছেটে পরিস্কার করে রাখে। বাঁশের কঞ্চি কেটে খেজুর গাছের সাথে পুতে দেয় যা দিয়ে রাতের বেলা গাছ থেকে রস বেয়ে পড়ে হাঁড়ির মধ্যে। সামনের হাট বারে হিন্দুরাই বেশি দোকান পেতে বসবে। এখন হিন্দুদের মধ্যে কুমারদের ব্যস্ততা খুব বেশি। দিন রাত প্রায় সারাদিন তাদের মাটির হাড়ি বানানোর কাজ চলছে। কিছুদিন পরেই আসবে রসের মৌসুম। সারা গ্রামে হাড়ি কেনার ধুম পরে যাবে। যাদের খেজুর গাছ আছে তারা প্রত্যেকে দশÑবার টা করে হাঁড়ি কিনবে। কৃষকদের এখন কতযে কাজের চাপ তাহার কোন হিসাব নেই। কৃষকদের বউরা বাড়ীতে বসে বড় বড় ডিংগীতে ধান সিদ্ধ করে। একটা ডিংগীতে কম হলেও চার-পাঁচ মণ ধান ধরবে এমন বড় ডিংগী। চার পাশে ইট সাজিয়ে অল্প কিচু উঁচু করে তার উপর ডিংগীটা বসিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধান সিদ্ধ করবে। ধান কিছুটা সিদ্ধ হয়ে এলে ছালার চট ভিজিয়ে ধানের উপড় দিয়ে দিলে ধানের গায়ে আগুনের তাপটা ভাল ভাবে লাগে। এভাবে ডিংগীর পর ডিংগি ধান সিদ্ধ করে উঠানে ঢেলে রেখে আবার ডিংগীতে ধান চাপিয়ে দিবে। উঠানের ধানগুলো রোদে শুকাতে থাকবে আর ডিংগীতে ধান সিদ্ধ হতে থাকবে। ঘরের বউদের এই নিয়েই কয়েকটা দিন অতি ব্যস্ত থাকতে হয়। এমনকি তারা ঘরের রান্না বান্নার কাজেও সময় দিতে পারেনা। সারাটা দিনই কেটে যায় এই ধান সিদ্ধ নিয়ে। ধান সিদ্ধের জন্য বড় বড় গাছের গুড়ি দিতে হয় ডিংগীর নিচে। দাউ দাউ করে আগুন না জ্বললে ধান সিদ্ধ হয়না। আগুনের তাপে রোদের তাপে সুন্দর সুন্দর বউগুলো আধা কালো হয়ে যায়। তারপর আবার রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ধান নাড়তে হয়। উঠানের মধ্যে ছড়ানো ধানগুলেকে পা দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর নেড়ে দিতে হয়। এতে সিদ্ধ ধানের গায়ে রোদের তাপ এমন ভাবে লাগে যেন ধান গুলো থেকে গন্ধ না আসে। যতদিন ধান শুকানোর কাজ চলে ততদিন কৃষক পরিবারের কেহ একত্রে তো খাবে ই না বরং তেমন ভাল কোন রান্নাও করবেন না। কোন রকম ভাত রান্না করে আলু ভর্তা, শুকনো পোরা মরিচ ইত্যাদি দিয়ে খাবার খাবে ঐসব কৃষক পরিবার। কারণ যারা রান্না করবে তারাই তো ধান সিদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত। বাড়ীর পুরুষেরা আবার এসব কাজে কোন ভূমিকা পালন করেনা। তারা এখন ধান বিক্রির কাজে ও কাটা ধানগাছের গোড়া তুলতে অতি ব্যস্ত। মাঘ মাসের মধ্যেই ক্ষেতকে চাষাবাদের জন্য উপযোগি করে তুলতে হবে। মাঘ-ফাল্গুন মাসের মধ্যে ইরি,রোর ধানের বীজ ফেলতে হবে। বৈশাখ মাসের মধ্যেই আবার কৃষকেরা এই ধান ঘরে তুলতে পারবে। একই জমিতে দু তিন বার ধান চাষ করলে জমির ফলন ক্ষমতা অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়। সার প্রয়োগ করলেও ততটা ভাল ফল আশা করা যায় না। কৃষকদের চাষাবাদের জন্য র্নিদিষ্ট জমি ছাড়া আর কোন অতিরিক্ত জমি না থাকায় একই জমিতে অনেক ফসল ফলাতে হয়। মরা মাটিতে ফসল ফলানো কিন্তু খুব একটি সহজ কথা নয়। তবুও বাংলার কৃষকেরা ভয় পায় না। সামনে তাদের এগিয়ে যেতে হবেই। মরা মাটির বক্ষ চিড়িয়া সোনার ফসল ধান ফলাতেই হবে।

আমেনা বেগম তার মেয়ে পরীর বিয়ের জন্য উঠিয়া পড়িয়া লেগেছেন। পরীকে এ পরিবার হতে বিদায় করতে পারলেই যেন সে বেঁচে যায়। কেবলি সত্ মেয়ে পরীর জন্য আমেনা বেগম মা হতে পারছেন না। পরী শত হলেও পরের সন্তান। মা বলিয়া যতই ডাকুক না কেন, তবুও সে অন্যের সন্তান। আমেনা বেগন পরীর জন্য উচ্চ বংশীয় কিংবা চরিত্রবান কোন পাত্র খুঁজছে না। তবে টাকাওয়ালা গেরস্ত পরিবারের পাত্র খুঁজছেন। অর্থ সম্পদওয়ালা ছেলের হাতে পরীকে তুলে দিতে পারলে পরী অন্তত বাবার বাড়ীর সম্পদে ভাগ বসাতে আসবেনা অর্থাৎ কম যৌতুকে মেয়েকে পরের বাড়ী পার করতে পারা। সত্ মায়ের জন্যই পরী শিক্ষার আলো হতে অনেক দূরে। আমেনা বেগম ইদানিং পরীর বেপরোয়াটা একটু বেশি লক্ষ্য রাখছেন। পরী সারাদিন কেমন যেন উদাসি হয়ে থাকে। নাওয়া খাওয়ার প্রতি তার কোন খেয়াল নেই। তাকে মনে হয় প্রেম নামক ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত করে ফেলেছে। এই রোগটি আবার ছোঁয়াছে। ষোল থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত সাবধাণে না থাকলে এই প্রেম নামক ক্যান্সার রোগ হতে পারে যে কারো। আমেনা বেগম পরীর মধ্যে এই রোগেরই আশঙ্কা করছে খুব বেশি।

পরীর মা পাশের গ্রামের ঘটক তোতা মিয়াকে সংবাদ পাঠিয়েছে। তোতা মিয়া তিন চার গাঁয়ের মধ্যে নাম করা ঘটক। ঘটকালি তাদের বংশ গত পেশা। তোতা মিয়া ইদনিং মানিকের জন্যও পাত্রীর সন্ধান করছে। মানিকের মা মানিকের জন্য অনেক আগেই পাত্রী খোঁজ করার দায়িত্বটা, তোতা মিয়াকে দিয়েছে। মানিকÑপরীর সর্ম্পকের কথা উভয় পক্ষের কোন পরিবারই জানেনা। আর জানলেও এ সর্ম্পকটি স্থায়ী হয়ে উঠবে কিনা তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সুতরাং মানিক-পরির প্রেমটা বাঁচিয়ে রাখতে হলে ওদের একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ পৃথিবীতে সকল সর্ম্পক গড়ে উঠে আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করিয়া। পৃথিবীতে প্রেম ভালবাসার চেয়ে অর্থের জোড় বেশি হবার কারণে অর্থের কাছে সকল প্রেম ভালবাসা নত স্বীকার করে।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫০:০৫   ৮৯৩ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ