বিদ্যা সাগর (১৮২০—১৮৯১)
বঙ্গ-নিউজ:আসল নাম- ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগর উপাধি। আজ ২৬ শে সেপ্টেম্বর-বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগরের জন্মজয়ন্তি।
বিদ্যা সাগরের জীবনে তাঁর পিতা মহের প্রভাব পড়েছিলো প্রবল ভাবে। যদিও দরিদ্র কিন্তু কূলগর্ব ও স্পষ্টবাদিতা -তাঁর পিতামহের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। জেদি, একরোখা অথচ নম্র ও ভদ্র ছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগর কথা সাহিত্যের বিভিন্ন দিককে স্পর্শ করেছেন,কিন্তু সম্পূর্ণ মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টি করেননি সত্য, তবে তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন ভাবকে যে ভাবে ব্যক্ত করেছেন- তার মধ্যেই তাঁর মৌলিকতা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বিভিন্ন উদ্দেশ্যমূলক গ্রন্থের মধ্যেদিয়ে একজন সৃষ্টিশীল প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য শিল্পীর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সেই ব্যক্তি ছিলেন-যিনি একদিকে সমাজ অন্যদিকে ভাষা -উভয় দিককেই শাসন করেছেন।সমাজসংস্কারক ও সাহিত্য সেবী বিদ্যাসাগর থেকে ব্যক্তি বিদ্যাসাগর অনেক বড়। তাঁর মানবতাবাদ জীবনের সব চেয়ে বড় আদর্শ -তা তাকে শিক্ষা সংস্কার ও সমাজ সংস্কারে প্রেরণা যুগিয়েছে।
১৮৪৭সালে “বেতাল পঞ্চবিংশতি” রচনায় বাংলা গদ্যের দেহ নির্মাণ করেন, শ্রী এবং সৌন্দর্য দান করেন, পরবর্তীকালে তাঁর এই গদ্যের পথ ধরেই বাংলা গদ্য নিজের পথ করে নেয়। ছাত্ররা যাতে অল্প পড়ে বেশী লাভবান হয় -সেই কথা মনে রেখেই তিনি শিশু পাঠ্যপুস্তক রচনায় আত্মনিয়োগ করেন, এটাও তাঁর মধ্যকার মানবতাবাদের প্রকাশ।
তিনি বাংলা গদ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ভিত্তি কঠিন করেই গড়তে হয়। এই কারনেই বাংলা গদ্যের রূপও ছিল কিছুটা কঠিন। তাঁর এই মূল শিকড় থেকেই পরবর্তীকালে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদিরা বিশাল মহীরুহে পরিনত হয়েছেন। তাঁর “বেতাল পঞ্চবিংশতি” রচনায় অনেক সংস্কৃতানুসারি শব্দের বাহুল্য আছে; তার কারন প্রথম সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ দ্বিধামুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তিনি যে সত্যিই সংস্কৃতানুসারী নন,তা “সীতার বনবাস” রচনায় প্রমান পাওয়া যায়। “শকুন্তলায়”তিনি প্রত্যক্ষ সংস্কৃতানুসারী ছিলেন না। “সীতার বনবাস”গ্রন্থে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বাংলা গদ্য রচনা করেন। বিষয় অনুসারে ভাষা ব্যবহার তাঁর বৈশিষ্ট্য। সীতার বনবাস কোন গ্রন্থের অনুবাদ নয়, তিনি রামায়ণের গল্পের অনুবাদে -সীতার বেদনা, সীতার মহিমা ও রামায়ণের গাম্ভীর্য দেখাবার জন্য গুরুগম্ভীর ভাষা প্রয়োগ করতে চেয়েছেন-সরল সাধু গদ্যও এর মধ্যকার প্রধান লক্ষণ
বালক বয়সে তিনি মাইলস্টোন দেখে দেখে ইংরেজি অক্ষর চিনেছিলেন। আত্ম জীবনী রচনায় তাঁর অন্তরঙ্গবোধ ছিল এতো বেশি যে ঠাকুরদাসের অর্থাৎ দরিদ্র পিতার অসহায় করুন অবস্থা-তিনি প্রভুত ঐশ্বর্যের অধিকারী হওয়ার পরেও পিতার কাহিনী বর্ণনায় কি পরিমাণ সহানুভূতিশীল ছিলেন-তার প্রমান পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীতে।
নারীজাতির বঞ্চনা তাকে বিধবা বিবাহে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। তারানাথ তর্কবাচস্পতি বিধবা বিবাহের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সমালোচনা আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপে তাকে জর্জরিত করার প্রয়াস চলেছে অবিরত। “ভাইপো” ছদ্মনাম নিয়ে -বাচাল ভঙ্গিতে তিনি সমালোচকদের জবাব দিয়েছেন। হাস্যতরল ভাষায় প্রতিপক্ষকে প্রতিপক্ষের অস্ত্র দিয়েই আঘাত ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এই ব্যঙ্গাত্মক গদ্যভঙ্গি পরবর্তীতে প্যারীচাঁদ মিত্র ব্যবহার করেছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন-মদনমোহন তর্কালঙ্কার। শিশুশিক্ষা বিষয়ক প্রাপ্ত অর্থের তিনভাগ অর্থ তিনি মদন মোহনের বিধবা পত্নী ও বিধবা কন্যাকে -শুধু দয়া পরবশ হয়ে আজীবন দান করেছেন। পরে মদন মোহনের জামাতা যোগীন্দ্রনাথ তাঁর নামে পরস্ব অপহরণের অভিযোগ আনলে তাঁর আত্মসম্মান বোধ সজাগ হয়ে ওঠে। তিনি বলিষ্ঠ বক্তব্যদ্বারা অভিযোগ খণ্ডন করেন। তাঁর মধ্যে বজ্রের কাঠিন্য ও কুসুমের কোমলতা ছিল। তিনি বুঝেছিলেন,সকল বিষয়ের ব্যাখ্যা সর্বদা একই ভাষার ভঙ্গিতে দেওয়া যায় না। ঔচিত্যজ্ঞান তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। লঘুভঙ্গি থাকলেও তিনি ভাষাকে মোটামুটি সাধু ভাষার ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
মধুসূদন ও বিদ্যাসাগরের মধ্যে তুলনা মূলক বিচার করে বলা হয়— মধুসূদন বাইরের দিক থেকে আপাদ মস্তক সাহেব কিন্তু অন্তরে অন্তরে খাঁটি বাঙালি আর বিদ্যা সাগর বাইরের দিকথেকে আপাদ মস্তক বাঙালি কিন্তু অন্তরে অন্তরে খাঁটি আধুনিক সাহেব। মধুসূদন অমিত্র ছন্দ আবিষ্কার করে বাংলা কাব্যে প্রবাহমান গতি এনেছেন আর বিদ্যাসাগর গদ্যে যতি চিহ্ন প্রয়োগ করে বাংলা গদ্যকে প্রাণময় গতিশীলতা দান করেছেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক-আল রিআন
বাংলাদেশ সময়: ২২:৫২:৫০ ২৩৯৪ বার পঠিত