বঙ্গ-নিউজ ডট কম:রানা প্লাজা ধস, তাজরীনসহ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, তোবার শ্রমিকদের নিয়ে একের পর এক নাটকসহ নানা কারণে তৈরী পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ইমেজ এখন তলানিতে। গত বছরের জুলাই মাসে রফতানিতে যেখানে ২৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল সেখানে চলতি বছরের একই মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১ শতাংশেরও কম। এমন পরিস্থিতিতে তৈরী পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা যখন দিশেহারা, তখনই দরজায় কড়া নাড়ছে আরেকটি ঈদ। স্বাভাবিক কারণেই রফতানি আয়ে ৮১ শতাংশ অবদান রাখা গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্প খাতে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কাও।
জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হতে যাচ্ছে আগামী ৬ অক্টোবর। দুর্গাপূজা শুরু হচ্ছে তারও আগে। ঈদ-পূজা সামনে রেখে তৈরী পোশাক শিল্প খাতে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সে জন্য আগে থেকেই সতর্ক সরকার। ২১ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কোর কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রমিকদের উৎসবভাতা দিতে হবে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। আর চলতি মাসের বেতন পরিশোধ করার জন্য শেষ সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয় ২ অক্টোবর। যদিও নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ৩০ শতাংশ শ্রমিকেরও বেতন-বোনাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি ইংরেজি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে পূর্ববর্তী মাসের বেতন পরিশোধ করার কথা। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ কারখানায়ই বেতন পরিশোধ করা হয় ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে। ২০ শতাংশ শ্রমিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে বেতন পাওয়া মাত্রই শ্রমিকেরা যাতে চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে না যান সে জন্য মালিকেরা এ কৌশল অবলম্বন করেন বলে জানা গেছে। সে অনুযায়ী, যেসব কারখানায় নিয়মিত বেতনভাতা দেয়া হয় সেগুলোর শ্রমিকেরা এবার বেতন পেয়েছেন ১০ থেকে ১৫ দিন আগে। এমতাবস্থায় ঈদের আগে বেতন দেয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি অনেক মালিকপক্ষেরই নেই। আর যেসব কারখানায় বেতন আগে থেকেই অনিয়মিত তাদের ক্ষেত্রে তো পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রম আইনের অস্পষ্টতার সুযোগে শ্রমিকদের ঈদ বোনাস দেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণই নির্ভর করছে মালিকপক্ষের দয়ার ওপর। যদিও ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ হতে পারে হিটলিস্টে থাকা এমন এক হাজার কারখানার একটি তালিকা তৈরি করেছে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। আর গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এমন ৫০০ কারখানার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আশঙ্কা, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র করার এবং উসকানি দেয়ার মতো লোকের অভাবে হবে না।
বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে অন্তত এক হাজার তৈরী পোশাক কারখানা রয়েছে যেগুলোয় কাজের অর্ডার নেই বললেই চলে। এসব কারখানার অনেকগুলোতেই নিয়মিত বেতন হয় না। দুই থেকে চার মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে এমন কারখানার সংখ্যাও কম নয়। এমতাবস্থায় ঈদের আগে অন্তত ৭০ শতাংশ শ্রমিক বেতন পাবেন না। যেসব কারখানার অবস্থা ভালো সেখানকার শ্রমিকেরা থোক বরাদ্দ হিসেবে কিছু বোনাস পেলেও কয়েক লাখ শ্রমিককে ঈদ করতে হবে খালি হাতে।
ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন বোনাস পরিশোধে মালিকপক্ষের উদ্যোগহীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, এমন অনেক কারখানা রয়েছে যেগুলোতে দুই-তিন মাসের বেতন বাকি। আবার অনেক কারখানার মালিক কৌশল হিসেবে আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধে বিলম্ব করেছেন, যাতে সেপ্টেম্বর মাসের বেতনের জন্য শ্রমিকেরা চাপ দিতে না পারেন। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে প্রত্যেক শ্রমিককে এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ বোনাস দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় শ্রমিকসমাজ দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।
যদিও ঈদের আগে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এবার ঈদ ও পূজা একসাথে হওয়াতে আমরা বেশি সচেতন। পোশাক কারখানা মালিকদের ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উৎসবভাতা ও চলতি মাসের বেতন ২ অক্টোবরের মধ্যে পরিশোধের অনুরোধ করেছি। তারা আমাদের সাথে একমত হয়েছেন। সুবিধামতো সময়ে বোনাস ও বেতন দেয়া শুরু করতে পারবেন মালিকেরা, তবে শেষ করতে হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই। তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেতনভাতা পরিবহনের েেত্র পুলিশ সহযোগিতা করবে। পুলিশের সহযোগিতা নিতে আমরা মালিকদের অনুরোধ করেছি।
নির্ধারিত সময়ে বেতনভাতা প্রদানের চেষ্টা চলছে জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, কারখানাগুলোতে বর্তমানে কাজ অনেক কম। গত দুই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের ২ অক্টোবরের মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসের বেতন, ওভারটাইম ও বোনাস প্রদান করতে হচ্ছে, যা অনেক উদ্যোক্তার পইে পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য বিষয়। এ অবস্থায় যাতে সব উদ্যোক্তার পে শ্রমিক ভাইবোনদের বেতন ও পাওনাদি পরিশোধ করা সম্ভব হয়, সে ব্যাপারে সম্ভাব্য সহযোগিতার জন্য আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছি। আসন্ন ঈদুল আজহার আগে বেতনভাতা পরিশোধের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়েছি। তারাও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আশা করছি শ্রমিক-মালিক সব পক্ষ সন্তুষ্টচিত্তে ঈদ-পূজা উদযাপন করতে পারব।
এ দিকে শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঈদ উপলক্ষে ভেতনভাতা নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারেÑ এমন প্রায় ৫০০ কারখানার তালিকা করেছে সংস্থাটি। এসব কারখানার শ্রমিকেরা যাতে মিছিল-সমাবেশ বের করতে না পারেন সে ব্যাপারেও সজাগ রয়েছেন সংস্থার সদস্যরা। পুলিশের কড়া পাহারা উপেক্ষা করেই রাজধানী ও এর আশপাশের কোনো না কোনো এলাকায় বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা। এ নিয়ে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ এবং সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই। আগামী কয়েক দিনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১:২৪:৩৪ ৩৪০ বার পঠিত