……….আজ ২য় পর্ব শুরু।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাবুল রেগে মেগে ধানের বীজগুলো সাজিতে সাজিয়ে লুঙ্গিটাকে নেংটির মত করে দু’পায়ের ফাঁকে গুজে নিয়ে খালি পায়ে ক্ষেতে রওনা হল। তখন ক্ষেতে মানিক, ট্যাপা ও লুইচ্চা কাজ করিতেছিল। ক্ষেতে হাল চাষ আজই শেষ হল। এখন শুধু ধানের বীজ বুনবার পালা। কাদার মধ্যে আধ হাঁটু নেমে ওরা তিন জনই আবর্জনা পরিস্কার করছিল। ঠিক এমন সময় বাবুল ক্ষেতের সামনে ধানের বীজ নিয়ে হাজির।
লুইচ্চা বাবুলকে দেখা মাত্র ট্যাপাকে বলল “আরে বাবুল কাক্কুর মাতাইদ্দা জোলদি হাঝিডা নামা গিয়া।”
ট্যাপাও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল “হ হ যাইতাছি, কাক্কু একটু খাড়ান আমি আইতাছি।”
গ্রামের মানুষ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে না, বললেই চলে। তাই ওরা কাকাকে কাক্কু বলে ডাকে।
আজকাল ও পরশুর মধ্যে কম বেশি সব কৃষকই তার নিদিষ্ট জমিতে ধানের বীজ বপণ করবে। বিসমিল্লহ বলে বাবুল, মানিক, ট্যাপা ও লুইচ্চা ধানের বীজের আঁটি গুলো খুলে খুলে দুই আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে নরম কাদা মাটির মধ্যে পুঁতে দিচ্ছে। কৃষকরা যখন ধান রোপন করে তখন নামাজের রুকুর মত নুয়ে একত্রে চার পাঁচটা চারা গাছ পাঁচ আঙ্গুল পর পর বপণ করে। এ গ্রামের প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষিকাজ। যত জমিদার মাতব্বর হোক না কেন, প্রত্যেকের অন্তত একটা করে মহিষের হাল আছেই। এই মহিষের হাল এক পর্যায়ে কৃষকদের পরিচয় বহন করে। কৃষকরা তাদের ছেলে মেয়ে বিবাহ করাতে গেলে বলে যে, ছেলের তিনটা চারটা মহিষের হাল আছে, বিঘায় বিঘায় ধানা জমি আছে। তাহলেই কনে পক্ষরা বুঝতে পারে বিশাল বড় পরিবারের ছেলে। এর সাথে সম্বন্ধ করা যায়। চার চারটা মহিষের হাল ! এটা কি চারটি খানি কথা ?
সকাল থেকে সূর্য অস্ত পর্যন্ত কৃষকরা জমিতে ধানের বীজ বপণ করতে থাকে। কাজের মধ্যে তারা আবার নানা রকম আলাপ করে, যেমন এ গাঁয়ের মধ্যে কে বেশি খারাপ আবার কে বেশি ভাল? যুবক কৃষকরা বেশির ভাগই প্রেমের আলাপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কে কার সঙ্গে কটা প্রেম করে কিংবা কে বিয়ে করল ? কে ঘর জামাই থাকে? এসব আলাপ ই বেশি হয়, তবে যারা রাজনীতি বুঝে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক আলাপও করে। মানিকের গানের গলা কিন্তু বেশ। সে কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে জোড় গলায় গান ধরে। তার গানে নিজেকে খুব দুঃখী মানুষ মনে করে, এমনটাই প্রকাশ পায়। মানিকের গানের সঙ্গে ট্যাপা, লুইচ্চাও সুর মিলায়।
প্রায় হাটু পর্যন্ত কাদার মধ্যে নামিয়া কাজ করার পর কৃষকদের আর চিনিবার মত উপায় থাকেনা। সারা অঙ্গ হাত, পা, মাথা কাদায় লেপে থাকে। সাঁঝের বেলা যখন কাজ শেষে সব কৃষকরা বাড়ী ফিরে পুকুর ঘাটে গোসল করতে যায়, তখন দেখলে মনে হয় যেন ছোট খাটো একটা মেলা বসেছে। কেহ কেহ পুকুরে অর্ধেক নেমে আবার কেহ কেহ পুকুরের মধ্যে নেমে ডুব দিয়ে গোসল করে, কিন্তু কেহই সাবান ব্যবহার করে না। গোসল করার পর পুকুর থেকে উঠে সকলেই ভিজা কাপড়ে বাড়ী ফিরে।
বাবুল গোসল করে উঠে ট্যাপা, লুইচ্চাকে তার সঙ্গে ডাকিয়া লইয়া গেল তাহার বাড়ীতে ভাত খাওয়ানের জন্য। এর কিছুক্ষণ পর মানিকও বাড়ী চলে এলো। শরীরের ভিজা কাপড় বদল করে তার মাকে ডেকে বলল ” মা, ওমা তুমি কই ?”
মানিকের মা মাগরিবের নামাজ শেষ করে হাতে একটি কেরসিনের বাতি নিয়ে দরজার সামনে এগিয়ে এসে বলল “কেডা মানিক, তুই আইছস বাপ ?”
“হ মা আইছি।”
“এবার দুইডা খইয়া ল।”
“খামু ! আইজ কি সালুন রানছো মা ?”
“নিরামিশ সালুন।”
“মা ঘরে কি তুইত্তা আছে ?”
“না বাপ তুইত্তা নাই, কি করবি ?”
মানিক তার মাকে জবাবে বলল “আমার ঠ্যং এর অবস্তা শ্যাস, হারা দিন কাদা পানির মদ্যে থাকতে থাকতে আঙ্গুলের ফাঁকের মাংসো নাই। প্যাকে সব খাইয়া ফালাইছে।”
“তুই ভাত খা, আমি পরীগো বাড়ীদ্দা আই। পরীর বাপেরে দ্যখলাম হে দিন হাড থাইক্কা তুইত্তা আনতে।
“হ মা যাও। জোলদি আইও কইলাম।”
এরপর মানিক ঘরে গিয়ে, মাটিতে মাদুর পেতে ভাতের হাড়ি থেকে কাসার খাড়া একটি প্লেটে ভাত নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করল। গ্রামে কাসার প্লেট বাটিরই প্রচলন বেশি। পানি পান করার জন্য বড় বড় কাসার বাটি ব্যবহার করা হয়। কারণ একটি বাটিতে তিন চার গ্লাস পানি ধরে। তাছাড়া এটি ভাংগারও ভয় থাকেনা বলে তারা ব্যবহার করে। মানিক ও তার মা একটি বাটিতে পানি পান করে। সারাদিন ক্ষেতে ক্ষামারে কাজ করার পর সাঁঝের বেলা নিরামিশ তরকারি দিয়ে ভাত খাবার পর, পরনের লুঙ্গি দিয়ে হাত মুখ মুছে পাটিতেই শুঁয়ে পড়ল মানিক। আর বলল “হে আল্লাহ ভালই খাওয়াইলেন।”
মানিকের মা বুড়ো মানুষ, সে হারিকেন নিয়ে ধীরে ধীরে পরীদের বাড়ীর সামনে গিয়ে পরীর নাম ধরে ডেকে বলল “পরী, মা পরী বাড়ী আছ ?”
পরীও বাড়ীর ভিতর থেকে উত্তর করতে করতে দরজার সামনে এসে বলল “কেডা ? ও চাচি ? কেমন আছেন ?”
“আমি ভালা আছি। তুই তো আর আমাগো বাড়ী যাস টাস না, কয় দিন ধইরা জ্বরে মরি। কেডা রানদে কেডা খায় ক ?”
“কই জানিনা তো আফনের জ্বর! জানলে জাইতাম। কাইল যামুনে। চাচি আম্মা মানিক ভাই কেমন আছে ?”
“মানিকের পাও প্যাক কাদায় খাইছে। হের লাই¹া একটু তুইত্তা ওষুধ নিতে আইলাম, তোর মায় কই?”
“মোনে হয় পুকুর ঘাটে ওজু বানাইতে গ্যাছে। আফনে একটু খাড়ান আমি তুইত্তা আনতাছি।”
পরী ঘরের ভিতরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর কাগজে মুড়িয়ে কিছু তুইত্তা নামক ঔষধ নিয়ে মানিকের মাকে দিবে ঠিক এমন সময় পরীর মা পুকুর ঘাট থেকে এসে বলল “পরী তুই কি দ্যাস রে ?”
“মা একটু তুইত্তা দিতাছি।”
“ক্যান, তোর বাপের জিনিস তুই ধরছোস ক্যা! তোর বাপের রাগ তুই জানোস না, আইজ তোরে আস্তা রাখবনা।”
“একটু ওষুদ দিলে কি অইবো!”
“আরে ছেরি কয় কি ? মাইয়া আমার দানশীল হাতেমতায়ী অইছে দেহি ”
এর কিছুক্ষণ পর পরীর মা মানিকের মাকে লক্ষ করিয়া বলল “আফনের বা কেমন আক্কেল, একটু তুইত্তার জইন্নে একজনার বাড়ী আইয়া পরছেন। এ গ্রামে কি দোহান পাট নাই।”
অপমানিত হয়ে মানিকের মা ঔষধ না নিয়ে নিজের বাড়ীর দিকে হাটা আরম্ভ^ করলো। পরীও মন খারাপ করে ঘরের সামনের সিঁড়ির উপর বসে রইলো।
পরী মাতব্বরের কন্যা। জন্মের কিছু দিন পর পরই মাকে হারিয়ে এতিম হয়ে সত্ মায়ের অনাদরে বড় হয়েছে। বয়স তাহার যৌবন নদীতে তরী ভাসাইছে সবে মাত্র। এই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী কন্যা সে। বাবা কদম আলী মাতব্বর দ্বিতীয় বিবাহ করেছে একমাত্র পরীর জন্যই, পরী এত ছোটবেলা মাকে হারাইছে যে তার জন্য মা খুবই জরুরী ছিল। কিন্তু সত্ মায়ের অবহেলা অনাদর ভুলিয়ে দিয়াছে যে সত্যিকারের মায়ের আদর কেমন হয়। কদম আলী গাঁয়ের মাতব্বর হলেও একজন আর্দশ কৃষক। সেও কৃষি কাজ করে।
গাঁয়ের মাতব্বর হলেও কেহ তাকে মানতে চায়না, এই জন্য সে তিনবার মেম্বর পদে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ছিলেন, কিন্তু এক বারও জিততে পারেনি। গাঁয়ের মানুষই তাকে ভোট দেয়না।
মানিকের মা অপমানিত হয়ে, নিজের ঘরের সামনে গিয়ে পিড়িঁ পেতে বসে রাগে পরীর মাকে বলতে লাগল “গরিব অইতে পারি তয় খয়রাতি না। একটু আকটু জিনিস চোখে সয়না, দুনিয়ার ছোডলোক।”
এমন প্রলব বকতে বকতে জোরে নিশ্বাঃস নিচ্ছে সে।
মানিক তার মায়ের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল “কি অইছে মা, কারে আবার কি কইতাছ ?”
“কারে আবার কি কমু ? কই পরীর মায়রে। একটু খানে তুইত্তা ইতো, তাই পরানে সয়না। পরী না জানি কত শরম পাইছে। হতি মা হতিই অয় আপোন অয়না।”
“থাউক না মা, বাদ দ্যও। আমি সামনের দোকান পাড় দিয়া আনমুনে। তুমি ঘরে গিয়া বহো, আমি একটু বাজারে ঘোরা দিয়া আই।”
এই বলে মানিক পাড়ার দোকানের সামনে গেল, সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য। মানিকের মা রাগান্বিত হয়ে ওখানেই বসে রইলো। রাতের বেলা অন্ধকার রাস্তার মধ্যে দিয়ে হেটে হেটে পাড়ার চায়ের দোকানেই মানিক এলো। সন্ধ্যা হলে পাড়ার চায়ের দোকানগুলো বেশ জম জমাট হয়ে উঠে। গাঁয়ের যুবক বুড়ো প্রায় সবাই আসে চায়ের দোকানে আড্ডা দেবার জন্য। এ গাঁয়ে গোনা কয়েকটা চায়ের দোকান আছে। দোকানগুলো একটার সঙ্গে আর একটা মিশানো। এবং প্রত্যেক দোকানই টিনের বেড়া ও খড়ের চাল দিয়ে তৈরী। দোকানের সামনে বসবার জন্যও তেমন কোন বেঞ্চের ব্যবস্থাও নেই। দোকানের সামনে বড় বড় গাছের গুড়ি ফালানো আছে তাতেই মানুষ বেশ আরাম করে বসে। এসব দোকানে চা বিস্কুট ছাড়া তেমন ভাল কিছু পাওয়া যায়না। ভাল কিছু বলতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রাব্য চাল ডাল নুন ইত্যাদি পাওয়া যায়না। এসব জিনিস কিনতে হলে গঞ্জের হাটে যেতে হয়। গঞ্জের হাট ছাড়া কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়। সে হাট আবার সপ্তাহে একদিন বসে-শুক্রবার। হাটবার দিন গাঁয়ে পুরুষ মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গঞ্জের হাটে ভীড়ের অন্ত থাকেনা। কারণ হাট বার দিন সব কিছু সস্তা দামে পাওয়া যায়। এ গাঁয়ের মানুষ এমনি অভ্যাস করে নিয়াছে, তারা এক দিনে সপ্তাহের সব বাজার করে নিতে পারে। গঞ্জের সে হাটটি এ গ্রাম হতে চার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। পিংড়ি গ্রামের মানুষ হাট বার দিন মাথায় করে বাঁশের একটা সাজী নিয়ে পায়ে হেটে গঞ্জের হাটে যায়। এ পল্লীতে ভাল কোন পাকা রাস্তা নাই। পুরোটাই মাটির তৈরী। দু’পাশে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে আঁকা বাঁকা উচু নিচু মাটির রাস্তা। শুকনোর দিনে যাও একটু পায়ে হেটে, হাট বাজারে যাওয়া যায়। কিন্তু বর্ষার সময় গাঁয়ের মানুষের দুঃখের আর শেষ থাকেনা। কম হলেও এক হাঁটু কাদাতো হবেই। কাদা হলে আর কি করা। তখন পড়নের লুঙ্গিটাকে ন্যংটির মত করে কাদার মধ্যে দিয়ে হাটে যায়। হাটের আসে পাশে এমনি মুদি মনোহারির দোকান পাট আছে কিন্তু হাটবার দিন সব পাওয়া যায়। বিভিন্ন গ্রামের লোক এই হাটে আসে বেচা কিনা করার জন্য। শুক্রবারের হাটটি একটি বুড়ো শতাধিক বছরের বট গাছের নীচে বসে। দীর্ঘ পনের বছর ধরে এই বট গাছের নীচে হাট মিলে। মূল রাস্তার দু পাশে বসে হাট, আর হাটের পাশেই নদীর ঘাট। এই সেই ধানসিঁড়ী নদী। এই নদী পথে যেতে হয় শহরের দিকে।
গঞ্জের হাটে পল্লী বিদ্যুত আছে, যোগাযোগ ব্যবস্থাও চরম উন্নতি। হাটের পাশেই আছে ফেরিঘাট লঞ্চঘাট। সারা দিন-রাত মানুষের হৈচৈ আছেই। তাই এই পাড়ায় সব চাকুরিজীবি লোক থাকে। সরকারি বেসরকারি সব ধরনের চাকরিজীবি লোক এই পাড়ায় বাস করে। এমন কি এই পাড়ায় স্কুল,কলেজ হাসপাতাল সব আছে। যত ভদ্র রুচিশীল লোক আছে তাহারা সবাই গঞ্জের শহরে থাকেন। ঐ সব ভদ্র লোক মনের ভুলেও কৃষকদের পল্লীতে ঘৃণা করে আসেনা। কৃষক শ্রমজীবি মানুষ নোংরা ইতর অশিক্ষিত বলে সমাজের অনেক উচ্চ বৃত্তির লোক তাহাদের ঘৃণা করে।
এই উচ্চবৃত্তি লোকের ঘৃণাই একদিন গোটা বাঙালি জাতিকে পথে দাঁড় করাবে। আগের দিনের মত এখন আর কৃষকের ছেলে কৃষক হয়না। কৃষকের ছেলেরা এখন লেখাপড়া করে সমাজের আট দশটা অন্য পেশার মত পেশায় নিযুক্ত হতে চায়। উচ্চবৃত্তির লোকের উপহাস, ঘৃণাই তাদের কৃষি পেশা ছাড়তে বাধ্য করছে। যার কারণে কৃষি পরিবারে কৃষকদের অভাব লক্ষ্য করা যাইতেছে। গোলা ভরা ধান পুকুড় ভরা মাছ গোয়াল ভরা গরু এখন আর তাদের নাই।
বাংলাদেশ সময়: ০:১৭:১৩ ৫৯৬ বার পঠিত