বঙ্গ-নিউজ ডট কম:প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০১৪ সালের সর্বশেষ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। তবে গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিনিয়োগ তার তুলনায় বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী নেতাদের প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে এ বিনিয়োগের হিসাব বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজনেস কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং (বিসিআইইউ)-এর প থেকে দেয়া মধ্যাহ্নভোজসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। হোটেল গ্র্যান্ড হায়াতের ইম্পেরিয়াল হলে আয়োজিত এ ভোজসভায় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন রয়েছে তার সরকারের। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রতি বছর যখনই আসি আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগটি নিতে চাই। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে বাংলাদেশে ভিশন ২০২১-এর আওতায় যে অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলো আনা হচ্ছে, তা আপনাদের জানানো। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সাথে বৈঠকে এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবদুস সোবহান সিকদার, সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদ ও এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশে তৈরী পোশাক খাতে আরো বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৪০ লাখ শ্রমিকের এ শিল্প খাত, যার ৯০ শতাংশই নারী কর্মশক্তি আরো এগিয়ে যেতে পারবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নারীর মতায়ন নিশ্চিত হবে। মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমুদ্রে যে অগাধ জলরাশির অধিকার পেয়েছে সেখানে সমুদ্রতলদেশে জ্বালানি ও খনিজসম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। এ সম্পদ আহরণে বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর এ কাজেও অন্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি কোম্পানি কাজ পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রফতানিপণ্যের, বিশেষ করে তৈরী পোশাকের প্রধান গন্তব্য। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোতে বাংলাদেশ ৮ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিচ্ছে। তিনি জানান, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি করেছে, যার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র্র বাংলাদেশের কাছ থেকে ৮৩২ মিলিয়ন ডলারের শুল্ক পেয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পণ্য পাঠানোর েেত্র বন্দরগুলো শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলে এখানকার খুচরা বিক্রেতাদের অনেক অর্থ বেঁচে যেত। আর তাতে আমাদের দেশে যে শ্রমিকেরা এ পোশাক তৈরি করছে তাদের মজুরি ও সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হতো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র্র থেকে বাংলাদেশে এখন যে ৩৩১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হচ্ছে তা এই খাতে সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ছাড়াও সম্প্রতি অন্য কিছু অর্থনৈতিক খাতে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর পরেও আমাদের বিনিয়োগ প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে আমরা বিনিয়োগ নীতিকে অনেক বেশি শিথিল করেছি, রয়েছে অর্থনৈতিক ছাড় ও সুবিধা। এ প্রসঙ্গে সরকারের দেয়া কর অবকাশ, শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কসুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধার কথা উল্লেখ করেন তিনি। সাতটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব জোটেন প্রাইভেট কোম্পানিগুলো জমি লিজ নিয়ে শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করতে পারছে। তিনি বলেন, আমাদের আট কোটি যুবকর্মশক্তি রয়েছে যাদের এই সব শিল্পে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আর উৎপাদিত যেকোনো পণ্যের জন্য রয়েছে ১৬ কোটি মানুষের বিশাল একটি বাজার। তিনি বলেন, দুই দেশই সন্ত্রাসবাদের সমূল উৎপাটন চায়, দূরে সরিয়ে দিতে চায় মৌলবাদ ও চরমপন্থাকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় তিনি মতা নেয়ার সময় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ছিল। ২০০১ সালে মতা ছাড়ার সময় তা দাঁড়িয়েছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। এর কারণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এইএস-এর মতো প্রতিষ্ঠানকে আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিয়েছি। হরিপুর ও মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে এ কোম্পানি ধীরে ধীরে তাদের বিনিয়োগ বহু গুণে বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, তবে দুঃখজনক হচ্ছে, ২০০৯ সালে তার সরকার যখন ফের মতায় ফেরে তখন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ৪০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তিনি বলেন ২০১১ সালের মধ্যে বিনিয়োগ ১১৭ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়। আর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র মোট ৩৩১ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নত করা হয়েছে। তিনি বলেন, চার বছর ধরে আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত থেকে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়েছি। একজন শিানবিসের মজুরি ২০০৯ সালে ছিলো ১ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৩ সালে তা ৫ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়েছে। আইএলও নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শনের জন্য তার সরকার এক হাজার পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছে। আইএলও-আইএফসির সহায়তায় উন্নত কর্মপরিবেশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ১০০টি থেকে ২৩০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বারিত টিকফা চুক্তির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এর মাধ্যমে দুই দেশ প্রথমবারের মতো কৌশলগত সহায়তার যুক্তিতে আবদ্ধ হলো। তিনি বলেন, গত ছয় বছরে বাংলাদেশ সরকার অর্থনীতির েেত্র যে অগ্রগতি এনেছে তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের প্রমাণ এ চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করছে, গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৫৭ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, মাথাপিছু আয় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে, ডাবল ডিজিট থেকে মুদ্রস্ফীতি আবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে প্রায় এক কোটি। তিনি বলেন, এ সময়ে রফতানি আয় তিন গুণ বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন থেকে ৩০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের কোটা ছুঁয়ে এখন ২২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ছাড়াও জাহাজ নির্মাণ, রিসাইকিং, রাসয়নিক সার, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ, ওষুধ শিল্প, সিরামিক, প্লাস্টিক, পাটজাতপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, সমুদ্রসম্পদ আহরণ, পর্যটন, চিকিৎসা উপকরণ, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ল্য হচ্ছে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি শিল্পায়িত মধ্য আয়ের একটি ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। আর ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন বেশি বেশি বিনিয়োগ করুন, নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করুন, অংশীদারিত্ব বাড়ান। আর এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক উচ্চতায় চলে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১:৩৫:৫০ ৩৭৪ বার পঠিত