Home Page » সাহিত্য »
শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০১৪



untvvvvvigfgtledthumbnailjpg.png

ষষ্ঠ পর্ব শুরু——জলমিয়ার পেশা চুরি নয়। সে মানুষের ক্ষেতে রোজ হিসাবেও কাজ করে। তবে চোখের সামনে কাছে ভাল মন্দ যাহাই পড়-ক না কেন তখন আর রক্ষে নাই। সেটা সে চুরি করবেই। সরকারী খাস জমিতে একটু খানিক কুড়ে ঘর তুলে থাকে সে। জলমিয়ার কালো বেটে ও অশিক্ষিত হলেও কিন্তুু তার বিয়ের জন্য মেয়ের অভাব পড়েনি। জলমিয়া তার বাইশ তেইশ বছর বয়সে এ যাবৎ চার চারটা বিয়ে করেছে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় সর্বোচ্চ ৮/৯ মাসের বেশি কোন স্ত্রী তার সংসার করতে পারেনি। জলমিয়া তার বৌদের এমন মার মারে যে শেষে জীবন নিয়ে পালাতে হয়। বিয়ের পর জলমিয়া আর কাজ কর্ম কিছুই করেনা। বৌকে পাঠিয়ে দিবে মানুষের বাড়ীতে ঝিঁ এর কাজ করানোর জন্য। গ্রাম বাড়ীতে ঝিঁয়েদের বেতন দেবার কোন রেওয়াজ নেই। বাড়ীর গেরস্তরা প্রতিদিন কাজ শেষে কাঁসার থালা ভরে ভাত তরকারি দিয়ে দেয়। সে ভাত তরকারি দিয়েই জলমিয়ার আর তার বৌ এর বেশ চলে যায়। তার চার নাম্বার বৌ সখিনা চলে গেল এই তো মাস চারেক হবে। তাই তো জলমিয়ার পেটে আর ভাত জুটেনা। এর গাছের কলা আর ওর কুটির মুরগি চুরি করেই দু বেলা দু মুঠো খেয়ে কোন মতে বেঁচে আছে। গ্রামে এত ক্ষেত খামারে কাজ হচ্ছে কিন্তু জলমিয়াকে কেহই কাজে নিচ্ছেনা। এর মূল কারণ কিন্তুু তার হাতের দোষ নয়, সে তিন চার জন তাগরা জোয়ানের ভাত একাই খায়। সে ইদানিং নয়া নিকার জন্য গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের বিরক্ত করে বেড়ায়। মেয়েরা পুকুড় ঘাটে গোসল করতে গেলে আড়াল থেকে উকিঁ ঝুকি দেয় কিংবা মেয়েদের বলে “ও আল্লা তোমার দেহি নিকার বয়স শ্যাস অইয়া যাইতাছে এহনো নিকা করনা ক্যা? নাকি নিকার লাইগা উপযুক্ত পাত্র পাওনা। আসে পাশে ভালা কইরা নজর দিয়া দ্যাহ ঠিকই খুইজ্জা পাইবা।”
“দ্যাখেন জলমিয়া বাই, আফনে যদি ওক্ষণ না যান আমি কিন্তু গেরামে শালিশ ডাকমু। আফনের যন্ত্রনায় গেরামের ব্যবাক মানু অতিষ্ট। এতই যহন নিকা করার শক তয় বৌরে মারেন ক্যয়া ?”
“তোমার মত সুন্দর মাইয়া আমার বউ অইলে আমি আর মারমুনা।”
জলমিয়া যথেষ্ট বেহায়য়া ও র্নিলজ্জ চরিত্রের লোক। গ্রামের মেয়েরা যতই তাকে ঘৃণা করে গাল দিবে জলমিয়া ততই হেসে হেসে উত্তর দিবে। অবশেষে তার পান খাওয়া কাল দাঁতগুলো ও পানের রসে পুষ্ট হওয়া চিহ্বার হাসি দেখলে অনেকেরই গা জ্বালা করে তখন বাধ্য হয়ে তার সামনে থেকে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। জলমিয়া, চান্দু হুজুরের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব সম্পর্ক। এক কথায় তারা দুজন পরানের দোস্ত। বৌকে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে জলমিয়া আবার নয়া নিকা করিয়ে দেবার জন্য গাঁয়ের মানুষকে বেশ কয়েক সপ্তাহ থেকে বিরক্ত করছে। কিন্তু গাঁয়ের মানুষ তার এই নিকার ব্যাপারে কোন কথাই কানে তুলছেনা। বৌ ছাড়া জলমিয়া আর কত কাল থাকবে ? গ্রামবাসী যখন বিয়ে করাবেই না তখন চান্দু হুজুর নিজেই দায়িত্ব নিল। চান্দু হুজুর জলমিয়াকে বলল “দোস্তো নিকা যে করবা তা ট্যাকা পয়সা আছে তো। মাইয়া মানষের কি অভাব আছে ? কত মাইয়া লাগবো। তুমি ট্যাকা পয়সা যোগার কর আমি তুমারে এক দিনের মধ্যে নিকা করাইয়া দিমু ইনশাআল্লাহ।”
“ছত্যি কইতাছো। তয় দোস্তো আমি ট্যাকা পয়সা পামু কই। চুরি চামারি কইরা দশ বিশ ট্যাকা কামাই করি। তুমি তো সবই জানো।”
“ট্যাকা ছাড়া নিকা অইবো ক্যামনে। তয় একটা বুদ্ধি আছে দোস্ত”
“কি বুদ্ধি। কি বুদ্ধি ?”
“হুন এই কতা কেউরে কবিনা। তোর শ্যাষের বৌ সখিনার অবস্থাতো হুনছি মোটামুটি ভালা। ট্যাকা পয়সাও ভালা আছে। তুই একটা কাম কর। সখিনাগো গেরামের মাদবর সাবরে গিয়া নালিশ জানাবি, সখিনা তোর টেরাং ভাইঙ্গা তিন আজার ট্যাকা নিয়া পলাইয়া আইছে। মাদবরে তো আর জানেনা আসল ঘটনা। হে তোরে সখিনার বাপ মায়ের কাছ থাইক্কা তিন আজার ট্যাকা লইয়া দিবো।”
“আসলেই দোস্ত, তোমার বুদ্ধি আছে কইতে অইবো। কি ভালা একটা বুদ্ধি বাইর কইরা দিছো।”
“হুন হুন তিন আজার ট্যাকা পাইলে আমারে কিন্তু দুই আজার দিতে অইবো। আমি বুদ্ধি বাইর কইরা দিছি তার দাম দিবিনা।”
“এদুরা বুদ্ধি দিয়া দুই আজার ট্যাকা নিবা।এক আ আজার নিলে অয়না”
“না! ঘষা পাইও কমঅইবনা। দুই আজারই দিতে অইব।”
“ঠিক আছে। আমি রাজি”
“তয় আর দেরি ক্যান ? এহুনি দুই দোস্তো রহনা দি সখিনাগো গেরামে।”
সখিনার বাড়ী গোপাল পুরে। পিংড়ী গ্রাম হতে দু তিন গ্রাম পরেই। গরিবের মেয়ে হলেও সখিনা দেখতে কিন্তু বেশ ছিল। নামাজ রোজা আদব কায়দায় কোন অংশে কিন্তু কম ছিল না। জলমিয়ার কপাল মন্দ এত সুন্দর ভাল বৌ পেয়েও তা ধরে রাখতে পারলোনা।
চান্দু হুজুর আর জলমিয়া ঠিকই হাটতে হাটতে গোপালপুরে গিয়ে গ্রামের মাতব্বর কে ধরে সখিনার বিরুদ্ধে সালিশের ব্যাবস্থা করল। সোবাহান শিকদার এ গাঁয়ের মাতব্বর। সে খুব ভাল মানুষ। আসরের নামাজের পর গ্রামের সবাইকে ডেকে সখিনার বিরুদ্ধে সালিশ ডাকল। সে সালিশে গ্রামের মাতব্বর সহ অনেক ময় মুরুব্বি ছিল। সালিশিতে সোবাহান শিকদার গ্রামবাসীকে বলল “দ্যাহ মিয়ারা, এই জলমিয়া ভিন গাঁয়ের পোলা। হে আমার কাছে একটা নালিশ লইয়া আইছে। জলমিয়া আমাগো গ্রামের সখিনারে নিকা করছে এক বছরের মত অইছে। সখিনা যদি কোন অন্যায় করে আমরা তার বিচার ঠিকই করমু। সখিনাও আমাগো গেরামের ই মাইয়া।”
জলমিয়ার শ্বাশুড়ী শেফালি বেগম তার কন্যাকে নিয়ে উপস্থিত ছিল। সে মাতব্বরের কথা শুনে ঘোমটার আড়াল থেকে বলল “আমার বাপ মরা মাইয়া আবার কি করছে। জামাইর লগে বুনেনায় তাই চইল্লা আইছে।”
“তোমার সখিনা নাকি আইবার সোমায় তার জামাইর টেরাংক থাইক্কা নগদ তিন আজার ট্যাকা নিয়া আইছে।”
মতবরের কথায় জলমিয়া সায় দিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল “হ ঘ ঘ ঘতনা ছত্য। সখিনা আমাল ত্যাকা আ আ আনতে।”
“মতবর কাহা খোদার কসম খাইয়া কইতাছি আমি কোন ট্যাকা পয়সা আনি নাই। এত বড় ডাহা মিত্যা কতা কইলে আল্লায়ও সইবোনা।”
“আমি এহন কি করি কওতো। আমি এই গেরামের মাতবর কার কতা বিশ্বাস আনমু। বড়ই বিপদে পরলাম তো মিয়ারা।”
“মাতবর কাহা হেয় নিকার আগে কইছিল হের তিন চাইরডা মইষের হাল আছে। বিরাট উচ্চ বংশ। নিকার পর গিয়া দেহি হেয় করে চুরি। আফনেরাই কন একজন চোরে তিন আজার ট্যাকা পাইবো কই ?
গ্রামের মাতব্বর সোবাহান শিকদার সখিনার কথাগুলো মাথায় নিলো। এবং ভেবে দেখল কথাতো সত্যি। একজন চোর এত টাকা কই পাইব। সে জলমিয়াকে ভরা মজলিশে ডেকে বলল “জলমিয়া এদিক আওতো।
“হ আইতি মাতবর ছাব। আমার ট্যাকা গুলাদিয়া দিতে কন। আমি বাড়ী যাই।”
“খাড়াও! খাড়াও! তোমার তো তিন আজার ট্যাকার নালিশ। তাই না।”
“হ মাদবর ছাব।”
“আচ্ছা, ট্যাকাগুলা কি সখিনার মায় তোমারে যৌতুক দিছিল। নাকি তুমি নিজেই কামাই রোজগার করছ। সত্যি কইরা কইবা।”
“না। ব্যাকগুন আমার ট্যাকা। আমি নি নি নিজেই কামাই করছি।”
” আচ্ছা আচ্ছা। কও তো জলমিয়া তিন আজার ট্যাকায় কয়ডা নোট হয়।”
জলমিয়া তো এখন পড়ল বেশ বিপাকে। সে চুরি চামারি করে বিশ ত্রিশ টাকার উপরে চোখেই দেখে নাই। সে কি করে তিন হাজার টাকার হিসাব দিবে। চান্দুর বুদ্ধিতে মিথ্যা নালিশে টাকা পাবার আশায় এখন ভিন গাঁয়ের লোকের গণ ধোলাই ছাড়া আর কিছুই জুটবেনা দেখছি। জলমিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল তার পরানের দোস্ত চান্দু বিচারের মজলিশে আর নেই, সে পিছন থেকে পালিয়েছে গণ পিটুনির ভয়ে। জলমিয়া তো ভয়ে আরো কাতর হয়ে গেল। সে ভরা মজলিশের মধ্য খানে দাঁড়ানো। দৌড়ে যে পালাবে তারও কোন ভাল উপায় নাই। এর সে বলল ” ৯০০ ট্যাকার ১৫টা লোট, ৫০০,৬০০,৭০০,৮০০ ট্যাকার ম্যালা লোট আছিল। গোনা নাই।”
জলমিয়ার উল্টো পাল্টা কথা শুনিয়া মজলিশের লোক না হাসিয়া পারলোনা।
মাতব্বর সোবাহান শিকদার জলমিয়াকে বলল “আচ্ছা মিয়া কওতো, সখিনা তোমার লগে কয়দিন সংসার করছিল?”
“৯/১০ মাসের মত অইব।”
“আরে মিয়া, এইডা তোমার চৌদ্দ গুষ্টির কফাল। তোমার মত একটা চোরের লগে সখিনার মত একটা ভালা মাইয়া ৯ মাস সংসার করছে। জোলদি ভাগো মিয়া। নইলে মাইর খাইয়া সিদা অইয়া যাইবা।”
জলমিয়া সেই যে গোপালপুর গ্রাম ত্যাগ করলো আর কোন দিন ঐ গ্রামের দিকে ফিরেও তাকায়নি।

সুখকাঁটা-৪

সকাল হল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মোরকগুলো বাক দিতে শুরু করল। এরপর গাঁয়ের মসজিদে আযান দিল। ফজর থেকে ইশা পর্যন্ত এ গাঁয়ের কোন বৃদ্ধ যুবক মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে না। পবিত্র জুম্মার দিনে হয়তো দু চার দশ জন আসে নামাজ আদায় করার জন্য। জিলানী হুজুর একাই নামাজ পরেন। কারো অপেক্ষায় সে বসে থাকেনা। প্রতিদিনের মত আজকেও সে একাই ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এ গাঁয়ের লোক সবাই নিজের কাজে খুব ব্যস্ত। তাছাড়া আজ আবার শুক্রবার, হাটবার দিন। সব গেরস্ত ঘর থেকে দু এক জন করে হাটে যাবে। দলু কলসিতে করে দুধ ও দুটো বাচ্চা মুরগি নিয়ে হাটে যাচ্ছে বিক্রি করার জন্য। এসব বিক্রি করে সে ঘরের জন্য বাজার করবে। মাতব্বর কদম আলী ও হাটে যাবেন সংসারের বাজার করতে। আবুল বড় ভাই বলে সংসারের বাজার করার দায়িত্বও তার। আবুল হাটে গেলে তার স্ত্রী পারুল তাকে কয়েক বার ডেকে বাজারের কথা বলবে। প্রথম একবার সব বলবে। তার পর পিছু ডেকে ডেকে এক একটা সদায়ের কথা বলবে। প্রথম বার হয়তো নূন। পরের বার তেল এবাবে কয়েক বার ডাকার পর আবুল চটে গেলে বলবে “না না আর কিছু লাগবেনা।”
মানিকের গঞ্জে যাবার খুব একটা দরকার নেই তবুও সে যাবে কারণ সে তার ভালবাসার মানুষকে কিছু দিতে চায়। সে গরিব হলেও তার মনটা কিন্তু বিশাল।
হাটবার দিন গ্রামে পুরুষ মানুষ খুঁজে পাওয়াই খুব কষ্ট কর। সপ্তাহে একটা দিন হাট বার। কত উৎসাহ গ্রামের মানুষের মধ্যে। কারো যেন কোন ক্লান্তি নেই মনে। বেশ আনন্দ উদ্দিপনা নিয়েই তারা চার মাইল পায়ে হেটে বাজার করতে হাটে যায়।
মানিক হাটের সর্ব শেষের দোকানগুলোতে চুড়ি ফিতা খুঁজছে। দোকান ভর্তি এত চুড়ি ফিতা থাকতেও মানিকের একটাও পছন্দ হচ্ছেনা তার মনের মানুষের জন্য। বাজারের সব সাজ সজ্জা দিযে যদি পরীকে সে সাজাতে পারত তবে হয়তো তার মনের আশা মিটতো। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় সে গরিব বলিয়া মাত্র বিশটি টাকা লুইচ্চার কাছ থেকে ফেরত দেওয়ার বহু ওয়াদা করে এনেছে। বিশ টাকায় যা পেয়েছে তা নিয়েই মানিক খুশি মনে বাড়ী ফিরল। হাট ভর্তি মানুষ। দু তিনটা গ্রাম হতে মানুষ আসে এ হাটে। ক্রেতা বিক্রেতা সবাই তাদের নিজের গ্রামের কিংবা পাশের গ্রামের। কেহই কারো পর নয়। পর হলেও খুব একটা বেশি অপরিচিত নয়। এ হাটে ঈদ গাহের মত একটা পূর্ণ মিলন মেলা হয়। যাদের সাথে সচরাচর দেখা হয়না গঞ্জের হাটে আসলে তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়টা বেশ জমে উঠে কিন্তু যার যা প্রয়োজন তাই বাজার করছে। কেহ কেহ আবার বাকিতেও সদায় করছে। দলু হাওলাদার বাজারে এসেই নিমিশের মধ্যে সব দুধ বিক্রি করেছে। সে পাঁচ সের দুধ এনে সাড়ে আট সের দুধ বিক্রি করেছে। পাঁচ সের দুধের পর বাকী সাড়ে তিন সের পুকুরের ময়লা পানি। ক্রেতারা দুধ ক্রয় করার সময় বলে “কি দলু বাই ! তোমার দুধ এতো পাতলা ক্যা আ। পানি মিশাই ছো নাকি ?
“বাই যে কি কও। পানি মিশামু আমি। বাপ দাদা চৌদ্দ গুষ্টি দুদের ব্যবসা কইরা মরছে। আমি যদি এই ডাইন হাতদিয়া পানি মিশাই আল্লায় আমার হাত পঙ্গু কইরা দিবো।”
দলু হাওলাদার এমন কসম কাটল যে ক্রেতারা অতি বিশ্বাসের সঙ্গে দুধ কিনল। সে দুধে পানি মিশিয়েও অতি সত্য কথা বলেছে কারণ সে যখন দুধে পানি মিশায় তখন বাম হাত ব্যবহার করে। বুদ্ধির জোড়ে দলু দুধে ভালই লাভ করেছে। এবার তাহার বিক্রি করার বাকী আছে মুরগি দুটো। মুরগি বিক্রির জন্য কোন খোদ্দের ই পাচ্ছেনা। দুধের খালি কলসি আর মুরগি জোড়া নিয়ে কড়া রোদের মধ্যে বসে আছেন দলু।
হাটটি নদীর ঘাটে হওয়ায় মাছের কোন অভাব হয়না। এখানে বিভিন্ন জাতের মাছ পাওয়া যায় খুবই সস্তায়। যারা মধ্যবৃত্ত আয়ের তাদের মধ্যেও কেহ কেহ মাছ খরিদ করে। কিন্তু গরিবদের তো কথাই নাই। মাছের বাজারের আসে পাশে তাদের খুঁজিয়া পাওয়া যাবেনা। তাহারা কিনবে লাউ শাক, পুই শাক, মুলা, মিষ্টি, কুমড়া, লাউ।
দীর্ঘ চার মাইল পায়ে হাটিয়া সবাই গঞ্জের হাটে যায়। যখন বাড়ী ফিরবে তখন পায়ে হেটে বাড়ী আসে। যাতায়েতের জন্য দু,চারটা মহিষের গাড়ি আছে কিন্তু কেহই তাতে উঠবেনা। কারণ গাড়িতে উঠলেই অর্থ ব্যয় হবে। এই সামান্য অর্থকে বাঁচানো জন্য তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করতেও দ্বিধা বোধ করে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে। গঞ্জের হাট প্রায় লোক শূণ্য হয়ে পরেছে। হাতে গোনা বিশ পঁচিশ জন খুচরা বিক্রেতা আছে তারা তাদের পন্য বিক্র করতে পারে নাই। সে সব পন্য বিক্রি হলেই সংসারের জন্য সদায় কিনে নিয়ে বাড়ী যাবে। দুটো মুরগি বেচার আশায় দলু হাওলাদার এখন অবদি বসে আছে। হঠাৎ এক খোদ্দের এসে মুরগি জোড়াকে হাতে নিয়ে বলল “কি কাহা, মুরগা জোড়া কত ব্যাচবা ?”
দলু হাওলাদার বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল “আমার পালা মুরগা। ডিম দ্যায় ভালা। আফনে যদি ন্যান তয় জোড়া ৭০ ট্যাকা দিয়েন।”
“কি কও ভালা মুরগা। এই দ্যাহ তোমার মুরগা ঝিমায়। মুরগার কোন ব্যারাম ট্যারাম আছে নি। মুরগার সালুন খাইলে আবার ডায়রিয়া অইবো নাতো!”
“কি যে কন না। কইলাম না আমার পালা মুরগা। এমন মুরগা পুরা হাডেও খুইজ্জা পাইবেন না।”
ক্রেতা লোকটি মুরগি জোরাকে অনেক ক্ষণ হাতিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে বলল “দ্যাহেন কাহা বাজার শ্যাস। এহন বাড়ী যামু। এক দাম কন লইয়া যাই।”
“কইলামিই তো। যান আর পাঁচ ট্যাকা কোম দ্যান।”
“না। মুরগা জোড়া এ্যক দাম ত্রিশ ট্যাকা দিমু। দিলে দ্যাও।”
দলু হাওলাদার সারাদিন রোদে বসে থেকে মেজাজটা বেশ চটে আছে। সে ক্রেতার হাত থেকে মুরগি জোড়া টেনে নিয়ে বলল “জিবনে মুরগার সালুন তো দূরের কতা, মুরগার ঝোল খাইছো কিনা আমার সন্দে হয়। হিম মুরগা গাঙ্গের জলে ভাইসা আইছে কিনা! ত্রিশ ট্যাকায় জোড়া বেঁচবো। মগের মুল্লুক।”
ক্রেতা চুপ চাপ চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ঐ মুরগি জোড়ার পায়ে বাধা পাটের রশিটি খুলে গেল। যা দলুর অজানা ছিল। দলু রাগের মাথায় মুরগি জোড়াকে হাত দিয়ে আঘাত করে কিছু বলতেই মুরগি জোড়া দিল দৌড়। বাজারের মধ্যে দলু হাওলাদারও মুরগির পিছন পিছন ছুটতে লাগল। সে বৃদ্ধ মানুষ বলে মুরগির সঙ্গে দৌড়ে ঠিক পেরে উঠলনা। খোলা বাজারে মুরগি ধরা কি চারটি খানিক কথা। দেশি মুরগি, বাজারের মধ্যে কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছে কে জানে। অবশেষে মুরগি জোড়ার খোঁজ না পেয়ে বাজারের মধ্যে বসে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিল। কিছুক্ষণ বাদে সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে নদীর ঘাটে নেমে হাতের দু কোষে পানি খেতে না খেতেই মাগরিবের আযান দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে হাটের সব দোকান পাট সব বন্ধ করিয়া সবাই বাড়ীর দিকে ফিরতে আরম্ভ করেছে। অবশেষে কোন বাজার না করেই খালি হাতে বাড়ী ফিরতে হল দলুকে। তার মন খুব খারাপ। কইতুরী তার বাবার আশায় পথ চেয়ে আছে। কইতুরীর শখের পালা দুটো মুরগি কুটির খালি করে বাবার হাতে দিয়ে বলেছিল “বাজান অভাবের যন্ত্রনা আর সইতে পারিনা। ঘরে চাউল নূন ত্যাল কিছুই নাই। বাজার নাই গত হপ্তা হইতে। চাউল থাইক্কা নূনের কৌটা পর্যন্ত খালি।”
সে সারাদিন না খেয়ে বাবার আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। কখন বাবা আসবে ? সে নিজেকে নিজে বলছে
“বাজান আইজ সাঝি ভইরা বাজার সদায় নিয়া আইবো। আইজ আমি আর বাজান প্যাট ভইরা ভাত খামু। কত দিন খালি নূন দিয়া হুগনা ভাত খাইছি। বাজান এ্যতো দেরি করতাছে ক্যান ? মোনেহয় বাজানের আইজ ব্যাচা কিনা ভালা অইছে। বাজান মাছও আনবার পারে। এই ক্ষিদা আমারে এতো জ্বালাইশ না, বাজান আইলেই আমি মাছের সালুন দিয়া ভাত খামু। আর একটু সবুর কর না।”
কইতুরির মত একটা অল্প বয়সী মেয়ে ক্ষুদার যন্ত্রনায় কাতর না হয়ে সে ক্ষুদাকেই বুঝাচ্ছে। দলু গঞ্জ থেকে ক্ষুদার যন্ত্রনায় আর হেটে আসতে পারছেনা। সে কোন মুখে মেয়ের সামনে দাঁড়াবে ? যে মেয়ে তার সখের মুরগি দুটো দিয়ে সাজ সজ্জা আনতে না বলে খাবার আনতে বলেছে। তার সামনে আজ আমি বাবা হয়ে খালি হাতে কি করে দাঁড়াবো? দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বহু কষ্টে দলু কড়াটা নাড়া দিল। কইতুরি দরজায় শব্দ শুনিয়া তার কোমল মনটা অতি আনন্দে নেচে উঠল। সে বলতে বলতে গেল “নিশ্চয় বাজান আইছে। না জানি কত্ত বাজার আনছে।”
এরপর কইতুরি দরজা খুলে সাজির দিকে তাকিয়ে দেখল বাবার হাতের সাজিটিতে কিছুই নাই। বাবার মুখের চেহারও বিষন্ন,কাঁদো কাঁদো অবস্থা। তখন সে বাবাকে কোন প্রশ্ন না করে বড় একটি নিঃশ্বাস ছাড়িবার পর তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ভরা যৌবনে বিধবা হয়ে কইতুরি বাপের সংসারে অভাবের লাঙ্গল টানছে। রাতে রান্না করার জন্য এক মুঠো চালও নাই। দুই বাপ বেটি সকাল থেকে না খাওয়া। একটা মানুষ আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে ? কইতুরি কোন উপায় না পেয়ে লজ্জা শরম সব ভুলে এক দৌড়ে পারুলের কাছে গিয়ে বলল “চাচি আম্মা এ্যাক সার চাউল হাওলাদ দিবা, কাইল কাম কইরা শোধ দিমু।”
“ক্যরে কইতুরি, তোর বাজানে আইজ গঞ্জের হাটে যায় নায়।”
“জানিনা চাচি আম্মা, ব্যান ভ্যালা হইতে না খাওয়া। এ্যাক পুড়া চাইল অন্তত দ্যও।”
“একটু খাড়া দিতাছি।”
পারুল ঘরের ভিতর থেকে এক পুরা চাল এনে কইতুরির আঁচলে ঢেলে দিয়ে বলল “ঘরে সালুন আছে তো নাকি একটু নিবি।”
“কি যে কও চাচি, সালুন ! মাছ গোস্ত দিয়াই যদি ভাত খামু ! তয় আল্লায় আমাগো গরিব বানাই বো ক্যান। ঘরে পোড়া মরিচ আছে দুইডা। রাইতের ব্যালাতো, কোন মতে চালাইয়া নিমু।”
এরপর কইতুরি তার নিজের ঘরে চলে গেল। বাবুলের ঘর হতে কইতুরির ঘর খুব একটা দূরে নয়। মধ্যে কেবলি একটা উঠানের ব্যবধান। বড় উঠানের দু পাশে দুটি ঘর দুজনার। তবে বাবুলদের তুলনায় কইতুরির ঘরটি অনেক পুড়ানো ভাংগা। এই উঠানের দক্ষিন পাশটিতে বেশ জঙ্গল। বড় বড় গাছের বাগানের মধ্যে লতা পাতার ভীড়। বেত গাছ জঙ্গলটিকে আরো অন্ধকার করে রেখেছে। বাবুলদের ঘরটি উত্তর মূখী। আর উত্তরে আছে বড় একটা পুকুর। গ্রামে কোন পুকুরেই কোন সিঁড়ি নাই। পুকুরে উঠানামার জন্য খেজুর গাছ দিয়ে ঘাটলা তৈরী করে। নারী পুরুষ একই পুকুরে গোসল রান্না বান্না সহ সকল প্রকার কাজে এ পানি ব্যবহার করে। পুকুরের আসে পাশে বড় বড় কড়াই গাছ নারকেল গাছ থাকায়, পানি সব সময় ঠান্ডাই থাকে।
সপ্তা খানিক পরের কথা
আবুলের স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। চোখের নিচে কালো কালো দাগ হয়েছে। শুকিয়ে মরো মরো অবস্থা। চোখ মেলে কারো সাথে কথা বলার মত শক্তি তার নাই। পারা প্রতিবেশিরা সবাই এসে এক নজর দেখে যায় আর দুঃখ করে বলে “আহারে বউটা বুঝি আর বাঁচবোনা।”
বাবুল না ডাকলেও তার ছোট মা সর্মেতবানু তার ছেলের বৌকে দেখতে এসেছে। মান অভিমান যতই থাকুক না কেন ছেলের বৌ অসুস্থ। দেখতে না গেলেও মানুষ নানা রকম কথা বলবে। শত কথা উপেক্ষা করে সে তার ছেলের বৌকে দেখার জন্য শেষ পর্যন্ত স্বামীর ভিটায় যাবে। বিশ বছর পর সে স্বামীর ভিটায় আবার পা রাখবে। সর্মেত বানু যতই স্বামীর ভিটার কাছে আসছে ততই তার বুকের ভিতরে কষ্ট বাড়ছে। কষ্ট হবেই বা না কেন ? কুড়ি বছর বয়সে তার যৌবন যখন গোলাপ ফুলের মত ফুটে উঠেছে তখনি সে স্বামীর সংসার করতে এই বাড়ী আসে। কতই না সৃত্মি জড়িয়ে আছে এই ভিটায়। কর্ত্যবের খাতিরে বুকে পাষাণ বেধে সর্মেতবানু তার স্বামীর ভিটায় এলো।

বাংলাদেশ সময়: ০:০৫:১৪   ৭৮১ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ