বঙ্গ-নিউজডটকম:কোরবানির পশুবাহী গাড়িতে পথে পথে চলছে চাঁদাবাজি। মাস্তান-চাঁদাবাজদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতরাও থেমে নেই। গাড়ি দেখলেই তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। একটি গাড়ি ঢাকায় পৌঁছতে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে আট- হাজার থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা গুনতে হচ্ছে। সূত্র জানায়, একই সাথে পশুর বেপারি ও ট্রাকচালকের কাছ থেকে চাঁদা নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। চাঁদা দিতে না চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে রাখা হয়। আবার ফেরিঘাটগুলোয় গাড়ির সিরিয়াল নিয়েও আদায় করা হচ্ছে বিরাট অঙ্কের অর্থ। ব্রিজের টোল আদায় নিয়েও চলছে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি।
সিরাজগঞ্জের গরুর বেপারি আবুল হোসেন। আটটি গরু নিয়ে গতকাল বুধবার গাবতলীতে এসেছেন বিক্রির জন্য। তিনি জানালেন পথের নানা ঝামেলার কথা। সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসার পথে মোট পাঁচ স্থানে চাঁদা দিয়েছেন চার হাজার টাকা। তিনি বলেন, এর বাইরেও এক হাজার টাকা দিতে হয়েছে যমুনা ব্রিজ পার হয়ে বখশিশ। আটটি গরু নিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে পকেট থেকে। তিনি জানালেন, এই টাকা ওঠাতে হবে গরু বিক্রি করে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থেকে ঢাকায় গরু নিয়ে আসতে পথে পথে এক হাজার ৮০০ টাকা চাঁদা গুনতে হয়েছে বেপারি কাশেমের। তিনি জানালেন, রাস্তার একটি বাঁক পার হয়ে আরেক বাঁকে গিয়ে চাঁদা দিতে হয়। পোস্তগোলা ব্রিজের দুই পাশে দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। গতকাল পোস্তগোলা ব্রিজের দুই পাশে দেখা যায় প্রকাশ্যেই চাঁদা নেয়া হচ্ছে। ব্রিজের টোল আদায়ের নামে এই অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। একাধিক ভুক্তভোগী বলেছেন, এই ব্রিজের টোল ২০ টাকা। অথচ দুই পাড়ে ২০০-৩০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে।
রাজধানীর কমলাপুর হাটে গরু নিয়ে এসেছেন কুমিল্লার বাবুল মিয়া। তিনি জানালেন, পথে পথে তাকে চাঁদা দিতে হয়েছে। ১০টি গরু ঢাকায় আনতে তাকে ছয় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় কুমিল্লা বিশ্ব রোডে দুই ঘণ্টা ট্রাক আটকে রাখা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশের সাথে মাস্তানদের সখ্য রয়েছে। কোনো কোনো স্থানে পুলিশ মাস্তানদের দিয়ে টাকা তুলছে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি হাজী সায়েদুল হক বলেন, সারা দেশেই তো চাঁদাবাজি চলছে। এ থেকে যদি আল্লাহ রক্ষা করেন। পুলিশ টাকা নেয় না এমন কোনো গাড়ি নেই। কেউ বখশিশের নামে নেয়, কেউ সরাসরি চাঁদা নেয়Ñ এভাবেই চলছে। বিভিন্ন সময় দেখা যায় মানুষ গরু বিক্রি করতে না পেরে বাড়িতে নিয়ে যায় সেই সময়ও চাঁদা দিতে হয়। দেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ভালো হলে দেশের চিত্র পাল্টে যেত।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, চাঁদাবাজদের এক সপ্তাহের ব্যবসা। সারা বছর এ সময়ের জন্য চাঁদাবাজরা ওঁৎ পেতে থাকে। তিনি বলেন, কোনো ট্রাক চাঁদা ছাড়া ঢাকায় আসতে পারে না। আগে বেপারিরা নিজেরাই চাঁদাবাজদের হাতে টাকা দিত। এখন ড্রাইভারদের সাথে চুক্তি করে। ভাড়া কত, পুলিশ খরচ কত, চাঁদাবাজদের কত দিতে হবে। এগুলো আগে থেকেই চুক্তি করে নেয়া হয়। তিনি বলেন, কারো পক্ষেই এ চাঁদাবাজি থামানো সম্ভব না। যারা ব্যবসা করেন তারাও আগে থেকেই মাস্তানদের জন্য একটি অর্থ ধার্য করে রাখেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি মো: আলী রেজা জানান, চাঁদাবাজি চলছে। ঢাকায় কেবল গরু আসতে শুরু করেছে। শুরুতেই চাঁদাবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদের সদস্য সচিব মাহমুদুল আলম মন্টু বলেন, চাঁদাবাজি চলছে। দেশের কোথাও চাঁদাবাজি বন্ধ নেই। এমনকি মহানগরীতেও চাঁদাবাজি চলছে। গাড়ি নিয়ে বের হলেই পুলিশকে টাকা দিতে হয়। দেখা যায় একটি ট্রিপ মেরেছে ৫০০ টাকার আর পুলিশকে দিতে হচ্ছে ৮০০ টাকা। আবার র্যাকার লাগালে দিতে হয় দুই হাজার টাকা। পশুবাহী গাড়িতে তো চাঁদাবাজি চলছেই। এভাবে পরিবহন ব্যবসা চলতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা কষ্ট করি, মানুষের উপকার করি। কিন্তু হয়রানি ও চাঁদাবাজির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি না। এখন আর পরিবহন ব্যবসা চালানো যাচ্ছে না। চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছি না। ঈদের পরে পুলিশি হয়রানি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনে নামার কথা বলেছেন এই পরিবহন শ্রমিক নেতা।
পথের চাঁদাবাজির সাথে হাট ইজারাদারদের মাস্তানির কারণেই চরম হয়রানির মধ্যে আছেন পশু ব্যবসায়ীরা। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো হাটে পশু নিয়ে যেতে পারছেন না। এ নিয়ে সংঘর্ষও হচ্ছে কোথাও কোথাও। গত মঙ্গলবার দুই হাটের ইজারাদারদের আক্রমণে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় ট্রলারডুবে মারা গেছে ১১টি গরু। বেপারিদের অনেকেই জানান, ইজারাদারদের অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ।
এ দিকে সড়ক-মহাসড়কে পশুবাহী ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ২৪টি গরু নিয়ে সোমবার রাতে একটি ট্রাক ছিনতাই হয়েছে। ট্রাকচালক, হেলপার ও বেপারিদের মারধর করে দুর্বৃত্তরা ট্রাকটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
পরিবহন নেতারা বলেন, চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের কর্তাদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। তারা প্রতিবারই এসব বন্ধের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কোনোই প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।
এ দিকে সড়কে এই চাঁদাবাজি ও হয়রানির ব্যাপারে জানার জন্য পুলিশের হাইওয়ে রেঞ্জের ডিআইজির সাথে যোগাযোগের জন্য তার মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে ফোন রেখে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ০:৩১:১৮ ৩৫১ বার পঠিত