সুখকাঁটা-ধারাবাহিক উপন্যাস

Home Page » সাহিত্য » সুখকাঁটা-ধারাবাহিক উপন্যাস
মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪



untvvvvvigfgtled.jpg

……….৩য় পর্ব শুরু।
নদীর স্রতের মত সময়ও বয়ে চলে আপন তালে। কারো আশায় বসে থাকেনা বিন্দু মাত্র। সন্ধ্যা হতে ধীরে ধীরে রাতের আধার গাঢ় হল। সন্ধ্যার কিছুপর গাঁয়ের মানুষগুলো ঘর মুখী হতে থাকে। কারণ পল্লীতে বিদ্যুতের সু-ব্যবস্থা না থাকায় প্রত্যেকেই কেরোসিনের কুপি ব্যবহার করে। আর সেই কুপির তেল বাঁচানোর জন্য তারা বেশি রাত না করে তারাতারি নিদ্রায় যায়।
সবার মত মানিকও রাতে ঘুমাবে। মানিকের ঘরে একটা খাট তাহাও বাঁশের তৈরী। সে খাটে মানিকের মা ঘুমায় আর মানিক মাটিতে মাদুর পাতিয়া ঘুমায়। আজকেও সে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে শয়ণ করিয়াছে কিন্তু ঘুম হচ্ছেনা। ইদানিং সে এই সমস্যাটা লক্ষ্য করিতেছে। মধ্য রাত্রি পার হয়ে যায়, কিন্তু তাহার চোখে ঘুম ধরেনা। মানিক মিয়া কিছুতেই অনুমান করিতে পারিতেছে না কেনইবা তাহার চোখে ঘুম আসেনা। সে যে বয়সে এসে উপস্থিত হয়েছে তাহাতে রাতে ঘুম না আসা, কোন ব্যধির মধ্যে পড়ে না। চিন্তাই তাহাকে গ্রাস করছে। নয়া যৌবনের শিশির বিন্দু তাহার গায়ে পড়েছে। সে জন্য সে এত উতলা। তাহার একজন মনের মানুষ দরকার। সে মনে মনে পরী নামের একটি মেয়েকে পছন্দ করে কিন্তু যখন ভাবে, পরীরা তাহাদের তুলনায় অনেক ধনী তখনি তাহার দুশ্চিন্তা বাড়িয়া যায়। মানিক গাঁয়ের মধ্যে সবচেয়ে গরীব বলিয়া নিজেকেই মনে করে। তাই পরীর মত একটি মেয়েকে তার পছন্দের কথা বলিবার মত সাহস কোনদিন হইবেনা।
এমনি ভাবনা ভাবতে ভাবতে পূর্ব আকাশে আলো ফুটেছে। চারিদিকে পাখির ডাকের কিচির মিচির শব্দ পাওয়া যাইতেছে। পাখির শব্দের সঙ্গে বড় বড় কন্ঠে কে যেন মানিককে তার ঘরের সামনে হতে ডাকিতেছে। মানিক ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে দেখল যে ডাকছে সে তার মেঝ ভাই বাবুল। মানিক বলল “কি অইছে মাঝাভাই ?”
“মানিক আমি আইজ ক্ষ্যতে যাইতে পারমু না। ধান গুলা তুই লুইচ্চা ট্যাপারে লইয়া বুইন্ন্া দিস। তোর ভাবিরে মোনে অয় শয়তানে পাইছে। কাইল রাইত থাইক্কা ম্যালা অসুস্থ। আমি একটু চান্দু হুজুরের বাড়ী যামু ”
“কি অইছিলো ?”
“কি জানি ? পোয়াতি মানু আগারে পাগারে গেছিল মোনে অয়। আমি যাই।”
“যাও আমি সব সামলামুনে, তুমি চিন্তা কইরনা মাঝাভাই।”
বাবুল আবার উল্টো পথে বাড়ীর দিকে ফিরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ হাটার পর কে যেন হাত ইশারা করে বাবুলকে তার নিজের দিকে ডাকছে। বাবুল ব্যস্ততার মধ্যেও তাহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল “ হুজুর ভাল আছেন ?”
“বাবুল কি অইছে তোমার, এমন লাগতাছে ক্যান তোমারে ?”
“মাওলানা সাব। আমার বৌডারে নিয়া ম্যালা বিপদে আছি। তারে মনে হইতাছে জীন ভূতে আছর করছে। এর লাই¹া চান্দু হুজুরের বাড়ী যামু।”
“এই গুলা কি কও তুমি ? তোমার বৌ না পোয়াতি ! তুমি তারে নিয়া অক্ষণ গঞ্জের সরকারি হাসপাতালে যাও। আমি হুনছি হাসপাতালে নাকি গর্ভবতী মায়েদের খুবই উন্নত চিকিৎসা হয়। তুমি চান্দু হুজুরের বাড়ী যাবা ক্যান, সে কি ডাক্তার নাকি কবিরাজ।”
“মাওলানা সাব আফনে বা কি কন? আফনে মাওলানা অইয়া ঘরের বৌরে হাসপাতালে নিতে কন। ঝাড় ফুঁকে কাম যদি ডাক্তার দিয়া হইতো। তয়লে দেশে আর ওঝা বৈদ্দ থাকতনা।”
বাবুল অতি বিরক্ততার সঙ্গে বিদায় নিয়ে চান্দু হুজুরের বাড়ীতে গিয়ে চান্দুর হাতে ধরে বলল “বাই আমার বৌডারে বাঁচা, আমার বৌডা কেমন যানি করতাছে।”
“আরে দোস্ত চিন্তা কইরনা, তোমার বৌ মানেই তো আমার বৌ। না মানে দোস্তের বৌ হইলো গিয়া আপনা মানু। এহন কও দোস্ত তোমার বৌএর কি হইছে ? জীনে ধরছে, ডর খাইছে, নাকি মৃগি ব্যারাম ?
“নারে দোস্ত আমার বউ সাত মাসের পোয়াতি, তার উফরে আবার জীন ভূতে আছর করছে। জোলদি আমার বাড়ী ল।”
“দোস্ত, তুই না এই বছর খানিক অইছে নিকা করছ। এর মধ্যে সাত মাসের পোয়াতি!”
“দোস্ত তুই কি খাড়াইয়া খাড়াইয়া কতাই কইবি, নাকি আমার বাড়ী যাবি ?”
“হ যামু। তয় একটু খাড়া, আমার ঝোলা ব্যাগডা লইয়া আই।”
“হ জোলদি আয়। আমি বাড়ির উঢানে খাড়াইয়া আছি। ”
গোটা পিংড়ী গ্রামের মধ্যে চান্দুর মত ভন্ড লোক আর দুই খানা হবে না। সে কোন সুন্দরী মেয়ে মানুষ দেখলে তার নামের পর যে একটা হুজুর শব্দ ব্যবহার হয় তাহা সে বার বার ভুলিয়া যায়। চান্দু হুজুরে বর্তমান যে বউ শিউলি, সে তার ছাত্রী ছিল। চান্দু সংসার জীবনের আগে এক বাড়ীতে জাইগির থাকত। সেই বাড়ীর মেয়ে শিউলি। চৌদ্দ বছর বয়সে শিউলিকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে বাড়ী হতে ভাগিয়ে এনে নিকাহ্ করেছে সে। তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হল তাহার এক গোছা ছাগুলে দাড়ি আছে, সেগুলোকে কিছুক্ষণ পর পর বাম হাত দিয়ে মুষ্টি করে ডান হাত দিয়া ঝাড়া দেয়।
চান্দু হুজুর ইতি মধ্যে বাবুলকে নিয়ে হাটতে হাটতে বাবুলের বাড়ীর উঠানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। বাবুল চান্দুকে বলিল “দোস্ত তুমি বহো। আমি তোমার ভাবী ছাবরে লইয়া আহি।”
বাবুল ঘরের ভিতর থেকে তার বউ গোলাপিকে ধরে উঠানের গাছের ছায়ায় নিয়ে আসলো। গোলাপির বড় জা পারুল সেও বাবুলের সাথে এসে একটা ছেড়া মাদুড় এনে উঠানে বিছিয়ে দিল। গোলাপির শারিরীক অবস্থা খুবই খারাপ। তাহাকে কোন জ্বীন ভূতে আছর করে নাই। সে গর্ভবতী থাকা অবস্থায় সে কোন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়নি। তাই সে গর্ভবতী অবস্থায় করনিয় কাজগুলোও ঠিকমত পালন করেনি। ইহাই তাহার অসুস্থ হবার আসল কারণ। চোখ মেলিয়া কথা বলিবার মত তাহার শরীরে কোন শক্তি নাই। পারুল গোলাপিকে ওড়না দিয়ে নাক মুখ ডেকে, চান্দুর সামনে পাটিতে বসিয়ে দিয়াছে। চান্দু ছোট একটি জল চৌকিতে বসিয়া তাহার ঝুলি ব্যাগ হতে কতগুলো কৌটা ও গাছের কিছু ছাল বাকল বের করল। বাবুল তাহা দেখিয়া অবাক হইয়া চান্দুকে বলল “দোস্ত তুমি হুজুর মুন্সি জানতাম, কিন্তু এত বড় কবিরাজ তা তো জানতাম না।”
“জানবা জানবা, সোমায় আইলেই সবই জানবা।”
এরপর সবাই চুপ চাপ। চান্দু চোখ বন্ধ করে ঠোট দুটোকে ঘন ঘন নাড়ছে, যেন মানুষ বুঝতে পারে, সে বড় কোন মন্ত তন্ত পাঠ করছে। চান্দু হুজুর জ্বীন হাজির করিবে বলিয়া গ্রামের ছোট বড় অনেকেই ইহা দেখিতে উঠানের চারি পাশে ভীড় জমাইছে। কিছুক্ষণ পর চান্দু চোখ খুলে, তাহার চারি পাশে গাঁয়ের বহু লোকের ভীড় দেখে হঠাৎ চমকে উঠে। এরপর চান্দু লোক দেখানোর জন্য বড় বড় কন্ঠে বলিল “আসমান জমিন পুব পশ্চিম আমার নাগালের মদ্যে, তুই বাঁচতে পারবিনা। আমি চান্দু হুজুর, তোর মতো চাইর পাঁচটা জীন আমার তাবিজের মদ্যে ভড়া থাহে।”
চান্দু হুজুর এমন বলতে বলতে হাত দুটোকে গোলাপির মুখের কাছে নাড়ছে আর কিছুক্ষণ পরপর তার মুখটাকে বাঁকা করে রোগীকে ফু দিচ্ছে।
চান্দুর কথায় রোগী কোন ভাল মন্দ না বলায় সে বেশ চিন্তিত হইয়া নিজেকে বড় ওঝা জাহির করার জন্য উঠানের সামনে আগুন জ্বালিয়ে একটা লোহার শিক আগুনে পুড়িয়া গোলাপির ডান হাতের চাপিয়া ধরিয়া বলিল “যাবি, তুই কত বড় শয়তান রে ! এবার না গ্যালে এই গরম লোহা তোর নাকের মধ্যে চাইপ্পা ধরমু।”
গোলাপির হাতে যখনি লোহার গরম শিক চাপিয়া ধরিল সে ব্যথায় বেমালুম চিৎকার দিয়ে কোকরাতে লাগল। তারপর যখন শুনল এই গরম শিক আবার নাকের মধ্যে চাপিয়া ধরবে তখন গোলাপি চালাকি করে জ্বীনে আছড় করা রোগীদের ভাষায় বলল “যাই যাই আমি যাই, বাই আমারে ছাইরা দ্যান আমি যাই আমারে আর ছ্যাকা দিয়েন না” চান্দু হুজুর গোলাপির কথা শুনেতো অবাক। “আনদাজে ঢিল মারলাম আর ঠিক মত গিয়া লাগল। যাউক গা এখন থাইক্কা জীন ছাড়ানোর বুদ্ধি পাইছি। গরম শিক নাকের মধ্যে চাইপ্পা ধরলেই কেল্লাা খতম।”
গোলাপির দূর্বল শরীরে গরম শিকের সাঁকা পেয়ে আরো দূর্বল হয়ে তার জা’র কাধে ঢলে পরলো। এরপর চান্দু হুজুর তার দোস্ত বাবুল কে বলল “দোস্ত এক গ্লাস পানি লইয়া আও, তোমার বউরে জীনে ছাইরা দিছে, দ্যাহনা কেমন আরামে ঘুমাইতেছে। এহন এক গ্লাস পানি পইড়া দিলে তা তোমার বৌর নাকমুখে ছিটাইয়া দিলেই ভালা অইয়া যাইবো।”
বাবুল গ্লাসে পানি আনা মাত্র কি যেন পড়ে ফু ফা দিয়ে গোলাপির মুখথেকে ওরনার পর্দাটা সরাতে বলল। পর্দাটা সরানো হলে পরে চান্দু গোলাপির চাঁদ মুখ খানা দেখিয়া হা করিয়া রইলো। সে এত সুন্দরী মহিলা এ গাঁয়ে আর একটিও দেখে নাই। গোলাপি অসুস্থ বলিয়া তাহার চেহারায় কালো কালো দাগ দেখা যাইতেছে। চুলগুলোও এলো মেলো। তারপরও সে চান্দুর নজর থেকে বাদ যায়নি। তবে চান্দুর বৌ এর চেয়ে গোলাপি অনেক সুন্দরী বটে, কিন্তু সেই সুন্দর্য্য তাহার মধ্যে আর অবশিষ্ট নাই। বিয়ের আগে একটি মেয়েকে যে, পাগল করা অপরুপা মনে হয় তা বিয়ের পর তাকে আর ততটা অপরুপা লাগে না। গোলাপির ব্যাপারটিও ঠিক একই রকম। চান্দুর মনে গোলাপির জন্য প্রেম উদয় হল। চান্দু বাবুলকে বলল “বিপদ কাইট্টা গেছে দোস্ত আর কোন ডর নাই। তুমি তোমার বউরে ঘরে লইয়া যাও।”
চান্দু মনে করেছে তার শিক গরমে জীন ভূত ভয়ে পালিয়েছে। তাই উপস্থিত লোকের সাথে নিজের অনেক প্রসংশা করলো। যদিও তার কথায় কান দেবার মত লোক এই গাঁয়ে নাই, বাবুলের মত দু এক জন ছাড়া। চান্দু যখন নিজের প্রসংশায় পঞ্চমুখ ছিল তখনই ভড়া উঠান শূণ্য হয়ে গেল নিমিশে। চান্দুও আর ওখানে উপস্থিত রইলোনা। অজানা পথে চলে গেল।

মানিক তার দুই সহযোগীকে সাথে নিয়া অর্ধ বেলার মধ্যে অনেকটাই ধানের বীজ বপণ করিয়াছে। একত্রে দশ পনের বিঘার মত জমিতে ধান বুনছে একটি কৃষক পরিবার। বিভিন্ন কৃষকের জমি আছে এখানে, যার যার ক্ষেতে সে ধানের বীজ বপণ করছে। কিন্তু প্রত্যেকের জমি শেষে কাদা মাটি দিয়া উঁচু করে সীমানা করা আছে। কিছুদিন পরে দু চোখ যত দূরে যাবে তত দূরেই দেখা যাবে সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে ধান ক্ষেত। এই ধানক্ষেতগুলো মূল সড়কের নীচ থেকে আরম্ভ করে ধানসিঁড়ি নদীর সীমানা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। ধানসিঁড়ি নদীর এই পাড়ে বিশাল ধান ক্ষেত আর নদীর ওপাড়ে আছে অন্যান্য ক্ষেত। সেখানে কৃষকরা ডাল,আলু,মূলা,সরিষা,তরমুজ,ফুট,ইত্যাদি পণ্য ফলায়।
ধান বপণ করতে গেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচের দিকে দিয়ে নুয়ে নুয়ে কাদার মধ্যে ধানের বীজ পুঁতে দিতে হয়। মানিক নুয়ে নুয়ে ধানের বীজ বুনতে বুনতে দু পায়ের ফাঁক থেকে উল্টো হয়ে পরীকে দেখতে পেলো। পরী হলুদ সবুজ রংএর একটা তাতের কাপড় পড়ে হাতে একটা গামছার মধ্যে কি যেন নিয়ে কিছুদূর থেকে মানিকের দিকেই এগিয়ে আসছে। পরী আসতে আসতে এদিকে ওদিক তাকাচ্ছে কেহ যেন তাকে দেখতে না পায়। কিছুক্ষণ পর মানিকের ক্ষেতের নিকটে এসে পরী মানিকের নাম ধরে ডেকে বলল “মানিক বাই এদিকে দেইখ্যা যাও তো।”
মানিক পরীর কথা শুনে সোজা হয়ে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে উত্তর করল “কেডা, আমারে ডাকতাছো।”
“হ আফনারেই ডাক পাড়তাছি। আফনে ছাড়া এহানে আর মানিক কেডা আছে। খাড়াইয়া রইলেন ক্যান, এদিক আয়েন।”
মানিক পরীর কথা মত ক্ষেতের আইল বেয়ে উপরে উঠে আস্ল। তখন পরী মানিককে আবার বলিল “আফনার লই¹া খাওন আনছি খাইয়া লন।”
অবাক হয়ে মানিক বলিল “মাইনে কি ?”
“আরে মাইনে টাইনে কিছু না। চাচী আম্মায় আমারে দিয়া আফনার লাই¹া খাওন পাডাইছে। হাত মুক ধুইয়া তারাতারি দুইডা খাইয়া লন। কেউ দ্যাকলে মায়ের কাছে নালিশ দিবো।”
মানিক পরীর কাছ থেকে পিতলের জগটি নিয়ে হাত মুখ পরিস্কার করে, মাথাটা নিচের দিকে নুয়ে পড়নের লুঙ্গির শেষাংশ দিয়ে হাত মুখ মুছে নিল।
এরপর পরী মানিককে ভাতের বাটিগুলো দিয়ে বলল “ মানিক বাই, ওই তাল গাছের আড়ালে গিয়া খাও।”
মানিক পরীর কথামত তাল গাছের আড়ালে গিয়ে ঘাসের উপর গামছা বিছিয়ে বসে, আর একটি বাধা গামছার মধ্য থেকে খাবার বের করে খেতে বসল। পরীও তাহার সঙ্গে বসল। মানিক গরম ভাত আর আলু ভর্তা দেখে বলল “পরী একটা হাছা কতা কইবা !”
“কও কি কতা ?”
“এই ভাত তো মায় দ্যয়নায়। মায় অসুস্থ, হেয় ভাত রানতে পারবো ক্যামনে ?”
“আমি গিয়া রানছি। হের বাদে চাচি আমারে দিয়া গোপনে পাঠাইয়া দিছে। ক্যান রান্দা খারাপ অইছে।”
“না ভালাই অইছে ”
“ধীরে ধীরে খাওনা, গলায় বাজবো তো।”
বেশ কিছুক্ষণ পর পরী মানিককে বলল “মানিক বাই একখান কতা কমু রাগ অইবানা তো ?”
“না ”
“তুমি কি কোন দিন কাউরে মন দিছো। হাছা কইরা কইবা।”
মানিক প্রথমে কোন উত্তর করলনা। কারণ তার ভিতরে হারানোর ভয় রহিয়াছে। সে গরিব বলিয়া তাহার সাহসও কম।
পরী তার প্রশ্নের জবাব না পাওয়ায় সে আবারও একই প্রশ্ন করলো মানিককে। তখন মানিক মাথা নাড়িয়ে উত্তর করল ‘না’
“তুমি আমারে দ্যখলে কতা কও না ক্যান ? তুমি না ম্যালা বদলাইয়া গ্যছো। ছোডো কালে আমরা কত খ্যলতাম। কত কতা কইতাম !
কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর পরী আবার বলল “কি কইলানা, এই গেরামে কি একটাও সুন্দরী মাইয়া পাও নায় ভাল বাসবার লাই¹া ?”
“পাইলে কি ? আমার ভালা লাগলেই কি অইবো ? হেরও তো আমারে ভালালাগতে অইবো। আমি এক গরিব চাষী। আমার সয় সম্পত্তি জাগা জমি কিছুই নাই। কোন রাইচকইন্না আমারে ভালোবাইস্সা নিকা করবো কও ?”
“মানলাম তোমার জাগা জমি নাই। কেউরে ভালোবাসার লাই¹া কি একটা মোনও নাই। তোমারে কেউ ভালবাসলে কি তারে তুমি ফিরাইয়া দিবা।”
“আমারে ভালাবাসবো এমন পাগল এই দুনিয়ায় নাই। গরিবের লাই¹া পেম পিরিতি একটা অভিশাপ, মহাপাপ। তুমি বড়লোক মাদবরের কইন্না। তোমাগো লাই¹া এই সব মানায়। বিঘায় বিঘায় ধানা জমি কত সয় সম্পত্তি তোমাগো। তুমি আমার ছোট কালের বন্ধু। তোমার মায় মইরা যাওনের পর আমাগো বাড়ী কত আইতা। আমরা গরীব দেইখ্যা এহন আর খবরো ন্যওনা।”
“তুমি জানোনা চাষী, মাইয়া মানুষ চাইলেই সব কিছু করতে পারেনা। মাইয়া মানষের পায় পায় দোষ লাই¹াই থাহে। তয় জানো চাষী, তোমারে না, আমার এক সই তার মন দিতে চায়। তোমারে কইতে সাহোস পায়না। আমারে দিয়া খবর পাঠাইছে।”
“আমার লগে মজা করতাছো।”
“না। কিড়া কইরা কইলাম। তুমি কাইল বিয়ালে বাঁশ বাগানে থাইক্ক। হে তোমারে কাইল জানাইবো। তহনি দ্যখবা, হাছা না মিছা কইলাম।”
পরী এই কথা বলার পর আর বিন্দু মাত্র অপেক্ষা করলনা। সোজা দৌড় দিল সবুজ ঘাসের আঁকা বাঁকা পথ ধরে। মানিকের কাছে সব কিছুই অস্বাভাবিক লাগছে। তবে সব মিলিয়ে খারাপ লাগছে না। মানিক ক্ষেতের কাজ ছেড়ে এসেছে বেশ সময় হয়েছে। তাই তার সহযোগি লুইচ্চা গলা হাকিয়ে বলে “ওই ক্কাকু কামে আইবানা।”
“হ আইতাছি। একটু খাঁড়া।”
মানিক এই বলে ক্ষেতের দিকে হাটতে হাটতে হঠাৎ তার হাটার গতি কমিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইল। ক্ষেতের সকল কৃষকের দৃষ্টি এখন এক দিকে। সবাই কাজ ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরল। মানিক হঠাৎ জোড়ে দৌড় দিয়ে বলল “আরে ধর ধর। দলুরে মাইররাই ফালাইবো।”
ক্ষেতের সকল কৃষক একত্রে দৌড়ে গিয়ে দলুকে বাঁচালো। সেখানে গাঁয়ের মাতব্বরও ছিলো। মারামারি থামানোর পর মাতব্বর কদম আলীকে ফজলে আলী বাহাদুর নামে এক ব্যাক্তি বলল “আফনে ক্যাডা, কোন লাট বাহাদুরের বাচ্চা। আমি দলুরে মাইররাই ফালামু। তাতে কার বাপের কি ?”
ফজলে আলী বাহাদুর মাতবরকে এমন কথা বলার পর মানিক প্রতি উত্তরে বলল “আফনাগো তো সাহস কোম না, আমাগো গেরামে খাড়াইয়া আমাগোই ডড় দ্যহান। এই ব্যাডা! দলুরে মারলে আমরা কি খাড়াইয়া তামাক খামু ?”
মাতব্বর বলল “মানিক তুই থাম, তোমরা কোন গেরামের কও তো ? দলু তোমার লগে কি দেনা পাওনা কও? ব্যবাক মানষে হুনুক।”
“দলুর দারে আমি ট্যাকা পামু। কি কামে য্যান হাজার ট্যাকা আনছে। এক পয়সাও শোধ দেয় নাই। হের পরও কইছি, আমার ক্ষ্যাতে এবার কাম কইররা কিছু শোধ দে। দলু কোনডাই করবোনা। হের লাই¹া মারছি।”
“মিছা কতা, ডাহা মিছা কতা, মাতব্বর হুন আমি আল্যহা-পড়া মানু। ঠ্যহে পইরা ১০০ ট্যাকা হাওলাত করছিলাম। কইছিলাম ধান উঠলে একশো ট্যাকা শোধ দিয়াদিমু আর না পারলে ক্ষ্যাতে কাম কইরা শোধ দিমু।”
“আমি মিছা কতা কই ? তোর মতো চাষা ভূষা ছোট লোকের বাচ্চারা সুযোগ পাইলেই মিছা কতা কইবি, তা আমি জানতাম। হের লাই¹া আমি দলিলে টিপ সই রাখছিলাম। এই দ্যহেন দলিল। আমি আদার ব্যাপারি কাচা কাম করিনা।”
“মানিক, এই দলিলে আমি টিপ সই দি নাই।” দলু কাকতি মিনতি করে মানিককে বলল।
দলুর মত সয় সম্ভলহীন একজন মানুষের কথার কোন মূল্য নেই এ সমাজে। যার টাকা আছে তাহার সাথে সবাই থাকে। আদার ব্যাপারি চোখ ইশারা করে কদম আলী মাতব্বরকে কিছু বলল। কদম আলীও ব্যাপারটি বুঝে গেল। সে আবার দলুকে বলল “দ্যহো দলু তোমার কিন্তু এই অভ্যাসটা আছে। তোমার মাইয়ার নিকার সোমায় কত্ত মানষের থাইক্কা টাকা হাওলাত করছ কও। কারো ট্যাকাতো শোধ কর নাই। তয় আমরা কেমনে বুঝুম তুমি ব্যপারির একশো টাকা নিছো হাজার ট্যাকা নেও নায়।”
“কদম বাই আল্লার কসম খাইয়া কইতাছি, আমি হাজার ট্যাকা নি নাই। আমার কতা কেউ বিশ্বাস লয় না।”
দলুর কাকুতি মিনতি দেখে মানিকের বেশ মায়া হলে সে দলুকে বলল “দেহ দলু কাহা। তুমি কত ট্যাকা আনছ তুমিই ভালা জান। তয় ব্যাপারি সাব দলু কাক্কুারে সোমায় দেন, ধান অইলে শোধ দিয়া দিবো।”
“ঠিক আছে ঠিক আছে কতাডা যেন মোনে থাহে। হোন দলু মিয়া ধান অইলে আমার যেন আবার আইতে না অয়। ভালা মানষের নাহান ট্যাকাগুলা আমার আরোদে(গদিতে) দিয়া আইবা।”
“আমি অশিক্ষিত মূর্খ দেইখা আইজ আমারে ঠকাইলি। আমার মতন দলুর রক্ত খাইয়া তোরা ব্যাপারি অইছো। খা, খা মোন ভইরা খা। আল্লা তোগো খাইতে দিছে খা।”
দলু চোখে জল নিয়ে বাড়ীর দিকে চলিয়া গেল। আর ব্যপারি কদম আলীকে ইশারা করে ডেকে বলল “কদম বাই আপনে চিন্তা লইয়েন না। আমি আপনের ভাগ ঠিকই রাইখা দিমুনে। আমি আবার ব্যবাকের লগে বেঈমানি করিনা।”
“হাছা কইতাছো তো। আচ্ছা ব্যাপারি, দলু তোমার কাছ দিয়া কত ট্যাকা হাওলাত করছিল।”
“এই করছিলো। মাদবর সাব আফনে আমার একটা সাফাই গাইলেই অইবো।”
“হ তুমি ঠিকই কইছো, তুমি মিয়া চোর অইলেও লোক ভালা।”
“অপমান করতাছেন মোনে অইতাছে মাদবর সাব।”
“আরে না না, তোমারে অপমান কইরা ভাগের লোকসান করি। এত বড় পাগোল আমি না।”
“আচ্ছা মাদবর সাব দলুর মতোন কুইররারে কামে রাখবো কেডা। ঐ হালায় আমাগো ট্যাকা ঠিক মতো দিবো তো আবার।”
“হ হ পারবো। ও আবার আলতাব মাষ্টারের ক্ষ্যতে কাম করে। আলতাব মাষ্টার একলা মানু, সবি দলুরে দিয়া দ্যয়। তয় ব্যাপারি, মোনের ভুলেও কেউ য্যন এ ঘটনা না জানতে না পারে।”
“না ক্যডায় আবার জানবো। আফনে এই সব নিয়া চিন্তা নিয়েন না তো। আমি আদার ব্যাপারি কাঁচা কাম করিনা।”
“ব্যাপারি সাব আমি অহন ক্ষ্যতে যাই। আমার লগে যোগাযোগ রাইখো। ভূইল্লা যাইওনা আবার।”
ফজলে আলী বাহাদুর ব্যাপারিও কদম আলীর কথায় হাত ইশারায় উত্তর করে নিজ গন্তব্যে চলিয়া গেল।
এই গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনী কদম আলী মাতব্বর। সেও সুযোগ পেয়ে, দলুর মত একজন নিঃস্ব মানুষের সাথে প্রতারনা করল এবং ব্যাপারি একশত টাকার বদলে হাজার টাকা আদায় করার সুযোগ নিল। কিছু কিছু মানুষ আছে এ সমাজে, যারা গরিব মানুষকে ঠকাতে খুব পছন্দ করে। তাদের মধ্যে একজন কদম আলী।

বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৮:১১   ৮১৩ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ