“কহিবে না কথা তুমি ! আজ মনে হয়,
প্রেম সত্য চিরন্তর, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তর নয়।
জন্ম যার কামনার বীজে
কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে”
—–কাজী নজরুল ইসলাম
সুখকাঁটা পর্ব-১ এক অনাকাঙ্খিত ব্যথা।
হাসি,কান্না ও গ্রাম বাংলার একটি প্রেমের উপন্যাস
বাংলার জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাস শেষ।
মাঠ ঘাটের জমে থাকা বর্ষার পানি কিছুটা কমতে আরম্ভ করেছে। এখনই কৃষকরা মাঠে লাঙ্গল করে আমন ধানের বীজ বপন করবে। আষাঢ় মাসে ক্ষেত তৈরী করে কাদা মাটিতেই আমন ধানের বীজ বুনেছিল। এখন সে চারাগুলো নতুন করে মাটির গোড়া থেকে তুলে আঁটি করে পরের দিন অন্য ক্ষেতে বপন করবে। তখন কোন কোন ক্ষেতে আদা হাটু পানি থাকতেও পারে। কিছুদিন হল এই পানি কমিয়াছে। জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসেও এই পানিতে সাদা শাপলা ফুটে থাকত। বর্ষার পানিতে বিল ঝিল থৈ থৈ করত। কলাগাছের ভেলা দিয়ে গাঁয়ের ছেলেরা সে পানিতে ভেসে ভেড়াত। আষাঢ় মাসের অবসান হয়ে নতুন মাসের আগমন হল।
এখন শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ চলিতেছে। এখন মাঝে মাঝে ঘন বৃষ্টি আবার বেশ খড়া লক্ষ্য করা যায়। খড়া বলে কোন খড়া, যখন আকাশে রোদ উঠে তখন ঘর থেকে একপাও বাহিরে দেওয়া যায়না। মনে হয় এই বুঝি গা আগুনে পুরে যাবে। আবার যখনই রোদ কেটে মেঘের ভাব হবে তখনও বিপদ, ঝপ করে এমন বৃষ্টি নামবে যে বৃষ্টিতে ভিজলে এত কঠিন ঠান্ডা জ্বড়ে পেয়ে বসবে ঔষধ খেলে সাত দিন আর না খেলে এক সপ্তাহ বিছানাই কাটাতে হবে। আর এই গুড়া গুড়া বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় গাঁয়ের মাটির তৈরী রাস্তাঘাটগুলো। তখন এক হাটুর মত কাদা থাকে সব রাস্তায়।
বাংলার কোন কৃষকের হাতে মোটেও সময় নাই। সবাই অতি ব্যস্ত। এই মাসের মধ্যে আমন ধানের বীজ বপণ করতেই হবে। তা না হলে কৃষকদের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে। শ্রাবণ মাসে আমন ধানের বীজ বপন না করলে অগ্রহায়ণ পৌস মাসে ধান কাটকে পারবেনা। বীজ বপণের সময় এলে কৃষকদের আরামের দিকে আর হুঁশ থাকেনা। খুব ভোরে উঠিয়া তাদের লাঙ্গল বলদ নিয়ে মাঠে যেতে হয়। সারাদিন জোড়া বলদের পিঠে লাঙ্গল বসিয়ে বিঘা চার পাঁচেক জমি চাষ দিতে হয়। বিঘা চার পাঁচেক জমি চাষ দিতে কৃষকদের সপ্তা খানিক সময় লাগে বৈ কি! পল্লীর প্রায় সকল কৃষকদের চার পাঁচ বিঘার মত নিজ সম্পত্তি থাকে চাষাবাদ করার জন্য। আর বাকী যে অল্প সম্পত্তি আছে তা কেবল থাকার জন্য, ভিটা বাড়ী। কোন কৃষকই নিজ অর্থ-কড়ি খরচ করিয়া এই সম্পত্তি ক্রয় করে নাই। প্রত্যেকেই পিতৃ সম্পত্তি ভোগ করিতেছে। কারণ কৃষকরা প্রতেকটা দিনই দারিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া বেঁচে থাকে। সম্পত্তি সঞ্চয় করিবার মত অর্থ কোথায় ? শ্রাবণ ভাদ্র মাসে কৃষকদের কাজে কোন কামাই নেই। জমির মাটি গুলোকে লাঙ্গলের ফলা দিয়ে ভালভাবে উলট পালট করার জন্য জোড়া বলদের কাধে বাশেঁর খাপের সঙ্গে লাঙ্গটি ভালভাবে লাগিয়ে নেয়। দুটি বলদ দু’পাশে দাঁড় করে তার মধ্যে লাঙ্গলের ফলাটি, হাফ ফুটের মত মাটির মধ্যে গেঁথে নেয় আর একটি বাঁকা ধরণী থাকে, যা কৃষকের বাঁ হাতে ধরা থাকে। এবং কৃষকের ডান হাতে থাকে একটি শক্ত লাঠি, বলদ পিটানোর জন্য। লাঙ্গলের সঙ্গে একটি রশি দিয়ে বাঁশের তৈরী মইটিকে বেধে নেয় এবং মইটি মাটির সাথে শোয়ানো থাকে, সেই মই এর উপর রাখাল দাঁড়ানো থাকে। রাখাল তার এক হাত দিয়ে শক্ত করে লাঙ্গল ধরে অন্য হাতে লাঠি নিয়ে বলদ জোড়াকে ডানে বাঁয়ে নিয়ন্ত্রন করে। মই এর উপর রাখাল দাঁড়িয়ে থাকার ফলে ক্ষেতের মাটিগুলো আবার সমান হয়ে যায়। পুরো মাঠে এভাবে তিন চার বার চাষ দিতে হয়। এরপরও নানান কাজ করতে হয় কৃষকদের, জমিতে পানি সেচ দেওয়া, জমির চারপাশে নরম কাদা মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া। গরু মহিষদের গাঙ্গে নিয়ে ভালভাবে গোসল করানো, এরপর তাদের তাজা ঘাস কিংবা শুকনো খড় কেটে খাওয়ানো। কৃষকরা ঠিক মত খাক বা না খাক, গরু মহিষদের ঠিকমত খাবার খায়িয়ে মোটাতাজা রাখতে হয়। তাছাড়া বৈকালে গরু মহিষদের ভাতের মাড় খায়ানো হয়। কৃষকদের বৌয়েরা ভাতের মাড় গরুর জন্য জমা করে রাখে। কৃষকরা ভোর বেলা গরু মহিষের পাল নিয়ে মাঠে যায় আর সাঁঝের বেলা বাড়ী ফিরে। দুপুরে বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে একত্রে ভাত খাবার সৌভাগ্যটুকো কৃষকদের কপালে জুটেনা বললেই চলে। তবে বিবাহিত কৃষকদের কথা কিছুটা আলাদা। তারা সকাল ও দুপুরের খাবার ক্ষেতে বসেই খেয়ে নেয়। তাদের বৌরা কিংবা ছেলেমেয়েরা বাবার জন্য ক্ষেতে খামারে খাবার নিয়ে যায়। বড় একটি কাসার খাড়া প্লেটে পানতা ভাত এর সঙ্গে দুটো পোড়া মরিচ ও অল্প কিছু আলু ভর্তা বা অন্য কোন ভর্তা একত্রে একটি গামছা দিয়ে বেধে নিয়ে যায়। তখন কৃষকরা বলদের হাল জোড়াকে ক্ষেতের মধ্যে দাঁড় করে কোন এক গাছের ছায়ায় এসে সকালের খাবার খেয়ে আবার কাজে নেমে পরে। তাদের কাজে কোন বিরাম নাই। সূর্যের কড়া রোদেও তারা বিন্দু মাত্র বিশ্রাম নেবার সময় পায় না। এই কৃষকরাই গোটা বাঙালী জাতির জন্য অন্ন জোগানোর চেষ্টা করে। সকল কৃষকরা যখন একত্রে মাঠে কৃষি কাজ করে, তখন দূর থেকে দেখলে মনে হয়, কিছু সাহসী মানুষরা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করছে।
মানিক মিয়া এক অসহায় কৃষক। তার নিজের কোন জমা জমি নাই চাষাবাদ করার জন্য। সে তার সত্ বড় ভাইদের জমিতে কাজ করে। মানিকের সাথে আরও দু জন চুক্তিতে কাজ করে, ট্যাপা ও লুইচ্চা। তাদের ভাল নাম তারা নিজেরাও জানেনা। তবে লুইচ্চা ক্লাস টু পাস, অভাবের কারণে আর বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারে নাই। লুইচ্চা বলে তার নাম নাকি নূর ইসলাম। যদিও তাকে কেহ এই নামে ডাকেনা কারণ মানুষের বাড়ীতে কাজ করে বলে কেহ তাদের সম্মান দিতে চায় না। এই নিয়ে তাহাদের মনে কোন দুঃখও লক্ষ করা যায়না। মানিক এই দু জনকে তিন মাসের জন্য কাজে রেখেছে, ধান বপণ থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত এরা থাকবে। এই তিন মাস পেটে ভাতে কাজ করবে আর ধান পাকলে এক এক জনকে মণ তিনেক ধান দিবে মালিক পক্ষ থেকে। এটাই তাদের উপযুক্ত মজুরী হিসাবে মনে করে তারা। শ্রাবণ মাসের পর আসে ভাদ্র মাস। এই ভাদ্র মাসে কৃষকদের ইরি ধানের চাষ করতে হয়। ধান বপণ করার সময় এলে, বিভিন্ন গ্রাম হতে ট্যাপা ও লুইচ্চার মত বহু লোক কাজের জন্য এই গাঁয়ে মানুষের বাড়ীতে ভীড় জমায়। মানিকের একলাই সব দিক সামাল দিতে হয়। তাহার জন্য কেহ ক্ষেতে খাবার নিয়ে আসেনা। কারণ তাহার চার কূলে কেহ নাই বললে খুব একটা ভুল হবেনা। আর মানিকও লাঙ্গলের হাল ছাড়িয়া বাড়ীতে গিয়ে পানতা খেতে পারেনা। সব কৃষক যখন লাঙ্গলের হাল দাঁড় করে পানতা খেয়ে নেয় তখন মানিক খুব দুঃখ করে বলে “হালার পোড়া কফাল আমার।”
মানিক এতিম। তার পিতা আতাহার আলীর প্রথম সহধর্মিণী সবুরা বিবি দুই সন্তান রেখে ইন্তেকাল করার বছর দুই পর পরই আবার সর্মেতবানুকে বিবাহ করিয়া ঘরে তোলেন। আতাহার আলী সর্মেতবানুর সঙ্গেও বেশি দিন সংসার করতে পারেন নি। সর্মেতবানুর গর্ভে মানিক থাকা অবস্থায় আতাহার আলীর মরণ ব্যধি ক্যান্সার রোগে মৃত্যু হয়। খুব অল্প বয়সেই বিধবা হলেন সর্মেতবানু। আতাহার আলীর মৃত্যুর চার-পাঁচ মাস পরপরই মানিকের জন্ম হয়, তখন মানিকের বড় দু ভাইয়ের ভাল মন্দ বুঝিবার মত যথেষ্ট বয়স হইয়াছে। আতাহার আলী মৃত্যুর র্পূবে, আগের ঘরের ও শেষের ঘরের সন্তানদের সম্পত্তি ভাগ করিয়া দিয়ে যেতে পারে নাই।
মানিকের মা এই পিংড়ি গ্রামের নতুন বৌ। এ গাঁয়ে তার তেমন একটা পরিচিতি নাই। তবে জন্ম সূত্রে তিনি এই গ্রামের বাসিন্দা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা সবাই এই পিংড়ি গ্রাম ত্যাগ করে বহু দুরে গিয়ে একটি অজপাড়া গাঁয়ে আশ্রয় নেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর ফিরে এলেও তাদের বিঘা বিঘা জমি আর তাদের আওত্তে ছিল না, সব সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। জমি নিয়ে কেস মামলাও করে ছিলেন সর্মেতবানুর পিতা। কিস্তু এই কেস মামলার শেষ দেখে যাবার র্পূবেই তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। চৌদ্দ পনের বছরের সর্মেতবানুকে নিয়ে তার মা আবার চলে যায় সেই অজপাড়া গাঁয়ে। কোন এক কারণে সর্মেতবানু আবার এই পিংড়ী গ্রামেই বউ হয়ে আসে।
সর্মেতবানুর স্বামী, আতাহার আলীর মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই সম্পত্তি ভাগের এক কলহ সৃষ্টি হল গাঁয়ের মধ্যে। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মৃত আতাহার আলীর সকল সম্পত্তি গ্রামের কিছু লোক আবুল বাবুলের পক্ষে কোলটানা ভাগ করিয়া দিলেন। এই কোলটানা ভাগের ফলে প্রাচীন আমলের জমিদারদের সূর্য আইনের মত, মানিক তার ভাগের সকল সম্পত্তি হারিয়েছে। যখন সম্পত্তি ভাগ হয় তখন মানিকের বয়স প্রায় এক বছর দু মাস। গ্রামের বিচারকেরা মানিক ও তার মাকে আলাদা করিয়া দূরে একটি ভিটা বাড়ির জায়গা দেয়। যা আবুল-বাবুলের নামে পাওয়া সম্পত্তির শত ভাগের এক ভাগের সমান। মানিক যদি তার বাবার সম্পত্তি পাইয়া থাকে তবে এই বাড়ীটাই পেয়েছে। আর মানিকের সত্ দুই ভাই আবুল ও বাবুল বসত বাড়ীর জায়গাই পেয়েছে বিঘা তিনেক জমি। সর্মেতবানু এই সম্পত্তি ভাগ নিয়ে কোন প্রতিবাদ করে নাই ও বিচার সালিশ ডাকেনি, এই ভাবিয়া যে তাহার স্বামী নাই। যে নারীর স্বামী না থাকে তাহার কথার মূল্যও আমাদের সমাজে খুব একটা হয়না। মানিক আজ বড় হয়েও তার বড় ভাইদের কাছে পৈত্তিক সম্পত্তির ভাগ চায়না, কারণ মানিকের কোন অর্থ সম্পত্তির লোভ নাই।
মানিক এখন বড় হইয়া তার সত্ ভাইদের জমিতেই কৃষি কাজ করে। কাজের বিনিময়ে আবুল ও বাবুল যা দেয় তাতে মানিক ও তার মায়ের হরহামেশাই কেটে যায়। ছোট একটি একচালা খড়ের ঘরে মানিক ও তার মা বাস করে। মানিকের বাড়ী হতে তার বড় দু’ভাইয়ের বাড়ী বেশ দূরে।
মানিকের মা আজ বেশ ক’দিন থেকেই অসুস্থ। মানিকের কোন জমানো পুঁজি না থাকায় সে তার মায়ের ভাল করে চিকিৎসা করাতে পারছেনা। আবুল-বাবুল, মানিককে তার পরিশ্রমের এক বিন্দু ও বেশি পারিশ্রমিক দেয় না। মানিকও জোড় গলায় প্রতিবাদ করেনা, কারণ সে একজন লাঙ্গল ভূমি ও বলদ হীন অসহায় কৃষক। প্রতিবাদে সব হারানোর মত এত বোকা মানিক নয়।
আবুল ক্ষেতে খামারের ধারে কাছেও যায়না। বিয়ের পর গঞ্জের হাটে একটি ভেজষ চিকিৎসালয়ের দোকান দিয়াছে। বাবুলের তো কোন কথাই নাই, বছর খানেক আগে ভাগিয়ে এনে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে কিন্তু এখনও সংসারি হতে পারে নাই। সংসারের প্রতি এখনো তাহার মন বসেনি। গ্রামের সম বয়সী ছেলেদের নিয়ে আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় ও যাত্রা পালার মহড়া করে। বড় ভাই বললে বাবুল মাঝে মাঝে মানিকের সাথে ক্ষেতে গিয়ে হাল চাষে সাহায্য করে।
আজ সকালে আবুল রেগে গিয়ে বাবুলকে বলল “গতরে আর কত হাওয়া লাগাবি! যা মাইনকার লগে ধানের বীজগুলা বুন গিয়া। আমি গঞ্জে গেলাম।”
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৮:৫৫ ৫২৮ বার পঠিত